রংপুরে ৬ হাসপাতালে বিকল এক্স-রে মেশিন, রোগীদের ভোগান্তি

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওইসব হাসপাতালে তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে এক্স-রে যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে আছে।

আফতাবুজ্জামান হিরুরংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2023, 03:07 PM
Updated : 23 March 2023, 03:07 PM

রংপুরের হারাগাছ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও পাঁচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন দীর্ঘ দিন থেকে বিকল হয়ে পড়ে আছে । এতে ভোগান্তি পড়েছে এসব এলাকার রোগীরা।

এক্স-রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা নিতে রোগীদের অন্যত্র ছুটতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে খরচ, সেইসঙ্গে হচ্ছে সময়ের অপচয়।

রংপুরের সিভিল সার্জন বলছেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারিগরি সহয়তা চাওয়া হয়েছে। দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে।

সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে জানা যায়, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ, পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কাউনিয়ার হারাগাছ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে আছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওইসব হাসপাতালে তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে এক্সরে যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে আছে। 

কাউনিয়ার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার এখানে যোগদান করার প্রায় দুই বছর হলো। এর আগে থেকেই এ হাসপাতালের ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে; টেকনোলজিস্টও নেই।”

২০১৬ সালে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে ফিলিপস কোম্পানির এক্স-রে মেশিন এখানে বসানো হয় বলে তিনি জানান।

মীর হোসেনের ভাষ্য, “কিছুদিন চলার পর তা নষ্ট হয়ে যায়। আমি এখানে আসার পর এই কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি; তারা এখানে এসে দেখেও যায়। কিন্তু যন্ত্র সারাতে অনেক টাকা খরচের হিসাব দিয়েছে তারা। তাই সারানো হচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, “প্রতিদিন এ হাসপাতালে গড়ে ২০/৩০ জন রোগী পাওয়া যায়, যাদের এক্স-রে প্রয়োজন। কিন্তু এখানে এ সুবিধা না পেয়ে রোগীদের ৩২ কিলোমিটার দূরে রংপুর শহরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয়। সেখানে হাসপাতালের চেয়ে চার গুণ বেশি টাকা লাগে। দীর্ঘদিন ধরে এ পরিস্থিতি চললেও সমস্যার সমাধান হয়নি।”

গত সোমবার কাউনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন টেপামধুপুর এলাকার হাত ভাঙা রোগী বিকাশ চন্দ্র রায়। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার।  

তিনি বলেন, “ভাই, আপনাকে কী বলার আছে, আমরা গরিব মানুষ; আমার হাত ভেঙে গেছে। এখানে আসলাম এক্স-রে করানোর জন্য; কিন্তু মেশিন নষ্ট। এখন আমাকে যেতে হচ্ছে রংপুর শহরে। সেখানে তো অনেক টাকা লাগবে। এখানে হলে আমাদের ভালো হত, টাকা আর সময় দুটোই কম লাগত।” 

পীরগঞ্জ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাদিকাতুল তাহিরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাত্র ১৪টি এক্স-রে করানোর পরই এখানকার মেশিনটি বিকল হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টায়ও তা আর চালু করা যায়নি। পরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনেক চিঠি চালাচালি করেছি, কাজ হয়নি। গত ১৯ ডিসেম্বর আমি ঢাকায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করেও এক্স-রে মেশিনের সমস্যার সমাধান করাতে পারিনি।”

তিনি আরও বলেন, “রংপুরের সব উপজেলায় একই অবস্থা। আমার জানা মতে, ২০১৩ সালে টেন্ডার হয়; ২০১৬ সালে আমার উপজেলায় মেশিন বসানো হয় আর ২০১৮ সালে মেশিনটি দিয়ে কাজ শুরু করা হয়। মাত্র ১৪টি এক্সে-রে করানোর পরই মেশিনটি বিকল হয়ে যায়। এখনও সেই অবস্থায় পড়ে আছে।”

প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্রটি সাধারণ মানুষের কাজে আসছে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “ভাই, আমি প্রায় হাপাই গেলাম এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে দিতে; আর কত?”

কথা হয় গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর ইউনিয়ানে কাশিয়াবাড়ী এলাকার আফসার আলী (৬৫) নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে।

তিনি বলেন, “বাবারে, আমরা তো নদী এলাকার মানুষ। কতবার যে তিস্তার ভাঙ্গনের শিকার হছি তা বলার মত না। জমিতে কাজ করতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়ে চিকিৎসা নিতে গংগাচড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে আসি।

“চিকিৎসক হামাকে বলিচ্ছে এক্স-রে করানোর। সেখানকার এক্সরে যন্ত্র নষ্টর কথা শুনে, হামরা এ্যালা অমপুরত আসনো বাহে। এইটা কোনো কথা হইল কনতো? হামার সরকার হামার উপজেলাত মেশিন দিলো তা ব্যালো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, হামার কি আর সেই টাকা আছে, যে হামার রা অমপুরুত জ্যায়া এক্সে-রে করমো?”

বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টেকনোলজিস্ট রেজাউল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডিজিটাল এক্স রে করাতে আকার ভেদে ১৫০-২০০ টাকা ফি লাগে। একই এক্স-রে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে করালে ৫৫০-৮৫০ টাকা ফি নেওয়া হয়।”

পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে কথা হয় সদর ইটাকুরি ইউনিয়ানের ইটকিুমারী এলাকার আজগার আলী (৫০) নামের এক রোগীর সঙ্গে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “অনেক দিন থাকি হামার খালি শুনি যে, হাসপাতালের এই মেশিনটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কোটি টাকা দিয়া সরকার মেশিন কিনে দিছে, হামার গরিবের চিকিৎসা করবার জন্য। কিন্তু বছরের পর বছর তাক পড়ি আছে। আর হামাক বহুত পাইসা খরচ করি অংপুর শহরোত পরীক্ষা করির নাগে। তা হইলে হাসপাতালোত মেশিন থাকিয়া হামার লাভ কী হইল? এগল্যা সবাই গুল্যা চোর আর বাটবার।”

এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কানিজ সাবিহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে যোগদানে আমার ১৩ মাস হচ্ছে। আমি আসার আগে থেকেই এখানের এক্স রে মেশিন নষ্ট। আমি কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি মেরামত করার জন্য আমার আগে যে স্যার ছিলেন তিনি ২০১৮ সালে টেকনিশিয়ান এনে ছিলেন। যেসব জিনিস নষ্ট, তার তালিকাও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। যোগদানের পর যন্ত্রটি চালুর উদ্যোগ নিই। একজন প্রকৌশলী ডেকে আনা হয়।

“প্রকৌশলী জানান, এ মেশিনের মাদার বোর্ড নষ্ট হয়ে গেছে, এটা ভালো করতে ৭/৮ লাখ টাকা লাগবে । তার চেয়ে বরং নতুন মেশিন কেনা ভালো হবে।”

কানিজ সাবিহা আরও বলেন, “এর গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নষ্ট, যা প্রচুর ব্যয়বহুল। বাধ্য হয়ে বছর নতুন ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্রের জন্য চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি।”

রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাসপাতালগুলোয় নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা ডিজিটাল এক্স রে যন্ত্রের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারিগরি সহয়তা চেয়েছি। সহয়তা পেলেই দ্রুত সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।