দুর্যোগ ও বাঁধ ভাঙার দুর্বিষহ জীবন কয়রাবাসীর

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, সরকার এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করলেও কাজ শুরু হয়নি।

শুভ্র শচীনখুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2023, 01:30 PM
Updated : 6 May 2023, 01:30 PM

দেশের অন্যতম প্রধান জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় জেলা খুলনা। এ জেলার একেবারে দক্ষিণে দুর্যোগকবলিত উপজেলা কয়রা।

উপজেলাটি ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ, কয়রা ও শাকবাড়িয়া নদী। আর এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নই সুন্দরবনের সীমানায়। 

গত কয়েক বছরের একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এ অঞ্চলের মানুষ। 

ঝড়ের আভাসে উপকূলবাসী অরক্ষিত বেড়িবাঁধগুলো নিয়ে প্রতিবারই লোকালয়ে প্লাবনের আশঙ্কায় থাকেন। গত কয়েকদিনে একটি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে ফের আশঙ্কায় ভুগছেন স্থানীয়রা। 

যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় নিয়ে এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে বঙ্গোপসাগরে আগামী রোববার একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে; কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে যা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। 

কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, “ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস হলেই যে কয়টি জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, খুলনার কয়রা তার অন্যতম। ঝড়ে আমাদের বড় ভয় থাকে বেড়িবাঁধ নিয়ে।” 

তিনি বলেন, “উপকূল সুরক্ষায় অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত বেড়িবাঁধ এখন আর সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না। আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো কোনো রকমে টিকে আছে।” 

যেকোনো দুর্যোগ বা বৈরি আবহাওয়ায় নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়, বাঁধ ভাঙে। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। নষ্ট হয় ঘরবাড়ি, ফসল। ভিটে-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয় মানুষ। 

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, সরকার এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করলেও কাজ শুরু হয়নি এখনও। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, “বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছরই উপকূলে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। এর থেকে ক্ষতি কমাতে সরকারের বড় পরিল্পনা দরকার।” 

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুস সালাম খান বলেন, “জেলা শহর থেকে সড়ক পথে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণের এ জনপদ স্বভাবতই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। 

“এর আগে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আইলায় সর্বস্ব হারানো এখানকার অনেকেই এখনও খুঁজে ফেরেন স্থায়ী নিবাস।” 

আবার অনেকেই আবাস হিসেবে বেছে নিয়েছেন বেড়িবাঁধের কিনার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর বেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে এলাকায় অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। আবার জীবিকার অন্বেষণে এলাকা ছেড়ে শহর ও নিকটবর্তী জেলামুখী হচ্ছেন কেউ কেউ। 

সালাম বলেন, “উপকূলের পানি এবং মাটি ক্রমশ লবণাক্ত হয়ে উঠছে এবং ধান চাষ করা বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই বৈদেশিক মুদ্রার স্বার্থে এ অঞ্চলে নোনাপানিতে চিংড়ির চাষ বেড়েছে। চিংড়ি চাষের কারণে যথেচ্ছভাবে বেড়িবাঁধ কাটাছেঁড়া করা হয়। চাষিরা বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে কৃষিজমিতে নোনাপানি তোলেন। এতে বাঁধ মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে।” 

সালাম আরও বলেন, “২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানায় সেবারও বাঁধ ভাঙে এবং সেটি মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষ সময় নেয় ২ বছর। এই পুরো সময়ে বসবাসের জায়গাগুলো পানির নিচে ডুবে ছিল এবং অনেক পরিবারের জন্য বাঁধই ছিল একমাত্র আশ্রয়।” 

২০১১ সালে বাঁধ মেরামত হলে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেখানে ফেরেন এবং শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে বাধ্য হন। তারপর আঘাত হানে ইয়াস। গত ১০ বছরে তারা যতটুকু গড়েছিলেন, ইয়াসে তার সবই আবার নোনাপানির নিচে তলিয়ে দেয়। এভাবেই চলছে কয়রাবাসীর ভাঙা-গড়ার দুর্বিষহ জীবন। 

এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছর বর্ষার আগেই উপজেলার শাকবাড়িয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ধস দেখা দিয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে আছেন পাঁচ ইউনিয়নের বাসিন্দারা। 

উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা রিং বাঁধ, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাটসংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়িয়া, ২ নম্বর কয়রা, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও মহেশপুর এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। 

স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে পারে। 

এ ছাড়া কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতে পানি সরবরাহের আটটি জলকপাট (স্লুইসগেট) অকেজো পড়ে আছে। শাকবাড়িয়া নদীর নয়ানী ও সুতিয়া বাজার-সংলগ্ন জলকপাটটি নষ্ট হওয়ার উপক্রম। জলকপাটের দুই পাশের মাটি দেবে গিয়ে নদী থেকে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর কয়রার ২১টি জায়গায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হয়। পাশাপাশি ২০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে সংস্কার করা হয়। বর্তমানে সাত কিলোমিটারের বেশি সংস্কারকাজ চলমান রয়েছে। তবে ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে আছে। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র ভাঙনে সিসি ব্লক সরে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাটকাটা এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ। উত্তর বেদকাশী থেকে দক্ষিণ বেদকাশী পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার বাঁধের মাটি ধসে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দুই পাশের মাটি সরে বাঁধ সরু হয়ে গেছে। 

দক্ষিণ বেদকাশী ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোজাফফর হোসেন বলেন, “উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন হচ্ছে বেদকাশী। এ ইউনিয়নের দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শাকবাড়িয়া ও কপোতাক্ষ। দুই নদ-নদীর ক্রমশ ভাঙনে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হতে যাচ্ছে ইউনিয়নটি।” 

মোজাফফর বলেন, “১০ বছর আগেও দুই নদ-নদীর দূরত্ব দুই কিলোমিটারের বেশি ছিল। প্রতি বছর ভাঙতে ভাঙতে এখন ৩০০ মিটারে এসে ঠেকেছে।” 

ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দুষছেন নয়ানী এলাকার বাসিন্দা ও মহেশ্বরীপুর ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মনি শঙ্কর রায়। 

তিনি বলেন, “আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও জলকপাট নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। উত্তাল নদী আর বৈরী আবহাওয়া দেখলেই এলাকার মানুষ ভয়ে থাকেন। প্রতি বছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে ভিটেবাড়ি হারিয়ে অনেক পরিবার খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।” 

মনি শঙ্কর আরও বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা টালবাহানা করে কালক্ষেপণ করছেন। বাঁধ না ভাঙলে তাদের ঘুম ভাঙে না। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির তোড়জোড় শুরু হয়। ততক্ষণে নোনাপানিতে সবই তলিয়ে যায়। নিঃস্ব হয় মানুষ।” 

উত্তর বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, “ইউনিয়নের গাজীপাড়া ও গাতিরঘেরী এলাকায় গত বছর বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেই বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

উত্তর মহেশ্বরীপুর সিংহেরচরের কয়রা নদীর বেড়িবাঁধেরও কয়েকটি জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।” 

ওই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, “টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি আমাদের বহুদিনের। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকেই এ দাবিতে সোচ্চার ছিলাম আমরা। কিন্তু আশ্বাসে আশ্বাসেই পার হয়েছে এক যুগ। প্রতিবছরই বাঁধ ভাঙছে। কেউ না কেউ নিঃস্ব হচ্ছে।” 

বর্তমানে যে কয় জায়গায় বাঁধ ধসে গেছে, নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বাড়লে বাঁধ ভেঙে গোটা ইউনিয়ন নদীর পানিতে তলিয়ে যাবে। 

শাহনেওয়াজ বলেন, “টেকসই বাঁধের পাশপাশি বাঁধগুলোর উচ্চতা আরও অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো উচিত। আর বাঁধ টেকাতে হলে নদী শাসনের কাজ করতে হবে। এজন্য নদীতীরে পাকা ব্লক ফেলার বিকল্প নেই।”

উপজেলা সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের বাসিন্দা মহসীন গাজী বলেন, উপকূলের বাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রত্যেক বছরই কোনো না কোনো প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে দরপত্র ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির কিছু নির্ধারিত ঠিকাদারকে জরুরি সংস্কারের নামে সেই কাজ দেওয়া হয়। 

সেইসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাঁধ মেরামতের কাজ না করে অর্ধেক মূল্যে স্থানীয় সাব-ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। সাব-ঠিকাদাররাও সেইকাজ না করে চুক্তিবদ্ধ মূল্যের অর্ধেক মূল্যে শ্রমিক সর্দারদের মৌখিক নিয়োগ দেন। 

মহসীন বলেন, এভাবে কয়েক হাত ঘুরে প্রকল্পের মূল টাকার পাঁচ ভাগের এক ভাগ ব্যয় হয় বাঁধ মেরামতে। বাকি টাকা চলে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। যার অংশ পান পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারাও। 

কয়রার ইউএনও মো. মমিনুর রহমান বলেন, তিন দিকে নদীবেষ্টিত কয়রার মূল সমস্যা নদীভাঙন। যেকোনো দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়লে কোথাও না কোথাও বাঁধ ভাঙে। 

মমিনুর বলেন, ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানের চেষ্টার পাশপাশি যারা দুর্দশায় আছেন তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, দুর্যোগকবলিত কয়রার বেড়িবাঁধের ভাঙন রোধে তারা স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছেন। কয়েক দিনের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প শুরু হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঝুঁকি কমবে। 

তিনি আরও বলেন, আপাতত বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশের তালিকা করা হয়েছে। কিছু এলাকায় সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। বর্ষার আগে অন্য জায়গাগুলোতেও কাজ করা হবে।