গাইবান্ধা-৫: ফজলে রাব্বীর আসনে নৌকার মাঝি কে?

অন্তত তিনজন এই আসনে নৌকার কাণ্ডারি হতে আগ্রহী

তাজুল ইসলাম রেজাগাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 August 2022, 10:51 AM
Updated : 7 August 2022, 10:51 AM

প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার সংসদীয় আসনে নৌকার কাণ্ডারি কে হচ্ছেন এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।

গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনটিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে। উপ-নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে ভুল হলে আসনটি হাতছাড়া হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকে।

এই আসনে স্বাধীনতার পর থেকে ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে পাঁচবার জাতীয় পার্টি, চারবার আওয়ামী লীগ ও দুইবার বিএনপি জয়লাভ করেছে। রাজনৈতিক কারণে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে এখানে জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে সাধারণ ভোটারদের ধারণা।

এখন পর্যন্ত মোট তিনজন নেতা এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। এখনও এই উপ-নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত না হলেও প্রত্যেকে নিজ নিজ দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন।

মনোনয়ন প্রত্যাশী তিন নেতা হলেন- ফজলে রাব্বী মিয়ার মেয়ে ও ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারজানা রাব্বী বুবলী,বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম সেলিম পারভেজ।

ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া গত ২২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর দুদিন পরই তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। জাতীয় সংসদ আইন অনুযায়ী, আসন শূন্য ঘোষণার ৯০ দিনের মধ্যে উপ-নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

গাইবান্ধার রাজনীতিতে ফজলে রাব্বী মিয়া নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনে ১১টি নির্বাচনের মধ্যে সাতবারই তিনি জয়লাভ করেছেন। দুইবার জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। একবার আইন প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন।

সাঘাটা উপজেলার গাটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী ফজলে রাব্বী মিয়া স্কুলজীবনেই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন এই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-মোজাফফর) সঙ্গেও কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। গাইবান্ধা শহরের আইনজীবী হিসেবে তার প্রসার ছিল ব্যাপক। মানুষের সঙ্গে সহজাত সম্পর্কের কথা এখনও বলেন ফজলে রাব্বী মিয়ার অনুসারীরা।

তবে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য হন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে; জাতীয় পার্টি থেকে। এরশাদ শেষ সময়ে এসে তাকে আইন প্রতিমন্ত্রীও করেছিলেন কিছুদিনের জন্য। দীর্ঘদিন পরে তিনি আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।

জাতীয় সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, ফজলে রাব্বী মিয়া ১৯৮৬ সালের তৃতীয়, ১৯৮৮ সালের চতুর্থ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে তিনি আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।

২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদে যান। পঞ্চম ও সপ্তম সংসদে তিনি বিরোধীদলীয় হুইপ ছিলেন।

দশম সংসদে ডেপুটি স্পিকারের চেয়ারে বসেন ফজলে রাব্বী মিয়া। একাদশ সংসদেও টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এই দায়িত্ব পালনকালেই বর্ণাঢ্য এই রাজনৈতিক নেতার জীবনাবসান হয়।

ফজলে রাব্বী মিয়া বেঁচে থাকাকালীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তার আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু দল বারবার তার হাতেই নৌকার বৈঠা তুলে দিয়েছে। তার প্রতিদান ফজলে রাব্বী দিলেও স্থানীয় রাজনীতিতে তার বিরোধীর সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুল হাসান রিপনের সঙ্গে ফজলে রাব্বী মিয়ার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি একরকম প্রকাশ্যই। তাদের কর্মী-সমর্থকরাও সেটা স্বীকার করেন।

রিপনের সমর্থক নেতা-কর্মীরা দাবি করেন, দলীয় মনোনয়ন না পেলেও তিনি দলে সবসময় সক্রিয় ছিলেন এবং দলকে নানাভাবে শক্তিশালী করেছেন। আগামী দিনে এই আসনে তিনি মনোনয়ন পেলে প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করতে পারবেন।

মাহমুদ হাসান রিপন ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। সেই সুবাদে ফুলছড়ি ও সাঘাটা দুই উপজেলার তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে তার যথেষ্ট কর্মী-সমর্থক রয়েছে। বিশেষ করে, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের একটি অংশকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার সঙ্গে দেখা যায়।

ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলাকার মানুষের পাশে থেকে সবসময় উন্নয়নের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি। দলের নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে এখনও পাশে থাকি। যদি সামনের উপ-নির্বাচনে দল আমাকে মূল্যায়ন করে, মনোনয়ন পাই; তাহলে আসনটি ধরে রাখতে পারব, দলকে উপহার দিতে পারব।”

সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে রিপনের সমর্থকদের পাশাপাশি ফজলে রাব্বী মিয়ার সমর্থক নেতাকর্মীরাও সক্রিয়। আগামী নির্বাচনে ফারজানা রাব্বী বুবলি বাবার আসনে প্রার্থী হবেন এমন আশার কথাই তারা প্রচার করছেন। বাবার অসুস্থতার সময় গত ১৪ মার্চ ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন।

তারপর থেকেই বাবার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। চায়ের আড্ডায়, রাজনৈতিক আলোচনায় আওয়ামী লীগের নতুন এই নেতাকে নিয়ে ভোটারদের আগ্রহেরও কোনো কমতি নেই।

দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে ‘শতভাগ আশাবাদী’ ফারজানা রাব্বী বুবলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচিত হলে বাবার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করব। বাবা যে সাঘাটা-ফুলছড়িকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, মডেল টাউন করবেন, সেই স্বপ্নপূরণ করতেই আমার রাজনীতিতে আসা। সবাই চায়, বাবার উত্তরসূরী হিসেবে আমি এখানে জনসেবা করি।”

গাইবান্ধা-৫ আসনের রাজনীতিতে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম সেলিম পারভেজ এবং মাহমুদ হাসান রিপন একই বলয়ের রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দুজনই একে-অপরের খুব ঘনিষ্ঠ।

রিপন যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন তার পক্ষে সরব ছিলেন সেলিম। সংবাদ মাধ্যমে তিনি এ নিয়ে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকার এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

রিপনের সমর্থকরা বলার চেষ্টা করেন, সেলিম বিগত উপজেলা নির্বাচনে রিপনের সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন। পরে এ বছরের মার্চে ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে সভাপতি হতে রিপনই তাকে সহযোগিতা করেছেন। এখন তিনি নিজেই এই আসনে প্রার্থী হতে চাইছেন, রিপনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন।

যদিও সেলিম পারভেজের ভাষ্য, তিনি তার উন্নয়নমূলক কাজ ও মানুষের সমর্থনের কারণেই দলের মনোনয়ন চাইবেন।

ফুলছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চেয়ারম্যান হয়ে আমি অনেক উন্নয়ন করেছি। সংসদ সদস্য হলে এই উন্নয়ন করার পথ আরও সুগম হবে। তাই মনোনয়ন চাইব। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলে আমি এ ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।”

এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেকে ‘যুবলীগ নেতা’ পরিচয় দিয়ে দলের মনোনয়ন চেয়ে দুই উপজেলায় পোস্টার সেঁটেছেন সুশীল চন্দ্র সরকার। তিনি ঢাকায় থাকেন বলে জানা গেছে।

বগুড়ায় আজিজুল হক কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ছাত্রলীগ করতেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। সুশীল চন্দ্র সরকার নিজেকে ‘কণ্ঠশিল্পী’ হিসেবে পরিচয় দেন।

তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর হাতকে আরও শক্তিশালী করতে ও এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে তিনি দলের মনোনয়ন চাইছেন।

এই আসনে জাতীয় পার্টির শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। এখানে উপ-নির্বাচনে সাঘাটা উপজেলা জাপার সভাপতি এবং পরপর দুইবার নির্বাচিত সাঘাটা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আইনজীবী গোলাম শহীদ রঞ্জু প্রার্থী হবেন বলে নেতা-কর্মীরা প্রচার চালাচ্ছেন।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে এলাকায় গোলাম শহীদ রঞ্জুর রাজনৈতিক প্রভাব বেড়েছে। এ সুনামকে কাজে লাগিয়েই তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন।

গোলাম শহীদ রঞ্জু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই আসনটি দীর্ঘদিন জাপার দখলে ছিল। জাপা এখনও এই আসনে সুসংগঠিত। তাই উপ-নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এ আসনটি আমি পুনরুদ্ধার করে পার্টিকে ফিরিয়ে দিতে পারব।”

দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি ঘোষণা দিয়ে জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা উপ-নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। যদিও অনেক জায়গায় বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্রভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। ফলে এখানের উপ-নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে দ্বিধা রয়েছে ভোটারদের মধ্যে।

এই আসন থেকে নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন সময় প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ফারুক আলম সরকার।

তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য রোববার দুপুরে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি তা ধরেননি।

এই আসনে ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওয়ালিউর রহমান রেজা, ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে বিএনপির রোস্তম আলী মোল্লা, ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) ষষ্ঠ নির্বাচনে বিএনপির মতিউর রহমান এবং ২০০১ সালের অষ্টম নির্বাচনে বেগম রওশন এরশাদ জয়লাভ করেন।