পরশুরামের কাশীনগর গ্রামের দেলোয়ার বানের তোড়ে ভয় পেয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে উঠে পড়েন একটি বাড়ির টিনের চালার ওপর।
Published : 28 Aug 2024, 09:26 AM
ফেনীর সীমান্তবর্তী পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী নদীর পানি বেড়ে প্রায়ই বন্যা হয়, যার সঙ্গে বেঁচে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা এলাকাটির সাহসী মানুষই এবার বিপন্নতার মুখে পড়ার এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন।
বন্যার পানি এতটাই দ্রুত সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় যে, মুহূর্তের মধ্যে প্লাবিত বিস্তৃর্ণ অঞ্চল দেখে ‘মৃত্যুভয়’ জেগে ওঠা জনপদটিতে জীবন বাঁচাতে অনেকে ‘কিংকর্তব্যবিমূড়’ হয়ে পড়েন।
নিজে বাঁচতে আর পরিবারের সদস্যদেরও রক্ষা করতে তাৎক্ষণিক যিনি যেভাবে পেরেছেন, কোথাও না কোথাও ঠাঁই করার চেষ্টা করেছেন। কেউ আশ্রয় নেন ঘরের চালে, কেউ ঘরের সিলিংয়ে, কেউবা তড়িঘড়ি উঠে পড়েন গাছে।
এমন একজন হলেন পরশুরামের কাউতলি ইউনিয়ের কাশীনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার। তার সঙ্গে কথা হলে চারটা দিনরাত ঘরের টিনের চালের ওপর থাকার সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।
কখন কী হয়, বন্যা আরও কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, চুরি-ডাকাতির আতঙ্ক- সব মিলে ভয়ে বুক দুরু দুরু অবস্থা ছিল তার, সেভাবে কাটে দিনগুলো। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেই গল্প শুনিয়েছেন দেলোয়ার।
“চোখের পলকে হুড়ুহুড় করে সব কিছু ভেঙেচুরে ভাসিয়ে দিয়ে আসতে থাকে পানি। আর কখনও দেখিনি এমন বান,” বলেন তিনি।
কাশীনগর গ্রামে দেলোয়ার বানের তোড়ে ভয় পেয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে প্রাণ বাঁচতে উঠে পড়েন একটি বাড়ির টিনের চালার ওপর।
তার প্রতিবেশীর বাড়িটি পাকা। বন্যা মোটামুটি স্থির হওয়ার পর দেলোয়ার তার স্ত্রী-সন্তানদের রেখে আসেন ওই পাকা বাড়ির ছাদে। নিজের ঘরের মায়ায় তিনি থেকে যান টিনের চালের ওপর।
দেলোয়ার বলেন, “টোটাল আছিলাম চাইর দিন, চালের উপরে। বউ-বাচ্চারে কোনো রকমে হাচুরি ধরি লই যাই, ওই কাছে এক বাড়ি আছিল। হেইখানে নিয়ে থুই আইছি ছোডো-মোডো বাইচ্চা-কাইচ্চা।”
দেলোয়ার যেভাবে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তাতে চরম উৎকণ্ঠা যে তাদের পেয়ে বসেছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। তার ভাষায়- “কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নাই, কোনো একটা বিল্ডিং নাই যে, আমরা উডি বাঁইচমু। এই ছাড়া কোন হত নাই। গাছগাছালির তলের মাডি হইজ্জন্ত গেছেগই। হয়তো আল্লাহ বাঁচাইছে, এইজন্য বাঁচি আছি।”
যে ঘরের চালায় দেলোয়ার ছিলেন, সেই ঘরেরই সিলিংয়েই ঠাঁই করে দেন তার বাবা-মাকে।
“তারার দমদমার (সিলিং) উপরে উঠি বসি আছিল। যদি এই ঘর চলি যাইতো মানুষও মারা যাইতো। হয়তো আল্লা বাঁচাইছে।”
দোলোয়ারের মতো জীবন বাঁচাতে সপ্ততিপর বৃদ্ধ মীর হোসেন তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে উঠে পড়েন ঘরের চালার ওপর।
এই বয়স্ক মানুষটি বলছিলেন চোখের পলকে বন্যায় তাদের সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা।
“আমার বয়স ধইরেন ৭০, আঁই (আমি) এরম বন্যা দেহিনো। আগে হইছে, কম আছিল; ভাঙছে। পানি ঢুকছে; পরে গেছেগই। এত কিছু নষ্ট আঁর (আমার) বয়সে অয়নো, আঁর জীবনে দেহিনো।”
আশ্রয় নেওয়া ঘরের ভিটার মাটি স্রোতের তোড়ে সরে যেতে দেখে ভয় পেয়ে যান মীর হোসেন। তারপর পানি সরারও কোনো লক্ষণ দেখছিলেন। তাই তিনি চলে যান প্রতিবেশীর বাড়ির ছাদে।
মীর হোসেনের টিনের বেড়া দেওয়া ঘরটি থেকে পানি নেমে গেছে। মঙ্গলবার তিনি সেটি দেখতে এসেছিলেন, এসে দেখেন কোনো আসবাবই আর ঠিক নেই।
টিনের বেড়ার নিচের অংশ ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। মঙ্গলবার কিছু মাটি দিয়ে ঘরটি টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিলেন তিনি।
তখন কথা হয় মীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, "আমরা আইজকেই আসছি বাড়িতে, এত দিন শুকনা খাবার যা পাইছি তাই খাইছি।”
মীরের বাড়ির পাশে দেখা যায় একটি বাড়ি পুরো ভেঙে পড়ে আছে। ঘরের টিন সরিয়ে এক পাশে স্তূপ করে রাখছিলেন শিরিন আক্তার।
সেখানে দাঁড়িয়ে শিরিনের সঙ্গে কথা হয়, বলেন, “এই যে আপনি দাড়াইছেন, হেইহানেই ঘর আছিল।"
তারা বন্যার সময় ঘরের টিনের চালার ওপর উঠে বসে ছিলেন।
“গরু-ছাগল কিছু মারা গেছে, কিছু সাঁতরে কোথাও যেতে পারে, তাহলে হয়তো বেঁচেছে। পানির স্রোতের কারণে নিচে নামতেই পারছিলাম না।”
শিরিন বলেন, পরে ঘরের চালা থেকে কোনোভাবে অন্য এক আশ্রয় নেন তারা। তবে মঙ্গলবার যখন ফিরলেন, তখন ঘরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, যা দিয়ে গুছিয়ে নেওয়া শুরু করবেন।
লিপি আক্তার নামে আরেকজনের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, “আমি গতকাল (সোমবার) ছাগলনাইয়া থেকে আসছি। এইটা আমার বাপের বাড়ি। এই কয়দিন কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
“ছাগলনাইয়াতে দুইতলা ফ্ল্যাট ডুবার মতো পরিস্থিতি, আমি তো মনে করছি এইখাননোত একতলাও নাই। আশ্রয়কেন্দ্র নাই, তিন-চারতলা স্কুলও নাই মনে হরছি।”
ছাগলনাইয়ায় বন্যার বিপর্যয় সম্পর্কে সবারই কমবেশি জানা। সেখান থেকে যে খবর আসছে, তা ভয়াবহ।
সেখানকার ভয়াবহতা দেখে বাবার বাড়ি এলাকা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন লিপি। তিনি বলেন, “আমি তো মনে হরছি যে সব মইরাই গ্যাছে। বাড়িঘর তো নাই, ওই আশা বাদ দিছি। গরুছাগল বাদ দিছি। শুধু মানুষের চিন্তা কইচ্ছি। মানুষজন বাঁচুক, হেইটা চাইছি সবসময়।”
বাবার বাড়ি পরশুরাম এলাকায় প্রায়ই যে বন্যা হয়, তা ভালো করেই জানা আছে লিপির। সে বিষয়ে টেনে তিনি বললেন, “এইখানে এমন অবস্থা খারাপ, প্রথম একবার ঢল হয় ২ তারিখে (২ অগাস্ট)। তখন কিছু ক্ষতি হইছে, সেইটা ঠিক করছে। এখন দ্বিতীয় ঢলে সব নিয়ে গেছে। আর কিছুই নাই, মানুষ ছাড়া আর কিছুই নাই। মানুষ বাঁইচছে এইটাই শুকরিয়া।"
কাউতলি ইউনিয়নের চম্পকনগর-কাশীনগরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে যোগাযোগের সড়ক মুহুরী নদীর বাঁধের ওপর করা। বাঁধটি বিভিন্ন স্থানে এমনভাবে ভেঙেছে যে, এখন হেঁটেই চলাচল করা কষ্টকর।
একরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই এলাকায় ত্রাণও পৌঁচাচ্ছে না সহজে। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুর্যোগের পর প্রথম সোমবার চিড়া-মুড়ির মতো শুনকা খাবার এসে পৌঁছায় কাশীনগরে।
চম্পকনগর গ্রামের বাসিন্দা সানিয়াত সাহেল শরীফ বলেন, “চলতি মাসের শুরুতে একবার ১০০ মিটারের মতো বাঁধ ভাঙে। তখন একবার বন্যা হয়েছিল, আবার শুকিয়ে গেছে। সব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ১৮ তারিখ থেকে আবার শুরু হইলো। এখানে স্রোতের যে গর্জন, একেবারে সাগরের মতো অবস্থা।”
তিনি বলেন, “মানুষজন আশপাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুই-তিন দিন পানি-খাবার পায়নি। ২৫ তারিখের পর এ এলাকা থেকে ধীরে ধীরে পানি থেকে নামা শুরু হইছে।”
তাদের এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে কম- এমন তথ্য দিয়ে শরীফ বলেন, “ফেনীতে পানি। কেউ তো এ পাশে আসতে পারে নাই। কালকে (সোমবার) প্রথম ত্রাণ আসছে। এক প্যাকেট বিস্কিট, হাফ কেজি চিড়া, হাফ কেজি মুড়ি এসব। এর আগে ব্যক্তিগতভাবে ৩০০ পরিবারকে বিস্কিট দেওয়া হইছিল।”