Published : 03 May 2025, 07:55 PM
শীতলক্ষ্যা নদীর উপর বহুল কাঙ্ক্ষিত কদমরসুল সেতুর নকশা পরিবর্তনের দাবি তুলেছে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন। সেতুটির পশ্চিম প্রান্তের সংযোগমুখ পরিবর্তন করে যথাযথ সমীক্ষা করে নতুন নকশা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।
শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা।
এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি। তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জ একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু নগর উন্নয়নে নাগরিক মতামত ও অংশগ্রহণ উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা পরিণতিতে জনদুর্ভোগ বাড়াচ্ছে।”
তিনি বলেন, “একটি আদর্শ নগরে সড়ক নেটওয়ার্ক থাকা উচিত মোট ভূখণ্ডের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। অথচ নারায়ণগঞ্জ শহরে বর্তমানে তা মাত্র সাত শতাংশ। অপরিকল্পিত নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর কদমরসুল সেতু নির্মাণ ইতিবাচক হলেও, প্রকল্পটির নকশা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”
রফিউর রাব্বির ভাষ্য, সেতুটির পশ্চিম প্রান্তের সংযোগ নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনের সড়কে পড়েছে। এ সড়কটি শহরের ব্যস্ততম একটি সড়ক। গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি স্থাপনা ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ার কারণে এ সড়কে যানজট লেগেই থাকে। এ অবস্থায় আরও একটি সেতু সংযোগ এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর উপজেলার মধ্যে সংযোগ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুটির নকশায় ‘সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদী সমীক্ষার অভাব’ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“প্রতিদিন শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দরঘাট দিয়ে এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এর যদি ৬০ ভাগ মানুষও এই সেতু ব্যবহার করে, তাহলে এর প্রভাব কী হবে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। প্রকল্পের নকশায় সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদী সমীক্ষার অভাব রয়েছে। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রকল্প অন্তত ১০০ বছর পরবর্তী বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রণয়ন করা উচিত”, যোগ করেন রাব্বি।
তিনি বলেন, “দ্রুত প্রকল্প সংশোধন করে সেতুর পশ্চিমমুখ পুনঃনির্ধারণ করতে হবে। জনগণের কষ্ট বাড়ায়, এমন অপরিকল্পিত উন্নয়ন কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।”
নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েলের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিবির জেলা কমিটির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন, বাসদের সদস্যসচিব আবু নাইম খান বিপ্লব, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক দিপু, সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম কাজল, সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায় ও সাবেক কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস।
একই দাবিতে এর আগে ‘নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “সংবাদ সম্মেলনের আগে তারা এ দাবিতে সিটি করপোরেশনে স্মারকলিপি দিয়েছেন। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর জানিয়েছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
নারায়ণগঞ্জের বুক চিরে বয়ে চলা শীতলক্ষ্যা নদী জেলার গুরুত্বপূর্ণ দুই উপজেলা সদর ও বন্দরকে আলাদা করেছে। দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষের প্রতিদিনের যাতায়াত সহজ করতে একটি সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা শীতলক্ষ্যার উপর সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত দুইপাড়ের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সেতুটি আর নির্মিত হয়নি।
অন্তত দুই দশক আগে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের মানুষের চলাচল সহজ করতে নবীগঞ্জ এলাকায় একটি সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের আগে ভোটারদের দুর্ভোগ দূর করতে শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। পরের বছর শীতলক্ষ্যার উপরে ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সংযোগ সড়কসহ ১ হাজার ৩৮৫ মিটার সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। বন্দর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কদমরসুল দরগাহের নামে এ সেতুর নামকরণ করারও সিদ্ধান্ত হয়।
সেতুটি শহরের ৫ নম্বর গুদারাঘাট এলাকার সঙ্গে অপর প্রান্তে বন্দর উপজেলার একরামপুর এলাকার সংযোগ করবে। এ সেতু বন্দর ও সদরের দুই শহরের মধ্যে সংযোগ তৈরি করলে তা মাত্র দুই মিনিটের পথ হবে।
২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর একনেক সভায় এ প্রকল্পের জন্য ৫৯০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বরাদ্দ পায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আপত্তির কারণে আটকে যায় প্রকল্প কাজ। এরই মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায় ২৮ শতাংশ। এমনকি প্রকল্পের নকশাও পরিবর্তন করতে হয়।
এ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে না দেওয়ার পেছনে ‘ওসমান পরিবারের হাত আছে’ বলেও একাধিক সময়ে অভিযোগ তুলেছিলেন সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
যদিও গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে রেলওয়ে, কুমুদিনী ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জটিলতা কাটিয়ে উঠতে প্রকল্পের ব্যয় ২৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩৫ কোটি ১৮ লাখ টাকায়। পরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র যাচাই-বাছাই শেষে গতমাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। এ মাসেই নদীর পূর্বপাড়ে কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। এরমাঝেই এসেছে নকশা পরিবর্তনের দাবি।
আরও পড়ুন: