শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুল কাদিরের নামে নাটোরের বাগাতিপাড়ায় ‘দয়ারামপুর সেনানিবাসের’ নাম করা হয় ‘কাদিরাবাদ সেনানিবাস’।
Published : 08 Dec 2022, 02:11 PM
রংপুরের বদরগঞ্জে পারিবারিক উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মোহাম্মদ আব্দুল কাদির স্মৃতিসৌধ; যেখানে লেখা আছে স্থানীয় ১১ মুক্তিযোদ্ধার নাম, মুক্তিযুদ্ধে তাদের নানা বীরত্বগাথা।
স্মৃতিসৌধ দেখতে দূরদদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন এই পাড়াগাঁয়ে। কিন্তু মূল সড়ক থেকে সেখানে যাওয়ার রাস্তা না থাকায় এই স্থাপনাটি যেন জনবিচ্ছিন্ন রয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ সংযোগও নেই।
বদরগঞ্জের মোস্তফাপুরে চিকলী নদীর তীরে দেড় একর জমিতে শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল কাদিরের নামে প্রতিষ্ঠিত এই স্মৃতিসৌধ গত ৮ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়।
শহীদের বড় ছেলে সাংবাদিক নাদিম কাদের নিজস্ব অর্থায়নে এটি নির্মাণ করেছেন।
বদরগঞ্জ উপজেলা থেকে পাগলা পীর যাওয়ার সড়কে মাঝামাঝি এলাকায় পড়ে মোস্তফাপুর। মূল রাস্তা থেকে আড়াইশ মিটারের মতো জায়গা হেঁটে এই স্মৃতিসৌধে যেতে হয়। কিন্তু রাস্তা না থাকায় আগত দর্শণার্থীদের ধানক্ষেত, মানুষের বাড়ি, নদীর তীর ধরে কাঁচা পথে সেখানে যেতে হয়। পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি।
নির্মাণকারী শহীদ পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি, এখানে যাওয়ার সড়কটি নির্মাণ এবং সম্মৃতিসৌধে বিদ্যুৎ সংযোগ।
শহীদ কাদিরের পরিবার জানায়, ১৯২৯ সালের ২ জানুয়ারিরংপুরেরমোস্তফাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আব্দুল কাদির। রংপুর জিলা স্কুল, কারমাইকেল কলেজে লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) করেন পদার্থ বিজ্ঞানে। এরপর যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
১৯৬২ সালে আর্মি স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং তিন বছর পরেযুক্তরাষ্ট্রেরভার্জিনিয়ারইঞ্জিনিয়ার অফিসারদের কেরিয়ার কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
১৯৭০ সালে তাকেপূর্ব পাকিস্তানের তেল ও গ্যাস উন্নয়ন কর্পোরেশনেরপ্রধান করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে অবদান রাখতে তিনি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে কর্পোরেশনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন।
স্বাধীনতাকামী বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কর্পোরেশনের স্টোর থেকে বিস্ফোরক ও দক্ষ জনবল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে শুরু করেন আব্দুল কাদির। অংশ নেন সম্মুখযুদ্ধেও।
বিষয়টি জানতে পেরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিলেন কর্নেল কাদির।
মুক্তিযুদ্ধের পর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নাটোরের বাগাতিপাড়ায় দয়ারামপুর সেনানিবাসের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘কাদিরাবাদ সেনানিবাস’।
৩৬ বছর পর ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে তার কবর খুঁজে পায় পরিবার। পরে ২০১১ সালে ২২ সেপ্টেম্বর তার মরদেহ কাদিরাবাদ সেনানিবাসে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনঃসমাহিত করা হয়। সেখানে ‘হোম অব স্যাপার্স’ নামে একটি স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়।
শহীদ কাদিরের নিজ গ্রামে নির্মিত স্মৃতিসৌধে যাওয়ার পথটি করার দাবি জানিয়েছেন তার ছেলে নাদিম কাদিরসহ এলাকার লোকজন।
নাদিম কাদির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছুটির দিনে বহু লোক আসে স্মৃতিসৌধ দেখতে। কিন্তু সবাই অভিযোগ করেন – রাস্তা হচ্ছে না কেন? এটার উত্তর আমার কাছে নাই।”
এদিকে, বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার জন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে [আরইবি] আবেদন করা হলেও তা পাওয়া যায়নি।
মোস্তফাপুরের স্থানীয় বাসিন্দা আকিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই আমাদের বলার মত কিছু নাই। যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তাদের জন্য সরকার অনেক কিছু করছে। কিন্তু একটা দুঃখের বিষয় পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেও দেশের জন্য যুদ্ধ করে যে লোকটা শহীদ হলেন সেই লোকটার গ্রামের বাড়িতে তার ছেলে নিজ উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করল, অথচ সেখানে যাওয়ার মত কোনো রাস্তা নেই। মানুষ দূর থেকে দেখে, এখানে আসার জন্য একটা রাস্তা দরকার।”
অনেক মানুষ ক্ষেত-বাড়ির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পন্থায় এলোমেলোভাবে স্মৃতিস্তম্ভে দেখার জন্য আসেন জানিয়ে স্থানীয় আমিন উদ্দিন বলেন, “এটে তো আস্তা নাই, একটা আস্তা দরকার হামার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের জন্য।”
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, “সামনে যে হ্যালোজেন লাইট ছিল তাও মানুষ নষ্ট করে দিয়েছে। এখানে ছয়টা ল্যাম্পপোস্ট ছিল; তার মধ্যে তিনটার মাথা খুলে নিয়ে গেছে। এখানে যদি বিদ্যুৎ থাকত তাহলে এসব জিনিস হারাইত না।”
স্থানীয় মেহেদী হাসান বলেন, “এটি একটি অনন্য স্থাপনা, অনেক ভালো কাজ করেছেন তার ছেলে নাদিম কাদির সাহেব। রাস্তাটি স্থানীয়ভাবে উপজেলা প্রশাসন করে দিতেই পারে। আর স্মৃতিসৌধের সুরক্ষায় চিকলী নদীর ১০০ মিটার তীর সংরক্ষণের কাজটি পানি উন্নয়ন বোর্ড করে দিতে পারে।”
তবে স্থানীয় প্রশাসন গুরুত্ব বিবেচনায় রাস্তা নির্মাণ ও বিদ্যুৎ সংযোগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এর মাধ্যমে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হবে এবং দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে। এখানে রাস্তার যে সমস্যা রয়েছে আমরা চেষ্টা করব তা দ্রুত সমাধানের।”