জেলা প্রশাসক জানান, জেলার ৯ উপজেলা নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে ৪৫৮টি পরিবার।
Published : 14 Jul 2024, 09:54 AM
ব্রহ্মপুত্র নদের কড়াল গ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব আমজাদ আলী (৬৫) এক দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। চোখ গড়িয়ে পড়ছে পানি, উদাস মন। ডাক দিতেই হকচকিয়ে উঠেন তিনি।
নদীর পানিতে কী খোঁজেন বলতেই, হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি। একটু শান্ত হয়ে বলেন, “মোর সব শ্যাষ বাবা, ভিটেমাটির কোনো চিহ্ন নাই। নিজের বলে আর কিছুই নাই। এ্যালা কোটে যামো, কোটে থাকমো। কাইল সারা রাইতে ঘুমাই নাই। একটার পর একটা বাড়ি খায়া নেইল রাক্ষুসী নদী। চোখের পলকে সব শ্যাষ।”
আমজাদ আলী কুড়িগ্রামে উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে সাহেবের আলগা ইউনিয়নের হকের চর গ্রামের বাসিন্দা। একই গল্প এখানকার শত পরিবারের।
তিনি বলেন, “ঘর সরে নেওয়ার সময় শিলছে না। মোর বাড়ি গেইল পইল সন্ধ্যাত। এরপর সারা রাইতে একের পর এক বাড়ি ভাঙ্গি গেইল শামসুল হক, মোখছেদ আলী, বেলাল, ফাতেমা, মানিক ও মঞ্জু মিয়ার বাড়িঘর সোগ। রাইতজাগি টানাটানি করি যতটুক বাঁচানো যায় কাপড়-চোপর জিনিসপত্র। ভিটেমাটি না থাকলে নিজের বলে আর কিছুই থাকে না। এ্যালা হামার কোনো ঠিকানা নাই।”
সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজ্জাফর হোসেন বলেন, চলতি বন্যায় তার ইউনিয়নে ১৯৭ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এর মধ্যে হকের চরে ৯০ পরিবার, দক্ষিণ নামাজের চরে ৪৭ পরিবার ও দৈ খাওয়ার চরে ৬০ পরিবার ভাঙনের শিকার হয়।
তিনি বলেন, এই ইউনিয়নে সাড়ে ছয় হাজার ৫০০ পরিবারের মধ্যে ৫০০ পরিবার স্বচ্ছল। বাকি সবাই কম-বেশি গরিব। প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ এখনও পানিবন্দি। এখন পর্যন্ত ত্রাণ হিসেবে ২ টন চাল আর ১০০ প্যাকেট শুকনা খাবার পেয়েছি।
চেয়ারম্যান মোজ্জাফর বলেন, এর মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার এসে বিতরণ করেছেন ২৯০ কেজি চাল আর উপজেলা পরিষদ থেকে ১৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার। ফলে অনেকের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।”
হকের চরের আমজাদ আলীর তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছেন।
আপাতত আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিবেন। এই হকের চরের মানুষ বন্যায় একদিন শুকনা খাবার ছাড়া আর কোনো ত্রাণ তাদের ভাগ্যে জোটেনি।
একই এলাকার হাজরা বেগম বলেন, “হকের চরের গুচ্ছগ্রামে সরকারি ঘরে আছলং। নদী ভাঙনে সে ঘর গেইল। তোমরা একনা নেকিদেন বাহে হামাক জানি সরকার ফির ঘর দেয়। নাইলে থাকমো কোনটে।”
ওই চরের কৃষিশ্রমিক শাহাবুল এবং তার স্ত্রী রোকেয়া দুজনে মিলে ভাঙা ঘরের জিনিসিপত্র নিয়ে নৌকায় উঠছেন।
রোকেয়া বলেন, গুজিমারীর চরে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন। ছেলে রুহুল আমিন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন উলিপুরে একটি ছাত্রাবাসে থেকে। আর মেয়ে শারমিন অষ্টম শ্রেনির ছাত্রী। তার পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম। কারণ স্কুল অনেক দূরে; যাতায়াতে সমস্যা।
ওই এলাকার শাহাবুদ্দিন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, “২০১০ সাল থেকে এই চরে থাকি। ২০১৯ সালে সরকার গুচ্ছগ্রামে ঘর দেয়। এই ঘর সব নদী খায়া নিলো। এলা মাথাগোজার ঠাঁই নাই। যাচ্ছি দক্ষিণে চিলমারী উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের এক চরে।”
তার দাবি, সরকার যেন দ্রুততম সময়ে নতুন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়।
হাতিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, “হকের চরটিকে ব্রহ্মপুত্র ভাঙছে ইউ আকারে। গোটা চরটি পর্যায়ক্রমে নদীর পেটে যাচ্ছে। এই চরের অবস্থান হাতিয়া ইউনিয়ন, নয়ারহাট, সাহেবের আলগা ও রাণীগঞ্জের সীমানা এলাকা।
“এই চরে চার ইউনিয়নের লোক বিভিন্ন সময় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে আশ্রয় নেয়। ফলে কোনো ইউনিয়ন পরিষদ এদের খুব একটা খোঁজখবর রাখে না। ফলে এরা বরাবরই অবহেলিত থাকছে।”
হাতিয়া ইউনিয়নের গুজিমারী আবাসনে গিয়ে দেখা যায়, ৯০টি পরিবারের চরম দুর্ভোগের চিত্র। প্রায় ২০ দিন ধরে এখানকার মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন। কাজ নেই, নেই হাতে টাকা। ফলে চলছে মানবেতর জীবনযাপন।
এর পরেও এই চরে এখন পর্যন্ত পৌঁছেনি সরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা। এমন অভিযোগ করেন ফুল মিয়া (৬৫), দুলু (৬০), মুকুল (৫৭), সাহেরবানু বেওয়া (৭০), রহিমা বেওয়াসহ (৬৫) অনেকের।
রহিমা বেওয়া অন্যের বাড়িতে কাজ করলে খাবার পান। বন্যার কারণে এখন তাকে কেউ কাজে নেয় না। ফলে তার দুর্ভোগ সীমাহীন। আর সাহের বানুর জীবন চলে ভিক্ষা করে। কিন্তু বানের পানি চারদিকে; তাই ভিক্ষেও বন্ধ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আফসান জানি বলেন, শনিবার কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া ধরল ও দুধকুমর নদের পানি কিছুটা হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, একই সঙ্গে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জেলা প্রশাসক বলেন, জেলার নয় উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ৬৬২ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বন্যা আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা ৩৭ হাজার ১০০টি।
“নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে ৪৫৮টি পরিবার। ফসলের ক্ষতি হয়েছে সাত হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির। বন্যার্তদের সেবায় ৮৩টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। জেলার নয় উপজেলায় এক হাজার ৩০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শুকনা খাবার।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৫৮৭ মেট্রিকটন চাল, ৩২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এবং ২৪ হাজার ৩৬০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় মানুষজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছে।”
জেলা প্রশাসক বলেন, এ ছাড়া বন্যার্তদের মাঝে পাঁচ লাখ ১১ হাজার ৬৫০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২০ হাজার ১২৬টি জেরিকেন সরবরাহ, নলকূপ মেরামত করা হয়েছে ৫৫টি, নতুন নলকূপ স্থাপন ছয়টি এবং ছয়টি শৌচাগার স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া হাইজিন কিটস বক্স ৬৫টি বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।