তিন শিশুর চুল কর্তনকে ‘শাসন’ বললেন সংসদ সদস্য নজরুল

তিন শিশুকে ‘চোর অপবাদ’ দিয়ে হাত বেঁধে গ্রামে ঘুরিয়েছেন মেয়র হালিম সিকদার; পরে তাদের চুলও কেটে দেন তিনি।

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2023, 06:38 PM
Updated : 8 Feb 2023, 06:38 PM

চুরির অপবাদে তিন শিশুকে নির্যাতন ও চুল কেটে দেওয়াকে ‘শাসন’ বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু।  

বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রসঙ্গক্রমে তিনি এ মন্তব্য করেন। 

গত সোমবার সকালে আড়াইহাজারের গোপালদী পৌর মেয়র হালিম সিকদারের বাড়ির পাশে পড়ে থাকা পাওয়ার লুম কারখানার মেশিনের একটি চেইন কুড়িয়ে হাতে নেয় এ শিশু। এ ঘটনায় পরে তিন শিশুকে ‘চোর অপবাদ’ দিয়ে হাত বেঁধে পুরো গ্রাম ঘুরিয়েছেন হালিম সিকদার। পরে তাদের চুলও কেটে দেন তিনি। 

এই কথা তিনি গণমাধ্যমে অকপটে স্বীকারও করেছেন। ‘চুরি’ করায় সামান্য শাস্তি দিয়েছেন বলে তিনি ওইদিন বলেছিলেন। 

এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে আলোড়ন তৈরি হয়। পরে মঙ্গলবার সকালে আড়াইহাজার থানায় একটি মামলা রেকর্ড হয়। ওই মামলার বাদী হন ভুক্তভোগী শিশুদের এক অভিভাবক। 

মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও পৌর মেয়র রয়েছেন অধরা। 

এদিকে মামলা করার একদিন পরই তা তুলে নেওয়ার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। বুধবার নিজ খরচে মাইক্রোবাসে করে ভুক্তভোগী শিশু ও তার পরিবারের সদস্যদের আদালতে নিয়ে আসেন মেয়র হালিম সিকদার ও তার লোকজন। 

নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুও এই মামলার বিষয়ে আদালত প্রাঙ্গণে তৎপর ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে নজরুল ইসলাম বাবু মামলার বিষয়ক কোনো কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না বলে দাবি করছেন।   

সকাল দশটার দিকে নজরুল ইসলাম বাবু নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত প্রাঙ্গণে আসেন। 

হালিম সিকদার আড়াইহাজার উপজেলার গোপালদী পৌরসভা মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। নজরুল ইসলাম বাবু ওই এলাকার সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। স্থানীয়ভাবে হালিম সিকদার সংসদ সদস্যের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। 

আদালত প্রাঙ্গণে নজরুল ইসলাম বাবু সাংবাদিকদের বলেন, “মেঘনা নদীতে ফেরিঘাটের একটি প্রকল্পের ব্যাপারে আমি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। আর নারী ও শিশু আদালতে গিয়েছিলাম পিপির সঙ্গে এমনিতে দেখা করতে। কোনো মামলা প্রসঙ্গে আসিনি।” 

পৌর মেয়রের ঘটনায় তদবিরের গুঞ্জন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পত্রিকা পড়ে জানছি যে একটি মামলা হয়েছে। এইটার জন্য সাংবাদিকরা দায়ী। আপনারা ওসিকে ধমক দিছেন। ভয়ের চোটে ওর (মেয়র) বিরুদ্ধে মামলা হইছে। 

তিনি বলেন, বাচ্চাদের সাথে এই আচরণ কেউ কখনও করে না; কিন্তু শাসন ও আদর না থাকলে কিন্তু সভ্যতা গড়ে ওঠে না। কিছু কিছু বিষয় আসে শাসনের আওতায় পড়ে, আবার কিছু বিষয় আছে শোষণ। 

“মেয়রের বাড়ির পাশেই ওই ছেলের বাড়ি। তার বাপ-মা মেয়রের বাড়িতে কাজ করে। তার পোলা যদি তার মাল চুরি করে তাহলে এইটা ওয়ান কাইন্ড অব শাসন করেছেন তিনি।” 

জানতে চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি রকিবউদ্দিন আহমেদ বলেন, “হঠাৎ সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু তার কক্ষে আসেন। এরপর সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। তার সাথে কয়েকজন আইনজীবীও দেখা করেন। এর আগে তিনি জজ সাহেবের সাথেও দেখা করেন। কিন্তু মামলার বিষয়ে তার সাথে আমার কোনো আলাপ হয়নি।” 

সংসদ সদস্যের সঙ্গে মামলার বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি বলে জানান জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজও। 

তিনি বলেন, “স্থানীয় একটি স্কুলের বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। মামলা নিয়ে তার সাথে আলোচনা হয়নি। তবে আমরা শিশুদের ওই ঘটনাটি খুব গুরুত্বের সাথে দেখছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে তদন্তও চলছে।” 

আদালত প্রাঙ্গণে দুজন আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিশু আইনের ৭০ ধারা জামিন অযোগ্য। মেয়রকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি রয়েছে পুলিশের হাতে। মামলার বাইরে জেলা প্রশাসন এটির তদন্ত করছে। আত্মসমর্পণ করে জামিন চাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে দাঁড়াতে হবে। মামলাটির বিচার হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালে এবং শিশুদের পক্ষে থাকবেন এই আদালতের পিপি। 

এদিকে মামলার মীমাংসা করার জন্য মেয়র নিজে ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজনকে নিয়ে আদালতে আসেন। 

তবে এই মামলার কোনো শুনানি বুধবার সারাদিনে হয়নি বলে জানান আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিশুর অভিভাবক বলেন, সকালে গ্রাম থেকে মেয়রের ভাড়া করা এক মাইক্রোবাসে (হাইয়েস) করে নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতে আনা হয় তিন শিশুসহ তাদের অভিভাবককে। তাদের সাথে পৌর মেয়র হালিম সিকদার ও তার সহযোগীরাও ছিলেন। সকাল সোয়া আটটায় রওয়ানা হন, দশটা নাগাদ আদালতে পৌঁছান। 

ওই অভিভাবক বলেন, “আমরা তো মামলাই করতে চাইনি। তারা প্রভাবশালী মেয়র-এমপি মানুষ তাদের বিরুদ্ধে তো আমরা কখনই যেতে পারমু না। তারপরও এখন মামলা হওয়াতে পড়ছি আরও ঝামেলায়। এখন মিমাংসার জন্য চাপ দিতেছে। আজকে আমাগো সবারে গাড়িতে কইরা মেয়র ও তার লোকজন আদালতে নিয়া গেছে। ওইখানে বিকাল চাইরটা পর্যন্ত থাকছি। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট নাকি আসে নাই। এই কারণে কাজ হয় নাই। 

“কালকে আবার যাইতে হইবো। মেয়র সাহেব যেন মামলা থেইকা বাইর হইতে পারেন সেই সাক্ষী আমাগো দিতে হইবো। আর যে দুইজন গ্রেপ্তার হইছে তাগোও ছাড়ানোর লাগবো। আমরা কোনো ঝামেলা চাই না। বাড়ির পাশের মানুষ। তারা বারবার বললে তো তাগো কথা ফালাইয়া দেওয়ার সাহস পাই না। গ্রামের মানুষ আমরা, তারা তো ক্ষমতাধর। ঘরবাড়িতে থাকতে হইলে মীমাংসাই একমাত্র পথ।” 

মামলার বাদী ও অপর শিশুর বাবা বলেন, “এইটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। আমি লেখাপড়া জানি না। না বুইঝা মামলা করছি। আপনেরা সাংবাদিক আপনেরা সবই জানেন আর বোঝেন। আমাগো কোনো কথা নাই। আমরা মামলা তুইলা নিমু, মেয়র সাহেব যাতে ঝামেলায় না পড়েন সেই কাজই আমরা করমু। এর বাইরে কোনো কথা নাই।” 

গত মঙ্গলবার সকালে তিন শিশুর মধ্যে এক শিশুর বাবা বাদী হয়ে শিশু আইন-২০১৩ সালের ৭০ ধারায় একটি মামলা করেন। মামলা দায়েরের দুইদিন পেরিয়ে গেলেও ২২ ধারায় ভুক্তভোগী শিশুদের জবানবন্দি নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। 

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, শিশু আইনে মামলা করলে প্রথম কাজ হচ্ছে ভুক্তভোগীর শারীরির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। কোথাও কোনো আঘাত আছে কিনা তা জানতে হবে। তারপর দ্রুত ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এরপর অভিভাবক চাইলে তাদের জিম্মায় অথবা সেফ হোমে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এই কাজগুলো সম্পাদন করবে পুলিশ প্রসিকিউশন। 

এই আড়াইহাজার থানার ওসি আজিজুল হক বলেন, “আমরা তিন শিশুকে একদিনে ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের ব্যবস্থা করব। আজ তাদের পাইনি বলে বিষয়টি করা যায়নি। আর শিশুদের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না থাকায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন পড়েনি।”

Also Read: ৩ শিশুর চুল কেটে নির্যাতন: গোপালদী মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা

Also Read: ‘চুরির অপবাদে’ ৩ শিশুর চুল কেটে নির্যাতন