খাগড়াছড়ির ভোটারদের দাবি, দুর্গম এলাকার তুলনায় ভোটকেন্দ্র এখনও অপ্রতুল।
Published : 23 Dec 2023, 04:42 PM
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার একটি গ্রাম কাবতলা। গ্রামটির ভোটারদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হবে পাহাড়, হাঁটতে হবে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা।
কাবতলা গ্রামের প্রায় ২০০ ভোটারের জন্য নির্ধারিত ভোটকেন্দ্র উত্তর রেকার্য্য উচ্চ বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। একে দুর্গম এলাকা, তার ওপর নির্বাচনের সময়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় এই গ্রামের বাসিন্দাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে এমন দুর্ভোগই পোহাতে হয়।
দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের এই উত্তর রেকার্য্য উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসা সাতটি গ্রামের ভোটারদেরই পাড়ি দিতে হবে পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার।
এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনমিত্র চাকমা বলেন, “এটা পিছিয়ে পড়া দুর্গম এলাকা। এখানকার অধিকাংশ লোক জুমচাষি পাহাড়ি। দুর্গম গ্রাম পাহাড়, ঝিরি-ঝরনা পেরিয়ে ভোট দিতে আসা বেশ কষ্টকর। সংসদ নির্বাচনে আমাদের এলাকার অনেকগুলো গ্রামের জন্য একটি মাত্র ভোটকেন্দ্র। এখানে দুইটা ভোটকেন্দ্র হলে ভোট দিতে সুবিধা হতো।”
মেরুং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য নতুন চন্দ্র চাকমা বলেন, “ভোটকেন্দ্র থেকে পাগলা মহাজন পাড়া, কলক পাড়া, আইজ্জামাছগা, কাবতলা, বদা পাড়া, কমলছড়ি, বিচিত্র কার্বারিপাড়া, সুরেন্দ্র কার্বারি পাড়ার অনেক দূরত্ব। এসব গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে ছয় ঘণ্টা।
সাবেক এই জনপ্রতিনিধির দাবি, “দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ভোটারদের অনেক অসুবিধা হয়ে যায়। তাই আগ্রহ থাকার পরও অনেকে দূরত্বের কারণে ভোট দিতে আসতে পারেন না। বিশেষ করে নারী ও প্রবীণ ভোটারদের পক্ষে ভোট দেওয়া সম্ভব হয় না।”
একাদশ সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়িতে ভোটকেন্দ্র ছিল ১৮৭টি। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পাঁচ লাখ ১৫ হাজার ৪১৯ ভোটারের জন্য ভোটকেন্দ্র সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৬টি করা হয়। তবে ভোটারদের দাবি, দুর্গম এলাকার তুলনায় তা এখনও অপ্রতুল।
খাগড়াছড়ির মহালছড়ির উপজেলার তেমনি এক দুর্গম গ্রাম মধ্য আদম। সেখানকার এক কারবারি সুনীতি চাকমা বলেন, “অনেক কষ্টে ভোট দিতে যেতে হয়। অন্তত চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটতে হয়। এখানে শিলবান, দেবাছড়া, ত্রিবেছড়ি আরও অনেক গ্রাম আছে যাদের কষ্ট করে ভোট দিতে হয়।
“ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হলে ভোটকেন্দ্র বেশি থাকে কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র কম থাকায় কষ্ট বেশি হয়।”
মধ্য আদমের অবস্থান মহালছড়ির মুবাছড়ি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে।
সেখানকার পল্লী চিকিৎসক সমরজিৎ চাকমা বলেন, “এখানে অনেক গ্রামের ভোটাররা চাইলেও ভোট দিতে পারেন না। অনেকের টাকা-পয়সা নেই। মোটরসাইকেলে ভোট দিতে গেলে দরিদ্র মানুষদের ২০০ টাকা ভাড়া গুণতে হয় আর হেঁটে গেলে তো পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। এ কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেন না।”
দুর্গম এসব এলাকার ভোটারদের দুর্ভোগ লাঘবে তাই ভোটকেন্দ্র বাড়ানোর দাবি জনপ্রতিনিধি ও সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের।
দীঘিনালার ১ নম্বর মেরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম লাকি বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের খুবই সংকট। আমার ইউনিয়নের আয়তন ২২৭ বর্গকিলোমিটার। ভোটার প্রায় ৩২ হাজার। অথচ ভোটকেন্দ্র মাত্র ১১টি। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ভোটারদের ৪ থেকে ৫ মাইল দূর থেকে হেঁটে এসে ভোট দেওয়ায় খুবই কষ্টকর।
ভোটকেন্দ্র বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “জনগণের ভোগান্তি কমাতে হলে ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে। দুর্গম এলাকার কারণে অনেক ভোটার কেন্দ্রে আসতে চায় না। কেন্দ্র বাড়ালে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।”
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী ও একমাত্র নারী প্রার্থী মিথিলা রোজায়া বলেন, “খাগড়াছড়ির যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্গম। তার ওপর এখানে ভোটকেন্দ্র কম। যে কারণে দুর্গম এলাকার ভোটারদের উপস্থিতি কম। আমার দাবি, ভোটারদের সুবিধার্থে কেন্দ্র সংখ্যা আরও বাড়ানো হোক।”
খাগড়াছড়ির জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল আলম বলেন, “দুর্গম পথ পেরোতে ভোটারদের যে দুর্ভোগ হয় সেটা আমিও স্বীকার করি। গত সংসদ নির্বাচন থেকে এবার নয়টি ভোটকেন্দ্র বেশি করা হয়েছে।”
স্থানীয় ভোটাররা এবার চারটি ভোটকেন্দ্র বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে লক্ষ্মীছড়িতে দুটো, দীঘিনালায় একটা এবং জেলা সদরের গোলাবাড়ি ইউনিয়নে একটি।
“এর মধ্যে লক্ষ্মীছড়ির একটা তারা নিজেরাই প্রত্যাহার করে নিয়েছে অন্য একটিতে সড়ক পথে যাতায়াতের সুযোগ না থাকায়। ফলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন কমিটি সেটার অনুমোদন দেয়নি। তবে দীঘিনালার মায়াফাপাড়া ও গোলাবাড়িতে নতুন ভোটকেন্দ্র অনুমোদন দিয়েছে।”
এই কর্মকর্তা আরও জানান, “নির্বাচনি নীতিমালায় একটি কেন্দ্রে তিন হাজার ভোটার থাকতে হয়। পাহাড়ি এলাকায় গ্রামগুলোর ভৌগোলিক দূরত্ব রয়েছে। অনেক গ্রাম থাকলে ভোটার কম হওয়া এবং ভোটকেন্দ্র স্থাপনের মতো অবকাঠামো না থাকার কারণে ভোটকেন্দ্র বাড়ানো যায় না।”