নুসরাত হত্যার রায় ঘিরে আদালতে নিরাপত্তা জোরদার

অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি, যে কারণে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাকে। আলোচিত সেই ঘটনার মামলার রায় হতে যাচ্ছে বৃহস্পতিবার।

নাজমুল হক শামীম ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2019, 04:24 AM
Updated : 24 Oct 2019, 04:43 AM

মামলার সাত মাসের মধ্যে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ এ রায় দিতে যাচ্ছেন।

ফেনীর পুলিশ সুপার খন্দকার নুরুন্নবী জানান, এ রায় ঘিরে সকাল থেকেই আদালত এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। সবাইকে তল্লাশি করে তারপর আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহনকে আদালত এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।  

বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মী সকাল থেকেই আদালত চত্বরে ভিড় করে আছেন। এসেছেন নুসরাতের সহপাঠী, বন্ধু, স্বজনরাও।   

মামলার ১৬ আসামিকে রায়ের আগে ফেনী জেলা কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হবে। এ আদালতের বিচারক সাধারণত বেলা ১১টার দিকে আদালতে বসেন। তার পরই কোনো এক সময় রায় ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাদীপক্ষের কৌঁসুলি এম শাহজাহান সাজু।

তিনি বলেন, ৬২ কার্যদিবস শুনানির পর এই রায় দেওয়া হচ্ছে, এটা বাংলাদেশে ‘নজিরবিহীন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো হত্যা মামলার আলামত হিসেবে প্রজেক্টরের মাধ্যমে আদালতে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

এ মামলার মূল দলিল হিসেবে নথিতে থাকা আদালতে প্রদর্শিত অডিও-ভিডিওর মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে আসামিদের সম্পৃক্ততা উন্মোচিত হয়।

নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে সারা দেশে

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হাফেজ আহমেদ আশা করছেন রায়ে ১৬ আসামির সবারই সর্বোচ্চ সাজা হবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)- এর ৪ (১) ও ৩০ ধারায় রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করেছে। রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, রায়ে সব আসামি সর্বোচ্চ সাজা পাবে।”

কারও গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে হত্যার অপরাধে এই আইনের ৪ (১) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। আর ৩০ ধারায় এই ধরনের হত্যায় প্ররোচনাও দণ্ডনীয়।

মামলার আসামিদের সবাই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। রায়ের সময় তাদের সবাইকে আদালতে উপস্থিত করা হবে বলে জানিয়েছেন পিপি হাফেজ আহমেদ।

এদিকে আসামি পক্ষ থেকে নানা ধরনের হুমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে নুসরাতের পরিবার। তার মধ্যেই তারা আদালতের কাছে সন্তান হত্যার সুবিচারের আশায় রয়েছেন।

নুসরাতের পরিবারের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে ফেনী পুলিশ; রায় ঘিরেও সতর্ক রয়েছে তারা।

সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা থেকে এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নুসরাত। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা মামলা করার পর গত ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে অধ্যক্ষ সিরাজকে।

সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পক্ষে নামে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তি দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী। মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ।

শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় দগ্ধ ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীকে শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে আনা হয়। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা না তোলায় তিনি আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ উঠেছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এর মধ্যেই ৬ এপ্রিল পরীক্ষা শুরুর আগে পরীক্ষা কেন্দ্র সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নুসরাতকে কৌশলে ডেকে নিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে ঢাকায় এনে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল; টানা পাঁচ দিন যন্ত্রণা সহ্য করে ১০ এপ্রিল মারা যান তিনি।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার দুদিন পর তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত নেয়।

নুসরাতকে যখন ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছিল, তখনও তিনি বলছিলেন, তিনি প্রতিবাদ করে যাবেন। প্রতিবাদী এই তরুণীর জন্য প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয় গোটা দেশজুড়ে।

৭ এপ্রিল নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন, যাতে তিনি অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যান।

নুসরাত হত্যার মামলটি তদন্ত প্রথমে করছিলেন সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন; কিন্তু ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তদন্তভার আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপর।

পিবিআইর পরিদর্শক শাহ আলম এজহারভুক্ত আট আসামির সঙ্গে আরও আটজনকে যুক্ত করে ১৬ জনকে আসামি করে গত ৫ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

তার পরের মাসে ২০ জুন ১৬ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬ আসামির বিচার। ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে আদালত।

অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে আলাদা মামলা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে ঘটনার বর্ণনা

৮০৮ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্রে ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে এক নম্বর আসামি করা হয়। অভিযুক্ত ১৬ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আসামি আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, শ্লীলতাহানির মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার হলে তার অনুগতরা ক্ষিপ্ত হন।

১ এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীম, নূরু উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের ও রানা জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। তখনই অধ্যক্ষ সিরাজ তার মুক্তির চেষ্টা চালাতে এবং মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে বলেন।

হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর পরও মামলা না তোলায় আসামিরা আলোচনা করে ‘প্রয়োজনে যে কোনো কিছু’ করার পরিকল্পনা করে।

সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম এ কাজে শাহাদাত হোসেনকে ১০ হাজার টাকা দেন। এর মধ্যে দুই হাজার টাকা দিয়ে কামরুন নাহার মনি দুটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনেন।

৩ এপ্রিল শামীম, নূর উদ্দিন, আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজন কারাগারে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। সিরাজ তখন নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানোর এবং প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন এবং ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর নির্দেশ দেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন বিকালে মাদ্রাসার পাশে টিনশেড কক্ষে শাহাদাত হোসেন শামীম, নূর উদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও মনিসহ কয়েকজন বৈঠক করেন। সেখানে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শুক্রবার যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রায় বিভিন্ন স্লোগান-সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে শিক্ষার্থীরা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

৪ এপ্রিল রাতে মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে বসে আবারও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন আসামিরা। পরদিন ভূইয়া বাজার থেকে এক লিটার কেরোসিন কিনে নিজের কাছে রেখে দেন শাহাদাত হোসেন শামীম।

৬ এপ্রিল সকাল ৭টার পর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে চলে যান শাহাদাত হোসেন শামীম, নূর উদ্দিন ও হাফেজ আব্দুল কাদের। সকাল সোয়া ৯টার মধ্যে আসামিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যার অবস্থানে চলে যান।

শাহাদাত হোসেন শামীম পলিথিনে করে আনা কেরোসিন অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেন।

মনির কেনা দুটি এবং বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটি বোরখা এবং চার জোড়া হাতমোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখা হয়।

শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরখা ও হাতমোজা পরে তৃতীয় তলায় অবস্থান নেন।

নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপি তাকে মিথ্যা কথা বলে ছাদে নিয়ে আসেন। নুসরাত ছাদে যাওয়ার সময় পপি তাকে ‘হুজুরের’ বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। নুসরাত তাতে রাজি না হয়ে ছাদে উঠে যান। মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদও সে সময় নুসরাতের পিছু পিছু ছাদে যান।

ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেন এবং কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন। নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে শামীম বাঁ হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরেন এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছনে নিয়ে আসেন।

যেভাবে আগুন দেওয়া হয়েছিল নুসরাতের দেহে; পিবিআইর চিত্রে ঘটনা

উম্মে সুলতানা পপি তখন নুসরাতের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দেন। জোবায়ের ওড়না দুই ভাগ করে ফেলেন। পপি ও মনি ওড়নার একাংশ দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে বেঁধে ফেলেন। অন্য অংশ দিয়ে নুসরাতের পা বেঁধে ফেলেন জোবায়ের। জাবেদ পায়ে গিট দেন।

সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ওপর শুইয়ে ফেলেন তারা। শাহাদাত তখন নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখেন। নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরেন মনি। পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে।

জাবেদ বাথরুমে লুকানো গ্লাস নিয়ে এসে কেরোসিন ঢেলে দেন নুসরাতের গায়ে। শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ জ্বেলে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

আগুন ধরানোর পর প্রথমে ছাদ থেকে নামেন জোবায়ের। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী মনি ‘ওরফে চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে পপিকে নিচে নিয়ে যান। তারা নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান।

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় আগুনে পুড়িয়ে মারা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির বাবা, মা ও দুই ভাই সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করেন। ছবি: ইয়াসিন কবির জয়

জাবেদ ও শাহাদাত হোসেন শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরখা খুলে ফেলেন। তারপর জাবেদও পরীক্ষার হলে ঢুকে যান।

শাহাদাত হোসেন শামীম তার বোরখা ফেলে দেন মাদ্রাসার পুকুরে। জোবায়ের মাদ্রাসার মূল গেইট দিয়ে বের হয়ে যান এবং বোরখা ও হাত মোজা ফেলে দেন সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে।

হত্যাকাণ্ড শেষ করে আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন।

এদিকে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত নিচে নেমে এলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড তার গায়ের আগুন নেভায়। নূর উদ্দিনও ওই সময় নুসরাতের গায়ে পানি দেন। আর হাফেজ আব্দুল কাদের ফোন করে নুসরাতের ভাই নোমানকে জানান, তার বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

দেহের ৮০ শতাংশজুড়ে আগুনের ক্ষত নিয়ে নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে ঘটনা একইভাবে বর্ণনা করেন বলে অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে।

ঘটনাক্রম

২৭ মার্চ: নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধ, অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার।

৬ এপ্রিল: পরীক্ষার হল থেকে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন

৮ এপ্রিল: ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে নুসরাত, মামলা দায়ের।

১০ এপ্রিল:  নুসরাতের মৃত্যু, মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর।

২৯ মে: ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল।

৩০ মে: হাকিম আদালত থেকে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর।

১০ জুন: অভিযোগপত্র আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল, গ্রেপ্তার পাঁচজনকে অব্যাহতি।  

২০ জুন: ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন।

২৭ জুন: বাদীর সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্যে দিয়ে শুনানি শুরু।

৯ সেপ্টেম্বর: সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ।

৩০ সেপ্টেম্বর: রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ।

কোন আসামির বিরুদ্ধে কী অভিযোগ

এই মামলার ১৬ জন আসামির মধ্যে নুসরাতের তিন সহপাঠী কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন ছাড়াও শাহাদাত হোসেন ও জোবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন বলে আসামিদের জবানবন্দি ও পিবিআইর তদন্তে উঠে আসে। হত্যার পর তার তিন সহপাঠী পরীক্ষার হলে ঢুকে আলিম পরীক্ষাও দিয়েছেন।

ঘটনার পর সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশ এবং দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআই বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মামলায় এজহার নামীয় আটজনসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে ৫ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

ঘড়ির কাঁটার দিকে: অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, নূর উদ্দিন, জোবায়ের, সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, আবছার উদ্দিন, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, রুহুল আমীন, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, কামরুন নাহার মনি, মাকসুদ আলম, হাফেজ আব্দুল কাদের, . ইমরান হোসেন, মহিউদ্দিন শাকিল, মোহাম্মদ শামীম ও শাহাদাত হোসেন শামীম

১. অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা: তিনি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও নির্দেশ দিয়েছেন বলে অভিযোগ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ, তাতে কাজ না হওয়ায় ভয়-ভীতি দেখানো এবং পরে নুসরাতকে হত্যার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন তিনি।

২. নূর উদ্দিন: নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নূর উদ্দিনের। অভিযোগপত্রে বলা হয়, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার আগে রেকি করা ছিল তার দায়িত্ব। আর ভবনের ছাদে আগুন দেওয়ার সময় নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকি করা ছিল তার দায়িত্ব।

৩. শাহাদাত হোসেন শামীম: নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন শামীম। সেজন্য ছিল তার ক্ষোভ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে কার কী ভূমিকা হবে সেই পরিকল্পনা সাজান শামীম। কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তিনি তার বোরখা ও কেরোসিন কেনার ব্যবস্থা করেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় তিনি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেন। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাসটি উদ্ধার করে পিবিআই।

৪. কাউন্সিলর মাকসুদ আলম: অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা গ্রেপ্তার হলে ২৮ মার্চ তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, বোরখা ও কেরোসিন কেনার জন্য তিনিই ১০ হাজার টাকা দেন। পিবিআই বলছে, পুরো ঘটনার আগাগোড়াই তিনি জানতেন।

আদালতে ফেনীর সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, ফাইল ছবি

৫. সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের: 
বোরখা ও হাতমোজা পরে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগ জোবায়েরের বিরুদ্ধে। নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে দুই ভাগ করে পা বাঁধা এবং কেরোসিন ঢালার পর ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানোর কাজটি তিনিই করেন বলে তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য।

৬. জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ: বোরখা পরে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ার অভিযোগ জাবেদের বিরুদ্ধে। পা বাঁধা হলে পলিথিন থেকে কেরোসিন গ্লাসে ঢেলে তিনি নুসরাতের গায়ে ছিটিয়ে দেন এবং সব কাজ শেষে বোরখা খুলে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।

৭. হাফেজ আব্দুল কাদের: নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু কাদের সেদিন মাদ্রাসার মূল ফটকে পাহারায় ছিলেন বলে অভিযোগ। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হলে দুই মিনিট পরে তিনিই ফোন করে নোমানকে বলেছিলেন, তার বোন গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

৮. আবছার উদ্দিন: ঘটনার সময় তিনি গেইটে ছিলেন পাহারায়। মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়াও তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ।

৯. কামরুন নাহার মনি: আসামি শামীমের দূর সম্পর্কে ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনি ২ হাজার টাকা নিয়ে দুটি বোরখা ও হাতমোজা কেনেন। হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি অংশ নেন বলে অভিযোগ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ছাদের ওপর নুসরাতের হাত বাঁধা হলে তাকে শুইয়ে ফেলে বুকের ওপর চেপে ধরেন মনি। আগুন দেওয়া হলে নিচে নেমে এসে আলিম পরীক্ষায় বসেন।

১০. উম্মে সুলতানা ওরফে পপি: অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি সেদিন নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যান। পরে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। তাতে রাজি না হওয়ার নুসরাতের ওড়না দিয়ে তার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে পা চেপে ধরেন বলে অভিযোগ।

১১. আব্দুর রহিম শরীফ: 
ঘটনার সময় তিনি মাদ্রাসার ফটকে পাহারায় ছিলেন। পরে তিনি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালান।

১২. ইফতেখার উদ্দিন রানা: মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।

১৩. ইমরান হোসেন ওরফে মামুন: মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।

১৪. মোহাম্মদ শামীম: সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন। কেউ যেন ওই সময় ছাদে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ। 

১৫. রুহুল আমীন: মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন শুরু থেকেই এ হত্যা পরিকল্পনায় ছিলেন বলে অভিযোগ। ঘটনার পর পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাতেও তার ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।

১৬. মহিউদ্দিন শাকিল: ঘটনার সময় সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন।

আরও খবর