‘ঝড়ে এত বড় শিলা আগে দেখি নাই’

মধ্য চৈত্রে হঠাৎ ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে দেশের উত্তর ও দক্ষিণের কয়েকটি জেলায় তাণ্ডব নেমে এসেছে। চারজনের মৃত্যু ও শতাধিক আহত হওয়া ছাড়াও কোনো কোনো এলাকায় ঘরের টিনের চালা ফুটো হয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে ফসলের ক্ষেত, ঝড়ে ভেঙে গেছে ঘরবাড়ি-গাছপালা।

জেলা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2018, 03:38 PM
Updated : 30 March 2018, 05:30 PM

কেউ কেউ বলছেন, ঝড়ে এত বড় শিলা এর আগে দেখেননি তারা।

শুক্রবার সকালে লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী; দুপুরে দিনাজপুর, বিকালে ঢাকা, পাবনা, গাইবান্ধা, সিলেট এবং সন্ধ্যায় মাগুরায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়।

নিহতরা হলেন- মাগুরা সদরের ডহরসিংড়া গ্রামের আকরাম হোসেন (৩৫), দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার চণ্ডিপুর ইউনিয়নের চৈতাপাড়া গ্রামের মৃত লাল মোহাম্মদের ছেলে সৈয়দ আলী (৫৫), সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার দশহাল গ্রামের সাবিয়া বেগম ও উমরপুর গ্রামের শিশু হাসান আহমদ।

মাগুরা

সন্ধ্যা ৬টার দিকে সদর উপজেলায় ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি হয়। এতে একজন নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া ঝড়ো হাওয়ায় বহু গাছপালাসহ অন্তত ৩০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে।

সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এনামুল কবীর রেজা বলেন, ডহরসিংড়া গ্রামের আকরাম হোসেন মাঠে আবাদ করা ক্ষেতে কাজ করছিলেন। ওই সময় বড় বড় শিলার আঘাতে আহত হন। এলাকাবাসী উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

মাগুরার জেলা প্রশাসক আতিকুর রহমান বলেন, শিলাবৃষ্টিতে নিহত কৃষক আকরাম হোসেনকে দেখতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সুফিয়ানকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নিরূপণে কাজ শুরু হয়েছে।

জেলা সদর হাসপাতালের ব্রাদার হারুনর রশীদ বলেন, সদর উপজেলার মঘি ইউনিয়নের মঘি, কালুপাড়া, লস্কারপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের ১০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে সদরের জগদল ইউনিয়নের রুপাটি, জগদলসহ অন্তত সাতটি গ্রামের ফসলি ক্ষেতের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রুপাটি গ্রামের ময়েন উদ্দিন, মহরার, সাহেব, হাসেম, ওলিয়ার, মোসলেম উদ্দিনসহ অন্তত ৩০ জনের ঘরের টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে।

মাগুরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে সদর উপজেলায় বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। তবে সঠিক তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

দিনাজপুর

পার্বতীপুর উপজেলায় শিলাবৃষ্টিতে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে; শিলার আঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন।

এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ফসল ও ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

জেলা প্রশাসন জানায়, শুক্রবার দুপুরের এ ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে জেলার ১৩টি উপজেলার কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

নিহত সৈয়দ আলী (৫৫) পার্বতীপুরের চণ্ডিপুর ইউনিয়নের চৈতাপাড়া গ্রামের মৃত লাল মোহাম্মদের ছেলে।

চণ্ডিপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, “ঝড়ের সময় নিজ ঘরের টিনের চালা সংস্কার কাজস করছিলেন সৈয়দ আলী। এ সময় মাথায় শিলার আঘাতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়।”

দিনাজপুর জেলা প্রশাসক আবু নঈম মো. আবদুছ ছবুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুপুরের হঠাৎ শুরু হওয়া ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে জেলার ১৩টি উপজেলার প্রায় সবকটি কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে নবাবগঞ্জ উপজেলায়।

এর আগে শুক্রবার সকালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায় শিলাবৃষ্টি হয়।

লালমনিরহাট সদর উপজেলা, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলা ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

পাবনা

বিকালে পাবনার চার উপজেলায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। ঘরবাড়ি, আম, লিচু, ভুট্টা, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়। আহতদের কয়েকজনকে চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য-কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন স্থানে ভর্তি করা হয়েছে।

চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সের চিকিৎসক খোরশেদ আলম বলেন, “শিলাবৃষ্টি থামার পরপরই একের পর এক আহত রোগী হাসপাতালে আসতে থাকে। আমরা তাদের চিকিৎসা দিতেই হিমসিম খেতে হয়েছে। এখানে অন্তত অর্ধশত জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি।”

চাটমোহর উপজেলা চেয়ারম্যান হাসাদুল ইসলাম হীরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার জীবনে এ ধরনের শিলাবৃষ্টি দেখি নাই। আমার এলাকার উঠতি ফসলের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। লিচু ও আমের কুঁড়ি ঝরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।”

ভাঙ্গুড়া উপজেলা সদরের পাটুলীপাড়া মহল্লার বাসিন্দা ব্যবসায়ী রানা হামিদ বলেন, “বিকালে প্রথমে বাতাস শুরু হয়। পরে তা তীব্র হয়। এরপরই শুরু হয় ভারি শিলাবৃষ্টি। এতে করে আমাদের এলাকাসহ উপজেলার অসংখ্য ঘরবাড়ির টিনের চালা ফুটো হয়ে গেছে।”

চাটমোহর পৌর এলাকার ব্যবসায়ী রনি রায় বলেন, “আমার জীবনের দেখা প্রথম এমন শিলাবৃষ্টি। এত বড় শিলার বৃষ্টি আমি দেখি নাই।”

সাঁথিয়ার নাগডেমরা গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর সোলায়মান মিয়া (৫৫) বলেন, “আমার তিনটি টিনের ঘরের চালা ফুটো হয়ে গেছে।”

ফরিদপুর উপজেলা আওয়অমী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী আশরাফুল কবির বলেন, এই উপজেলাও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক বিভূতিভূষণ বলেন, “শিলাবৃষ্টির পরপরই আমাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপনরে জন্যে। এখনও সেটা আমাদের হাতে এসে পৌঁছে নাই।”

পাবনা জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, জেলার পাঁচটি উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সুজানগর ও চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে মাঠে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন।

“সুজানগরে ৯৮টি ঘর ভেঙে গেছে। সেখানে আমরা শুকনা খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিসা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। দ্রুত ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করার চেষ্টা করছি।”

গাইবান্ধা

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, সাঘাটা ও সদর উপজেলায় শিলাবৃষ্টিতে উঠতি বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল ও আমের ক্ষতি হয়েছে। শিলাবৃষ্টির আঘাতে গোবিন্দগঞ্জে অন্তত তিনজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

আহত একজনকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, তালুককানুপুর, নাকাই, হরিরামপুর ও দরবস্ত ইউনিয়ন, পলাশবাড়ীর হোসেনপুর, কিশোরগাড়ী, বরিশাল, বেতকাঁপা ও হরিনাথপুর, সাঘাটার পদুমশহর এবং সদর উপজেলার সাহাপাড়া, বাদিয়াখালী, রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় শিলাবৃষ্টি হয়েছে।

সিলেট

ওসমানী নগর থানার ওসি শহিদ উল্লাহ জানান, বিকালে ঝড়ের সময় উপজেলার দশহাল গ্রামে টিনের চাল পড়ে নিহত হন সাবিয়া বেগম। উমরপুর গ্রামে পানিতে ডুবে মারা যায় শিশু হাসান আহমদ।

এছাড়া ঝড়ে গাছপালা উপড়ে পড়েছে, টিনের চাল উড়ে গেছে অন্তত ৩০টি ঘরের। 

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেট-১ এর জোনাল অফিসের ডিজিএম জহিরুল ইসলাম জানান, বিদুৎতের খুঁটি উপড়ে পড়ে উপজেলায় বিদুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে হিসাব এখনও নির্ধারণ করা যায়নি।