‘মসজিদের মাইকে লোক ডেকে’ চারজনকে পিটিয়ে হত্যা

“গ্রামবাসী যে যা পাইছে, তাই হাতে নিয়া বিলে নামছে। তারা খালি গায়ে ছিল, পরনে শুধু হাফপ্যান্ট ছিল। তাগো হাতে কোনো অস্ত্র দেখি নাই।”

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2024, 03:58 PM
Updated : 18 March 2024, 03:58 PM

মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণার পর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গ্রামবাসীর পিটুনিতে চারজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।

রোববার রাত ১২টার দিকে উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের বাঘরী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু হয়।

নিহতরা হলেন-সোনারগাঁ উপজেলার রাজাপুর শেখেরহাট গ্রামের আমান উল্লাহর ছেলে জাকির হোসেন (৩৬), আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের শামসুল হকের ছেলে আব্দুর রহিম (৪৮) ও একই উপজেলার জালাকান্দী গ্রামের মজিদ হোসেনের ছেলে নবী হোসেন (৩৫)। বাকি একজনের পরিচয় পাওয়া যায় নাই।

এ ঘটনায় আহত মোহাম্মদ আলীকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ সার্কেল) শেখ বিল্লাল হোসেনের ভাষ্য, নিহতদের মধ্যে জাকির সোনারগাঁয়ের ডাকাতদলের সর্দার। তার এক মামাও পুলিশের তালিকাভুক্ত ডাকাতদলের সদস্য। আর আব্দুর রহিম গত বছরের মার্চে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ নবী হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছে ডাকাতির মামলা।

বাঘরী গ্রামের লেবুরটেক জামে মসজিদের ইমাম জহিরুল ইসলাম বলেন, “তারাবির নামাজ শেষ হওয়ার পর আমি মসজিদেই ছিলাম। গ্রামবাসী মসজিদের ভেতর ঢুকে মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে অ্যানাউন্স করে। এর আগে আরো দুই-তিনটা মসজিদ থেকেও ডাকাতের বিষয়ে মাইকে জানানো হয়। লোকজন তখন বিলে নামে ডাকাত খুঁজতে।”

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একটি স্টিলমিলের এক শ্রমিক বলেন, রাত সোয়া দশটার দিকে মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা শুনে তিনি বিলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন ‘কয়েকশ’ গ্রামবাসী বিলের মধ্যে ‘ডাকাতদলের’ সদস্যদের খুঁজছে।

“পরে একজনকে খুঁজে পেয়ে তাকে লোকজন মারধর করে। বিলের অন্যপাশেও আরও কয়েকজনকে পেয়ে মারধর করেন গ্রামবাসী।”

তিনি বলেন “গ্রামবাসী যে যা পাইছে, তাই হাতে নিয়া বিলে নামছে। ওইগুলা দিয়াই মারছে। মারধরের শিকার ব্যক্তিরা খালি গায়ে ছিল, পরনে শুধু হাফপ্যান্ট ছিল। তাগো হাতে কোনো অস্ত্র দেখি নাই।”

মনির হোসেন নামে স্থানীয় এক কৃষক বলেন, “গত সপ্তাহে একটা ডাকাতি হইছে কাজরদীতে।একজনরে কোপাইছে। এইটা নিয়া লোকজন ক্ষ্যাপা ছিল। সবতে মিল্লা তখন পিটাইছে।”

রাতে লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, “আহত অবস্থায় ডাকাতদলের এক সদস্য পুলিশের কাছে ভিডিওতে জবানবন্দি দিয়েছিল। ওই সময় সে জানায়, মদনপুরের নাজিম উদ্দীন ভূঁইয়া কলেজের সামনে দিয়ে বিলে যান। বানিয়াবাড়ি গ্রামের একটি বাড়ি তাদের টার্গেট ছিল।

“এইজন্য বিলের উঁচু এক ভিটিতে তারা প্রায় সাতজন জড়ো হয়েছিল, আরও কয়েকজনের আসার কথা ছিল। এর মধ্যেই মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা শুনে গ্রামবাসী বিলে নেমে পড়লে দৌঁড়ে তারা পালানোর চেষ্টা করে।”

মাইরের ঘটনার সময় বিলের মধ্যে বানিয়াবাড়ি, বাঘরী, কাজরদী, সুখেরটেকসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষই ছিল। কিন্তু যখন পুলিশ বিলে যায়, তখন কেউই ছিল না।” যোগ করেন জাকির।

এ ঘটনায় নিহতদের মধ্যে জাকির হোসেনের নানাবাড়ি কাঁচপুর ইউনিয়নের সুখেরটেক গ্রামে। বড়বিল থেকে তার নানাবাড়ি দুই কিলোমিটার দূরে।

সুখেরটেক গ্রামে জাকিরের নানিবাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। নানা ও নানি মারা গেছেন কয়েকবছর আগে, ছোট মামার ঘরটিও ছিল তালাবদ্ধ।

প্রতিবেশীরা জানান, জাকির নানা বাড়িতেই বড় হয়েছেন। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পরে তিনি এই গ্রামে আর থাকেন না। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে আড়াইহাজার উপজেলায় থাকেন। জাকিরের বিরুদ্ধে আগেও ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ শুনেছেন তারা।

সোনারগাঁ থানা পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির খবর পান তারা। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ সার্কেল) বিল্লাল হোসেনের নেতৃত্বে রাত ১২টা ৫ মিনিটের দিকে বড় বিলে গিয়ে বাঘরী গ্রামের অংশ থেকে একজনকে মৃত এবং দুইজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় পান।

আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান। সকালে বিলের সুখেরটেক গ্রামের অংশ থেকে আরও দুইজনের লাশ পাওয়া যায়। আরেকজনকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়েছে।

সুরতহালে নিহতদের শরীরে শাবল ও টেঁটাসহ ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও প্রাথমিক তদন্তের বরাতে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ সার্কেল) শেখ বিল্লাল হোসেন বলেন, “চিকিৎসাধীন মোহাম্মদ আলীর জবানবন্দি ও প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, জাকির হোসেনের নেতৃত্বে রোববার রাতে তারা কয়েকজন ডাকাতির উদ্দেশ্যে ওই বিলে জড়ো হয়েছিল।”

Also Read: নারায়ণগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে ৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা

এর আগে ২০২২ সালের তিন মার্চ উপজেলার সাদীপুরের নানাখী গ্রামে ডাকাতি করতে গিয়ে দুই সঙ্গীসহ গণপিটুনির শিকার হন জাকির। পরে গত বছর উপজেলার মহজমপুর গ্রামে এক পুলিশ পরিদর্শকের বাড়িতে ডাকাতি করার পর গ্রেপ্তার হন তিনি।

সোনারগাঁ উপজেলার সাদিপুর, কাঁচপুর ও বন্দর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের অন্তত দশটি গ্রামের মাঝখানে ‘কয়েকশ’ একরের বিস্তীর্ণ বিলটিকে স্থানীয়দের কাছে ‘বড় বিল’ নামে পরিচিত। ২০১৬ সালেও ওই বিলে ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে এক ব্যক্তি নিহত হন বলে পুলিশ জানিয়েছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “পিটুনিতে চারজনের মৃত্যু এবং একজন আহত হওয়ার ঘটনাটি তদন্ত করছে পুলিশ। এই বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

দুপুরে বাঘরদী গ্রামে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দলকে দেখা গেছে। জানতে চাইলে সিআইডির নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির বলেন, এই ঘটনার ছায়াতদন্ত করছেন তারা।

তবে রাত ৮টা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।