শিশুদের এ স্কুলটি সম্প্রতি নান্দনিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ত স্থাপত্য নকশার জন্য আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের পুরস্কারও জিতেছে।
Published : 11 Dec 2024, 09:14 AM
বড়াল নদী পাড়ের গ্রাম কুমারগাড়া। প্রত্যন্ত এ গ্রামের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচে। তবে তাদের শিশুরা সুযোগ পেয়েছে পরিবেশবান্ধব আবহে হেসে-খেলে শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠার।
তাদের জন্য এ সুযোগ তৈরি করেছে ‘বড়াল বিদ্যা নিকেতন’। যার প্রধান শিক্ষিকার লক্ষ্য বছরে অন্তত পাঁচজন ‘মানুষ’ এখান থেকে গড়ে তোলার।
স্বল্প খরচে শুধু ব্যতিক্রমী পাঠদান নয় পাবনার চাটমোহরের এই বিদ্যালয়টি সাড়া ফেলেছে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার নজরকাড়া স্থাপত্য শৈলীতেও।
যার স্বীকৃতি হিসেবে শিশুদের এ স্কুলটি সম্প্রতি নান্দনিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ত স্থাপত্য নকশার জন্য আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের পুরস্কারও জিতেছে।
শৈশব থেকেই শিশুদের প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার ভাবনা থেকেই এমন প্রচেষ্টা স্কুলটির উদ্যোক্তা সমাজসেবী মিজানুর রহমান ও দিল আফরোজ দম্পতির।
যারা দখল দূষণে মৃতপ্রায় বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিশুদের পরিবেশ সচেতন করতে গিয়ে ২০১৯ সালে নিজ পরিবারের জমি ও অর্থায়নে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন তারা।
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, “বড়াল রক্ষায় নেমে আমার কাছে মনে হলো এভাবে শুধু নদী রক্ষা করলেই চলবে না। এখানকার মানুষের চরমভাবে শিক্ষার প্রতি অনীহা, বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায় না, অভিভাবকেরাও পাঠাতে আগ্রহ পান না।
“এর কারণ আমার কাছে মনে হলো, গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা ও এর পরিবেশ তাদের শিক্ষার দিকে টানে না। তাই এই প্রান্তিক পর্যায়ে টিনের চালা দিয়ে স্কুল শুরু করি। পরে আমার শ্যালিকা এবং সবশেষ স্থপতি ইকবাল হাবিব সাহেব আমার পাশে দাঁড়ান এবং এর মধ্য দিয়েই আজকের বড়াল বিদ্যানিকেতন।”
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রকৃতি ও শিশুশিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে স্কুলটিতে রয়েছে ইট, কাঠ, বাঁশ ও মাটির তৈরি দুটি একতলা ও একটি দোতলা ভবন।
গতানুগতিকতার বাইরে খোলামেলা ও পরিবেশবান্ধব আবহে ইটের গাঁথুনি ও দেয়ালের নকশায় রয়েছে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশের ব্যবস্থা। শ্রেণীকক্ষ থেকেই রোদ, বৃষ্টি উপভোগের সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
বিদ্যালয়ের উঠোন জুড়ে আছে শান্তিনিকেতনের আদলে তিনটি আমগাছ। আরও আছে গুপ্তধনের রহস্যময় গুহার মতো মাটির তৈরি আকর্ষণীয় এক লাইব্রেরি।
স্কুলটির স্থাপত্য নকশাকার স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “পরিবেশ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চাটমোহর গিয়ে আন্দোলনের সহকর্মী মিজানুর রহমান প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন জেনে তা দেখতে যাই।
“সেখানে দেখি গরমে টিনের ঘরে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছেন, প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিক্ষক ও স্কুল সংশ্লিষ্টদের প্রচেষ্টার ত্রুটি নেই। এই জায়গা থেকেই আমি স্কুলটির সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি। একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থাপত্য নকশায় স্কুলটি বড় উদাহরণ করার চিন্তাভাবনার জায়গা থেকে আজকের এই রুপ দেই।
“খুব বেশি যে ব্যয় পড়েছে তা নয়, আসলে সদিচ্ছা থাকলে সীমিত ব্যয়েও নজরকাড়া স্থাপত্য ও পরিবেশ তৈরি করা যায়। এই বিদ্যালয়টি তার উদাহরণ। সবশেষ স্থাপত্য নকশায় স্কুলটি দুটি বিভাগে আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে।”
এই স্থপতি আরও জানান, সরকারি স্কুলগুলো যে ব্যয়ে গড়া হয়, তার চেয়ে তুলনামূলক অনেক কমে ব্যয়েও এগুলো করা সম্ভব।
পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিবেব নকশায় নান্দনিক স্থাপত্যে রূপ নেওয়া স্কুলে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে নিয়মিত আসে শিক্ষার্থীরাও।
বড়াল বিদ্যা নিকেতন কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, এখানে শিশুদের পড়ানো হয় হেসে-খেলে, সুরের তালে। শেখানো হয় নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও বিতর্ক। আছে কম্পিউটার ল্যাব। সাজানো বাগানে, হাসি-গানে প্রতিটি শিশুকে মানুষ করে তোলার অঙ্গীকার শিক্ষকদের।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী অমিত বলছিল, “আগে স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না। এখন স্কুলে না যেতে পারলে ভালো লাগে না। স্কুলে আসলেই মন ভালো হয়ে যায়। তীব্র গরমেও আমাদের গরম অনুভব হয় না। এখানে প্রচুর গাছপালা, আমরা মজা করে সময় কাটাই। আবার ক্লাসরুমও খুব সুন্দর।”
পঞ্চম শ্রেণির ঝলক তালুকদার বলে, “এতো সুন্দর পরিবেশ কোত্থাও নেই। স্কুলে আসলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। তাছাড়া শিক্ষকরা আমাদের অন্যদের মত করে পড়ান না, আদরে, হাসি খেলার মধ্য দিয়ে শেখান। এজন্য আমাদের কাছে পড়াশোনা বা স্কুল বিরক্তিকর মনে হয় না। এগুলো আমাদের অন্য বন্ধুরা শুনে আমাদের স্কুলে দেখতেও আসে।”
“আমরা এখানে নাচ, গান ও কবিতা আবৃত্তিসহ সংস্কৃতিমূলক অনেক কিছুই শিখি। জ্ঞানচর্চার জন্য ক্লাসের ফাঁকে নানারকম বই পড়ার জন্য সুন্দর লাইব্রেরি আছে। আমরা বই পড়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ পাই। যেগুলো অন্য স্কুলে সম্ভব না।”
বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক নাজমুল সাকিব তন্ময় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিষয়ে নিয়ে স্নাতক করেছেন। ঢাকার একটি বায়িং হাউজে উচ্চপদে চাকরি করতেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা দেখে ‘নামমাত্র সম্মানী’ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক হিসেবে পাঠদান শুরু করেন।
তিনি বলেন, “ভালো রেজাল্টের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের দেখতে চাই না। রেজাল্টের মোহ থেকে তাদের দূরে রেখে সঠিক শিক্ষাটা দিতে চাই। আমরা ওদের নীতিবান আসল মানুষ হিসেবে দেখতে চাই।”
পাঠদানের ব্যাপারে তিনি বলেন, “আনন্দের জায়গায় ওদের যে দুর্বলতা সেটিই আমরা কাজে লাগাই। সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতার আমেজে ওরা পড়াশোনা করে। ক্লাস শেষে ওদের জিজ্ঞেস করি কি শিখলে, ওরা তখন সব শেখাগুলো বলে না। নতুন যেটা শিখেছে সেটিই বলে। এবং সেই জায়গাতেই ওদের এতো আগ্রহ।
“ওরা উন্মুখ হয়ে থাকে, কাল স্কুলে গেলেই আবার ভারি বোঝার মত নয়, মজার ছলে নতুন কিছু শিখতে পারবো। এই আগ্রহটাই আমাদের আপাতত সফলতা।”
শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার বলেন, “ক্লাসরুম এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে বসেই শিশুরা আকাশ দেখছে, বৃষ্টি দেখছে, ছুঁতে পারছে। ফুল পাখি আর সবুজের সাথে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে ওরা। আমার ধারণা, এসব সুযোগ সুবিধা এই প্রজন্মকে করবে উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও মানবিক গুণ সম্পন্ন।”
গান ও নাচের শিক্ষিকা প্রজ্ঞা বলেন, “আমরা ওদের দেশাত্মবোধক গান ও ছোটদের নাচ শেখাই। ক্লাসিক ধাঁচের নাচও শেখানো হয়। মূলত বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যেগুলো সম্পর্কিত সেসবই শেখানো হয়। সংস্কৃতির মাধ্যমে তারা যেন নিজেদের সঠিক বিকাশ ঘটাতে পারে এমনটাই উদ্দেশ্য আমাদের।”
সরোয়ার হোসেন নামের এক অভিভাবক বলেন, “এমন প্রত্যন্ত গ্রামের এ ধরনের স্কুল আমাদের জন্য গর্বের। স্কুলের পড়াশোনার ধরণটাই এমন যে শিশুরা আগে স্কুলে যেতে চাইত না, তারা এখন স্কুল থেকে বাড়ি আসতে চায় না।”
চাটমোহর উপজেলার স্থানীয় নাট্যব্যক্তিত্ব রাজিউর রহমান রুমি বলেন, “অনগ্রসর এলাকার শিশুদের জন্য এ ধরনের বিদ্যালয় অবশ্যই অনেক প্রংশসার দাবিদার। স্কুলটি স্থানীয়দের শিক্ষা-পরিবেশ চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।”
বড়াল বিদ্যা নিকেতনের প্রধান শিক্ষিকা দিল আফরোজ জানান, “স্কুলটি এমন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, চাইলেও এখানে বাণিজ্যিকভাবে এই প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। এখানকার প্রত্যেকটি মানুষ প্রতিনিয়ত দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচে। তাছাড়া বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা থেকে এটি করিও নাই।
“প্রত্যন্ত অঞ্চলে গতানুগতিক ধারার বাইরে এক ভিন্ন শিক্ষা দিতে আমরা এখানকার ছেলে মেয়েদের দায়িত্ব নিয়েছি। এখানে অল্পকিছু টাকা মাসিক ফি হিসেবে নেওয়া হয়। এর মধ্যে এদের টিফিনসহ নানা ব্যবস্থা রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের এই সাফল্য আগামীর জন্য বড় উদাহরণ হিসেবে আমরা রেখে যেতে চাই। ওদের আমরা আরও ভালো মানের সেবাটা দিতে চাই, বছরে অন্তত পাঁচজন মানুষ এখান থেকে বের করতে চাই।”