Published : 04 May 2025, 07:19 PM
চায়ের পাতা তোলার মৌসুমে পাঁচ মাসের বকেয়া বেতন-রেশনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সিলেটের বুরজান চা কোম্পানির অধীন তিনটি বাগান ও একটি কারখানার প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক।
তবে টানা আন্দোলন চালিয়ে গেলেও তাদের দাবি পূরণ হচ্ছে না। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ শুধু বারবার আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছে।
বেতন-রেশনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কালাগুল চা বাগানের শ্রমিক সোমা বুনার্জী (৩৫) ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে বলছিলেন, “আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। না হয় বিষ দিতে হবে; যাতে আমরা খেয়ে মরতে পারি। এভাবে বেঁচে থাকতে পারছি না।”
সিলেটের বুরজান চা কোম্পানির অধীন তিনটি চা বাগান বুরজান, ছড়াগাঙ, কালাগুল এবং বুরজান কারখানার শ্রমিকদের ২০ সপ্তাহের বকেয়া এবং রেশনের বাকি পড়েছে। ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে বেতন ও রেশনের দাবিতে রোববার দুপুরে শ্রমিকরা সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের লাক্কাতুরা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
সড়ক অবরোধ কর্মসূচির আগে মালনিছড়া চা বাগান এলাকায় নিজের দুঃখের কথা বলতে গিয়ে সোমা বুনার্জী বলেন, “আমাদের ঘরে চাল, ডাল নেই। আমরা খেতে পারি না। আমাদের বাচ্চারা অসুস্থ, আমরা নিজেরাও অসুস্থ। খেটে খাওয়ার মত শরীরে শক্তি নেই। অনাহারে পড়ে আছি, কেউ আমাদের দেখতেও যায় না, খোঁজও নেয় না।
“বৃষ্টি পড়লে আমরা ঘরের এক পাশে পড়ে রই। এক প্লেইট ভাত নিয়ে, আমরা যখন বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বসে খাই, তখন দেখি আমাদের পাতে ভাত নেই। আমাদের উপাস থাকতে হয়। তখন আমরা চাল ভেজে হালকা চা-পানি দিয়ে খেয়ে রাত কাটাই।”
তিনি বলেন, “এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব না। এই যে এত দূর থেকে হেঁটে আসার পর আমাদের শরীর কাঁপে। আমরা একেবারে দুর্বল। এই দুর্বল অবস্থায় আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।”
সোমা বুনার্জী বলেন, “বাচ্চারা পাঁচ টাকা চাইলে দিতে পারি না। জানুয়ারিতে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করতে পারি নাই। বাগানের কিছু বাচ্চা ভর্তি হয়েছে, তবে তাদের খরচ দেওয়ার সামর্থ নেই। সামনে পরীক্ষা ফিস দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ১০ টাকা টিফিন খরচ দেওয়ার মত নাই। বাগানের সব বাচ্চারা ঝড়ে পড়ছে। বাচ্চারা হচ্ছে আগামীকালের ভবিষ্যৎ, কিন্তু বাগানের বাচ্চারা কী হচ্ছে? অর্থহীন হওয়ার কারণে বাচ্চাদের ভাত দিতে পারছি না, পড়াশোনা কিভাবে করাবো? অনেকবার আমরা ডিসি অফিসে গিয়েছি, ডিসি আমাদের চাল আর ৫০০ টাকা দিয়েছে অনেকদিন আগে। আর উপজেলা থেকেই নয় কেজি করে চাল দিসে। শুধু চাল খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?”
শ্রম দিয়ে উপার্জন করতে চান মন্তব্য করে এই চা শ্রমিক বলেন, “আমরা শ্রম দিব কিন্তু টাকা পাই না। আমরা কি কোম্পানির কোনো ক্ষতি করেছি? কেন কোম্পানি আমাদের এভাবে ফেলে চলে গেল- এটা জানতে চাই। আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে, আর যদি না চায়, আমাদের বিষ এনে দিবে, বিষ খেতে মরতে পারি।
“না হয় প্রতিটি বাগানে বোমা মারুক, আমরা ঘুমিয়ে থাকব বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে, বোমা মেরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। আমরা চাইব না বিচার, আমরা যাব না আদালতে, যাব না ডিসির কাছে, যাব না বিরক্ত করতে। আজকে আমরা দাবি নিয়ে এসেছি আমাদের বেঁচে থাকার ঠিকানা দেন, না হয় মৃত্যুবরণ করার কোনো জিনিস দান করুন। যা খেয়ে আমরা মৃত্যুবরণ করতে পারি। আমাদের বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই।”
এ সময় সেখানে দাঁড়ানো শ্রমিক উষা কুর্মী, নমি সিং, বৈশাখি বুনার্জী ও ভারতি নায়েকেও সোমা বুনার্জীর কথায় সায় দিচ্ছিলেন।
পুরুষ শ্রমিক নমি সিং বলেন, “আমাদের ২০ সপ্তাহের বেতন বাকি পড়েছে। আমাদের বাগানের মালিক বিদেশে ভাগছে। আমাদের দেখার কেউ নেই। বর্তমানে আমরা চাচ্ছি, আমাদের দায়িত্ব, বাগানের দায়িত্ব কেউ নিতে। নিয়ে সুন্দরমত বাগানটা চালুক। আমরা যাতে বেতন পাই।”
শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের বিষয়ে বুরজান চা বাগান কোম্পানির ব্যবস্থাপক মো. কামরুজ্জামানের মোবাইলে ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
অবরোধে সড়কে যানজট
সরজমিনে দেখা যায়, দুপুর ১২টার দিকে চা শ্রমিকেরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জমা হন মালনিছড়া চা বাগানের কালীমন্দির এলাকায়। সেখানে তারা নানা দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
পরে তারা সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আম্বরখানা-বিমানবন্দর সড়কের লাক্কাতুরা চা বাগান এলাকার রাস্তা অবরোধ করেন। তখন সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। সড়ক অবরোধে কয়েক হাজার চা শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন। এ সময় শ্রমিকদের হাতে নানা দাবি সম্বলিত ফেস্টুন দেখা গেছে।
দুপুর থেকে শুরু হওয়া অবরোধের ফলে বিমানবন্দর সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রাস্তার দুই পাশে আটকে পড়ে শত শত যানবাহন। বাধ্য হয়ে অনেকে গাড়ি ছেড়ে হেঁটে যান গন্তব্যে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে যানজটে আটকেপড়া অ্যাম্বুলেন্সসহ কয়েকটি জরুরি যান চলাচলের সুযোগ তৈরি করেন।
শ্রমিকরা ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই কর’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘আমাদের ২০ সপ্তাহের বেতন দিতে হবে, দিয়ে দাও’, ‘বকেয়া বোনাস পরিশোধ করতে হবে’, ‘বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে’, ‘আমাদের বেতন দিয়ে দাও, দিতে হবে’- এসব স্লোগানে-স্লোগানে চারপাশ মুখরিত করেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা সরকারের উদ্দেশে বলেন, “বর্তমানে বাগন থেকে চা পাতি তোলার সময়। এই সময়ে চা পাতি না উঠানো গেলে বাগানের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। চা শ্রমিকেরা বেতন বন্ধ থাকায় খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে। শ্রমিকেরা আর কত অপেক্ষা করবে। পাঁচ মাস ধরে বেতন ও রেশন বন্ধ।
“আপনারা যদি চা শ্রমিকদের মানুষ মনে করেন; তাহলে দ্রুত সমস্যার সমাধান করুন। আমি আশা করি, সরকার নজর দিবেন এই বিষয়ে এবং এই বাগানটা দ্রুত চালু করবেন। চা শিল্পটাকে বাঁচাবেন। বুরজান চা বাগানের বিষয়ে সরকার হস্তক্ষেপ না করলে সমস্যার সমাধান হবে না।”
যানজটের বিষয়ে বেলা পৌনে ৫টার দিকে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “চা শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করায় রাস্তার দুইপাশে যানজট সৃষ্টি হয়েছিল। অবরোধ তুলে নেওয়ার কিছু সময় পর সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। বর্তমানে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।”
প্রশাসনের আশ্বাসে রাস্তা ছাড়েন শ্রমিকরা
প্রশাসনের আশ্বাসে দাবি আদায়ে লিখিত দেওয়ার প্রতিশ্রুতির পর বেলা পৌনে ৩টার দিকে সড়কের অবরোধ সরিয়ে শ্রমিকরা ফের মালনীছড়া চা বাগানে অবস্থান নেন।
সড়ক অবরোধের খবর পেয়ে সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোশনূর রুবাইয়্যাৎ ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের দাবি মানার আশ্বাস দেন এবং জনদুর্ভোগ লাঘবে সড়ক অবরোধ তোলে নেওয়ার কথা বলেন।
এ সময় চা শ্রমিক নেতা অজিত রায় বলেন, “পাঁচ মাস যাবত আমাদের বেতন বন্ধ, রেশন বন্ধ। আমাদের একটাই কথা, আমাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে। অন্যথায় আমরা রাস্তা ছাড়বো না। আপনারা আমাদেরকে রাস্তায় নামিয়েছেন; আমরা বিভিন্ন সময়ে জানিয়ে আসছি আমাদের সমস্যাগুলো। কারো কোনো পদক্ষেপ নেই।”
তিনি বলেন, “কতগুলো মানুষ না খেয়ে রয়েছে, কার্ড নিয়ে গেলেও তাদের রেশন দেওয়া হয়নি। তাদের দুর্বিষহ জীবন আপনারা তো দেখেন নাই। আপনারা আমাদের নির্দিষ্ট করে লিখিত আকারে জানান কবে আপনারা এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।”
এ সময় ইউএনও খোশনূর রুবাইয়্যাৎ বলেন, “আমরা আপনাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের বকেয়া বেতনসহ যা দাবি আছে, আপনাদের যে সমস্যাগুলো আছে তা যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে দূর হয় তার জন্য আমরা কাজ করছি।”
লিখিত আকারে প্রশাসনের প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে ইউএনও বলেন, “আপনারা অনেকদিন ধৈর্য ধারণ করেছেন। আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী আজকেই আমরা লিখিতভাবে জানাবো যে, কবে আমরা এ সমস্যা সমাধান করতে পারবো।
“এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তো আর লিখিত দেওয়া সম্ভব না, আপনারা পাঁচজন প্রতিনিধি পঞ্চায়েতসহ আমার অফিসে চলেন। আমরা লিখিতভাবে জানাবো।”
এ সময় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে বলে জানান ইউএনও।