“জ্বর সারাতে তারা কবিরাজের শরণাপন্ন হলে কবিরাজ বিভিন্ন গাছের শেকড়ের রস খেতে দেয়। এক সময়ে সে রক্তবমি শুরু করে।”
Published : 23 Mar 2024, 09:16 PM
রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের চান্দবী ঘাট গ্রামে গত আড়াই মাসে যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে তা ছিল স্বাভাবিক। তবে গ্রামের একটি গাছ কেটে ফেলার পর, ওই গাছের ভূত মানুষের ওপর ভর করার গুজবে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য বিভাগের পাঠানো মেডিকেল টিমের প্রধান বরকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মং ক্যছিং শনিবার এসব কথা বলেন।
চান্দবী ঘাট গ্রামে তীব্র জ্বর, রক্তবমি ও পেট ব্যাথায় জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এরপর সেখানে আক্রান্তদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনাটি জানার পর বুধবার স্বাস্থ্য বিভাগ দুর্গম ওই গ্রামে চিকিৎসকদল পাঠায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে সাত সদস্যের চিকিৎসক দল সেখানে পৌঁছে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে।
মং ক্যছিং বলেন, "বৃহস্পতিবার দুপুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা চান্দবী ঘাট গ্রামে পৌঁছার পর প্রথমে রোগীদের চিকিৎসার কাজে নেমে পড়ি। শুরুতে যারা জ্বর, পেটব্যাথায় অসুস্থ ছিল তাদের চিকিৎসা দেই। তাদের শারীরিক বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষা করে আমরা বুঝতে পারলাম, তারা সিজনাল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। আর যারা মারা গিয়েছেন, তাদের একজন জ্বর ও রক্তবমিতে মারা গেছেন। বাকিদের মৃত্যু হয়েছে বুক ব্যাথা, কিডনি রোগে ও স্ট্রোক করে।
“তবে স্থানীয় কবিরাজ তাদের ভয় দেখানোর কারণে তারা স্বাভাবিক খাবার বন্ধ করে দেয়। তাদেরকে ভাত আর বেগুন ছাড়া অন্য কোনও খাবার গ্রহণে নিষেধ করে দেয়। এতে রোগীরা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। কবিরাজের নিষেধ ছিল যে, প্রচলিত ওষুধ কিংবা চিকিৎসা সেটা দেওয়া যাবে না। ফলে বর্তমানে যারা আক্রান্ত, তারা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।”
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৫ জন। তাদের মধ্যে প্রথম মৃত্যু হয় ১০ জানুয়ারি। এদিন চান্দবী ঘাট গ্রামের লবিন্দর চাকমা এবং স্নেহবালা চাকমার ছেলে পত্তরঞ্জন চাকমা (২৫) মারা যান।
এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি বিমলেশ্বর চাকমা (৫৫), ২৬ ফেব্রুয়ারি ডালিম কুমার চাকমা (৩৫), ১৫ মার্চ চিত্তি মোহন চাকমা (৬০) এবং ১৭ মার্চ সোনি চাকমা নামের ৮ বছর বয়সী এক শিশু মারা যায়।
স্থানীয়রা বলেন, গ্রামে ‘পাকুড়’ নামে একটি বয়সী গাছ ছিল। সেটি গত জানুয়ারি মাসে কেটে ফেলা হয়। গাছটির কাটার সপ্তাহ খানেক পর বিমলেশ্বর চাকমার মৃত্যু হয়। মূলত তার মৃত্যুর পর গ্রামে গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যে, গাছের ভূত মানুষের ওপর ভর করেছে।
এজন্য কেউ স্বাভাবিক জ্বরে আক্রান্ত হলেও গ্রামবাসী ভাবতো তাকে ভূতে ধরেছে। কবিরাজও একই কথা বলায় মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস গাঢ় হতে থাকে। পরে আরও কয়েকজন মারা যাওয়ায় সকলেই কবিরাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. নিহার রঞ্জন নন্দী বলেন, “মূলত কুসংস্কারের কারণে ঘটনাটি এত বড় হয়েছে। যারা মারা গেছে, তারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল। পাশাপাশি হালকা জ্বর আসার পর কেউ মারা গেলে স্থানীয় বৈদ্য বয়সী বৃক্ষ কেটে ফেলার গল্প রটিয়ে দেয়। আমাদের মেডিকেল টিম বর্তমানে যারা জ্বরে আক্রান্ত তাদের চিকিৎসা দিয়েছে।”
এলাকাটি অতিদুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় সেখানে কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই এবং আশপাশে কোনো চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র নেই। স্থানীয় কবিরাজির মাধ্যমে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানান মং ক্যছিং।
এ চিকিৎসক বলেন, “সোনি চাকমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সে জ্বরে আক্রান্ত ছিল। জ্বর সারাতে তারা কবিরাজের শরণাপন্ন হলে কবিরাজ বিভিন্ন গাছের শেকড়ের রস খেতে দেয়। অনেকগুলো রস খাওয়ানোর ফলে শিশুটির ঘন ঘন বমি হয়। এক সময়ে সে রক্তবমি শুরু করে। এতে শিশুটি মারা যায়।
“এছাড়া বিমলেশ্বর চাকমা স্ট্রোক করে ও ডালিয়া চাকমা বুকে ব্যথাসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাকি দুইজনের একজন প্যারালাইসিসের পাশাপাশি হাত-পা ফুলে যাওয়া ও অন্যজনের কিডনি রোগের সমস্যাসহ আগে থেকে বিভিন্ন রোগ থাকায় তাদের মৃত্যু হয়।“
জ্বর-রক্তবমি আতঙ্ক প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার এ কর্মকর্তা বলেন, “অনেকেই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল, তবে সেটা স্বাভাবিক সিজনাল জ্বর ছিল। যারা বর্তমানে জ্বরে আক্রান্ত তাদের শরীরে ২ থেকে ৩টা করে তাবিজ বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের শরীরে হলুদ মাখা দেখা গেছে। কবিরাজের পরামর্শে তারা এসব করেছে।”
দুর্গম পাহাড়ে জ্বর-রক্তবমিতে ৫ মৃত্যু: কাজ শুরু করেছে চিকিৎসক দল
মেডিকেল টিমের প্রধান মং ক্যছিং গ্রামটির দুর্গমতা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “আমরা বৃহস্পতিবার ভোরে রাঙামাটি থেকে স্পিডবোটে প্রথমে বরকল যাই। সেখান থেকে বরকলের জগন্নাথ ঘাটে সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছাই। এরপর পাহাড়ি সরু ও উঁচু-নিচু পথে মোটরসাইকেলে করে ছোট্ট একটি গ্রামে যখন পৌঁছালাম, তখন সকাল নয়টা।
“সেই নয়টা থেকে হাঁটা শুরু করে কয়েকটা পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমরা বেলা তিনটার দিকে চান্দবী ঘাট গ্রামে পৌঁছাই। যেখানে না আছে কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক, না আছে বিদ্যুৎ। গ্রামে প্রায় একশ পরিবার বসবার করে। তাদের যাদের যে সমস্যা ছিল, আমরা সাধ্যমত তাদের চিকিৎসা প্রদান করি।”