মসজিদে জামায়াত নেতার ‘উসকানি’, প্রতিবাদ করায় আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটুনি

পুলিশ বলেছে, ভুক্তভোগী মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন, তিনি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

শামস শামীমসুনামগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2023, 11:00 AM
Updated : 31 Jan 2023, 11:00 AM

সিলেটের ছাতক উপজেলায় একটি মসজিদে জুমার নামাজে জামায়াতে ইসলামীর নেতার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্যের প্রতিবাদ করায় শিবিরের কর্মীরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে মারধর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

গত শুক্রবার উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ নতুনবাজার মসজিদে এ ঘটনা ঘটে। তবে বিষয়টি আলোচনায় আসে সোমবার উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান নিজের ফেইসবুক থেকে অ্যাকাউন্ট স্ট্যাটাস দেওয়ার পর। এ ঘটনার দুটো ভিডিও ক্লিপও ছড়িয়ে পড়েছে। 

মঙ্গলবার বিকালে ছাতক থানার ওসি মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গোবিন্দগঞ্জ ফজলিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ও নতুনবাজার জামে মসজিদের খতিব আব্দুস সালাম মাদানী বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন স্থানীয় কাউসার আহমেদ। তারপর তাকে মারধর করা হয়েছে বলে তিনি পুলিশকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন।”

“আজও আমরা তার সঙ্গে কথা বলেছি। উনি মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।“  

ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাকে অনেকে ফোন করে মসজিদের বয়ানে সাম্প্রদায়িক, উসকানিমূলক ও মিথ্যা বয়ানের বিষয়ে অবগত করেছেন। শুক্রবার একজন স্থানীয় মুসল্লি জামায়াত নেতা আব্দুস সালাম মাদানির বক্তব্যের প্রতিবাদ করায় তার অনুসারীরা তার সামনেই ওই মুসল্লিকে পিটিয়েছে। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।”

বিষয়টি নিয়ে সোমবার দুপুরে নিজে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন জানিয়ে চেয়ারম্যান আরও বলেন, “এ ঘটনায় আহত কাউসার আহমেদ মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমিও বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করেছি।” 

সুনামগঞ্জ-২ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক সাংবাদিকদের বলেন, “গোবিন্দগঞ্জ নতুনবাজার মসজিদের ভিতর এক ধর্মপ্রাণ মুসল্লি সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ও মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করায় তাকে জামায়াত- শিবিরের লোকজন মসজিদেই মারধর করেছে। আমি বিষয়টি জানার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।”

গত শুক্রবার মারধরে আহত কাউসার আহমেদ গোবিন্দগঞ্জ কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়ে গোবিন্দগঞ্জের বাড়িতে ফিরেছেন। 

মঙ্গলবার বিকালে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি অসুস্থ ছিলাম বিধায় মৌখিকভাবে থানাসহ সবাইকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। আমি বাড়ি ফিরেছি। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি। এখন থানায় গিয়ে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”  

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, “জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য আব্দুস সালাম মাদানী মসজিদের খতিব হিসেবে প্রতি শুক্রবার বয়ানে ধর্মীয় উসকানি, অপপ্রচার ও সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে থাকেন। গোবিন্দগঞ্জ জামায়াতের ঘাঁটি হওয়ায় তার এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে কেউ সাহস করে কথা বলে না।” 

“গত শুক্রবার আব্দুস সালাম মাদানী জুমার নামাজের আগে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বয়ান করছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করতে থাকেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম হিন্দু সূর্য সেনের নামে নামকরণ করেছে’। আরও সাম্প্রদায়িক ও উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেন।”

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম হল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আল্লামা ইকবাল হল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের সময় হলের নাম পরিবর্তন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে হলটি করার দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। স্বাধীনতার পর হলটির নাম বদলে জহুরুল হক হল করা হয়।

কাউসার আহমেদ বলেন, “আমি শান্ত ও নম্র ভাষায় মিম্বরে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার ও বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য না দিয়ে মানুষকে হেদায়েতের আহ্বান জানানোর অনুরোধ করেছিলাম। তখন মাদানী সবার সামনে আমাকে হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করেন। নামাজ শেষে বাইরে বেরিয়ে দেখি তার অনুসারী, জেলাখাটা শিবিরের নেতাকর্মীরা হকিস্টিক ও অস্ত্র-শস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমি দৌড়ে মসজিদে ঢুকে পড়ি। সেখানে তারা আমার ওপর হামলা চালায় এবং গুরুতরভাবে আহত করে।”  

“তখন সেখানকার মুসল্লিরা এসে আমাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করে। তারা এগিয়ে না গেলে হয়তো আমাকে মসজিদের ভিতরই খুন করে ফেলতো জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারা।” 

ঘটনার সময় গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সুরেতাজ মিয়া মসজিদে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও আওয়ামী লীগ নেতা কাউসার আহমেদকে রক্ষার চেষ্টা করেন। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাউসার আহমদ মসজিদের খতিব আব্দুস সালাম মাদানীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। নামাজ শেষে তার ওপর বেশ কয়েকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। আমরা তাকে উদ্ধার করি। আমরা এগিয়ে না গেলে তাকে তারা মেরেই ফেলতো।”

প্রত্যক্ষদর্শী শাহজাহান সিরাজ বলেন, “হামলার পর আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কাউসার আহমেদকে রক্ষা করি। সেই তাকে নিরাপত্তা না দিলে হয়তো তাকে মেরেই ফেলত। আমরা কেউ এটা প্রত্যাশা করিনি। এটা অনেক মুসল্লিই মেনে নিতে পারছেন না।” 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদের সদস্য আব্দুস সালাম মাদানী সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ২৮ বছর ধরে মসজিদে বয়ান করছি। কেউ আমার দিকে চোখ তুলে কথা বলেনি। আমি গত শুক্রবার আল্লামা ইকবালের নামের হল পরিবর্তন করে সূর্য সেনের নামে নামকরণ করার উদাহরণ দেওয়ায় আমার দিকে চোখ তুলে বেয়াদবি করে কাউসার। পরে মুসল্লিরা তাকে মারধর করেছে।“

তিনি আরও বলেন, “যারা হামলা করেছে তারা জামায়াত-শিবিরের কেউ না।” 

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আব্দুস সালাম মাদানী সুনামগঞ্জ-৫ আসন থেকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার বিভিন্ন মামলায় কারাভোগ করেছেন। ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল যৌন হয়রানির বিচার না করায় তার মাদরাসার এক ছাত্রীর হাতে লাঞ্ছিতও হয়েছিলেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবেদা আফসারি তাকে ডেকে নিয়ে তিরষ্কার করেছিলেন।