বিক্রির প্রয়োজন না থাকায় বন বিভাগ এসব গাছ ঠেকানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয় বলে তাদের দাবি।
Published : 23 Aug 2022, 07:03 PM
‘নীতিমালা উপেক্ষা করে’ গাইবান্ধা জেলা পরিষদ ৪১৬টি গাছ বিক্রি করেছে, যা নিয়ে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
এই বিক্রেতারা কারা? কী চান তারা? এতগুলো গাছ একযোগে বিক্রি করায় এমন নানা প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী।
এসব গাছ কেটে ফেললে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে জানিয়ে পরিবেশবাদীরা গাছ বিক্রেতাদের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
গাইবান্ধা পরিবেশ আন্দোলনের আহ্বায়ক ওয়াজিউর রহমান রাফেল বলেন, “কোনো প্রয়োজন ছাড়াই এসব গাছ কাটা হচ্ছে। বিক্রেতারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব গাছ কেটে ফেলছেন।”
কেন এতগুলো জীবন্ত গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে জানতে চাইলে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, “আমি এখন ব্যস্ত আছি।”
গাইবান্ধা বন বিভাগের দাবি, তারা গাছগুলো ঠেকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।
জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, “বিক্রির প্রয়োজন না থাকায় দীর্ঘ এক বছর এই গাছগুলোর মূল্য নির্ধারণকাজ আটকে রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চাপে বন বিভাগ সম্প্রতি জেলা পরিষদের ওই সব গাছের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।”
বন নীতিমালা অনুযায়ী, গাছ মরার উপক্রম হলে বা বয়স বেশি হলে, হেলে পড়লে বা উন্নয়নকাজের প্রয়োজনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে গাছ কাটা যায়। বিক্রির আগে গাছের দাম নির্ধারণ করে নম্বর দিতে হয়।
গত ২৮ জুলাই জেলা পরিষদ ৪১৬টি জীবন্ত গাছ বিক্রির দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে জেলা পরিষদ কার্যালয় চত্বরে ৪৫টি, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরে ১০টি, নলডাঙ্গা-রহমতপুর সড়কের দুই ধারে ৬০টি এবং বামনডাঙ্গা-নলডাঙ্গা সড়কের দুই ধারে ৩০১টি গাছা রয়েছে।
দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল গত ১০ অগাস্ট। শতাধিক দরপত্র জমা পড়ে। পরদিন যাচাই-বাছাই করে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকায় এসব গাছ বিক্রি করা হয় বলে জেলা পরিষদ কর্মকর্তারা জানান।
দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গাইবান্ধা সড়ক বিভাগের অধীনে বামনডাঙ্গা-শঠিবাড়ী-আফতাবগঞ্জ মহাসড়ক প্রশস্তকরণ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী গাছ কাটা হবে। অথচ একই দরপত্রের নিচে আরও কিছু সড়কের কথা বলা হয়, যেগুলো আঞ্চলিক সড়ক।
মঙ্গলবার সকালে গাইবান্ধা শহরের কলেজ রোডে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কার্যালয়ের ভেতরে সারি সারি জীবন্ত গাছ। গাছের নিচে অনেকে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এই চত্বরের ৪৫টি গাছ বিক্রি হয়েছে। কিন্তু কোনো গাছে নম্বর বসানো হয়নি। এখানে অডিটরিয়াম নির্মাণের জন্য গাছ কাটার কথা দরপত্রে বলা হয়েছে। অথচ অডিটরিয়াম নির্মাণের কথা বলে সম্প্রতি জেলা পরিষদ চত্বরের একটি পুকুর ভরাট করা হয়েছে। তবে সেখানে স্থাপনা নির্মাণে আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
গাছ কাটার বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
জেলা জাতীয় শ্রমিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নূর মোহাম্মদ বলেন, “বেশিসংখ্যক গাছ কাটার উদ্দেশ্যে কোনো গাছে নম্বর দেওয়া হয়নি। এসব গাছ যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে, কিন্তু তা চিন্তা করছেন না বিক্রেতারা।
“মেয়াদ শেষের পথে জেলা পরিষদ প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সবাইকে ম্যানেজ করে অপ্রয়োজনে এসব গাছ কাটছেন। এখানকার গাছ কাটা বন্ধ না হলে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।”
“জেলা পরিষদ চত্বরের গাছে নম্বর দিতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ,” বললেন গাইবান্ধা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম।
জেলা পরিষদ প্রশাসক (সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) আতাউর রহমান সরকার দাবি করেন, “উন্নয়নকাজের জন্য এসব গাছ কাটতে বিভিন্ন দপ্তর চিঠি দেয়। এরপর গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সিদ্ধান্ত জেলা সমম্বয় কমিটির সভায় অনুমোদিত হয়। পরে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় কাটার অনুমতি দিলে গাছ বিক্রি করা হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গাছ কাটা হচ্ছে না।”
বিক্রির আগে গাছে কেন নম্বর দেওয়া হয়নি সে প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।
আর গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ছাবিউল ইসলাম বলেন, তার দপ্তর থেকে জেলা পরিষদকে গত এক বছরে কোনো গাছ কাটতে বলা হয়নি।
তাছাড়া কতটি গাছ কাটা হবে সে বিষয়ে সওজ অবগত না।
গাইবান্ধা সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফিরোজ আখতার বলেন, “সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে যে কয়টি গাছ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, কেবল সেগুলোই চিহ্নিত করে কাটতে বলা হয়েছে। সংখ্যা বলা হয়নি।”
বামনডাঙ্গা-নলডাঙ্গা সড়কে ঘুরে দেখা গেছে, এর দুই ধারে কোনো গাছ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। এখানকার সব গাছই জীবিত এবং সড়ক থেকে বেশ দূরে।
তাছাড়া বছর খানেক আগে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়ক প্রশ্বস্তকরণ কাজ করেছে সওজ।
“তার পরও এখন এসব গাছ বিক্রি করছেন যারা, তারা আসলে কী চান?” প্রশ্ন বামনডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান হবির।
সড়কটিতে জীবিত বিশাল আকৃতির রেইন্ট্রি ও মেহগনি গাছ রয়েছে।
প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ নলডাঙ্গা-রহমতপুর সড়ক থেকেও গাছগুলো বেশ দূরে। সড়কের দুই ধারের ফুটপাত ও ফাঁকা। কোনো মরা বা হেলে পড়া গাছ নেই।
রহমতপুর এলাকার কলেজছাত্র নাদিম মাহমুদ বলেন, “সড়কের দু পাশে মূল্যবান গাছের দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। গরমের দিনে রিকশাচালক, পথচারী ও কৃষক জমিতে কাজের পর গাছের নিচে বিশ্রাম নেন। এখানকার গাছ কাটার কোনো প্রয়োজন নেই।”
মার্কেট নির্মাণের দোহাই দিয়ে বিক্রি করা হয়েছে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার থানাপাড়া এলাকার ১০টি জীবিত গাছ।
উপজেলা শহরের বাসিন্দা মোশারফ হোসেন বলেন, “এলাকায় দোকান বরাদ্দের দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দোকানঘর পজেশন বা ভাড়া নেওয়ার লোক পাওয়া যায়নি। ফলে সেই দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। পুনরায় দরপত্র আহ্বানের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। অথচ মার্কেট নির্মাণের দোহাই দিয়ে এখানকার গাছ বিক্রি করা হয়েছে। গাছগুলো কাটার অপেক্ষায় রয়েছে।”