শ্রম-ঘামে ফলানো একমাত্র ফসল বোরো ধান গোলায় তুলতে হাওরের প্রায় পৌনে চার লাখ কৃষক প্রস্তুতি শুরু করেছে।
Published : 10 Apr 2024, 11:45 PM
সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরের কোথাও ধানক্ষেত সবুজের খোলস ছেড়ে হলুদ আভায় রূপ নিয়েছে, কোথাও সোনালি ধানের মৌ মৌ গন্ধ, বাতাসে দোল খাচ্ছে নুড়েপড়া ধান, আবার কোথাওবা অল্প অল্প করে কাটা শুরু হচ্ছে।
জেলার ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরেই এখন মনমতানো এই দৃশ্য। শ্রম-ঘামে ফলানো একমাত্র ফসল বোরো ধান গোলায় তুলতে হাওরের প্রায় পৌনে চার লাখ কৃষক প্রস্তুতি শুরু করেছে।
হাওরে-হাওরে পতিত জমিতে তৈরি হচ্ছে ধান কাটার পর সিদ্ধ করে শুকানোর জন্য ‘খলা’ (মাঠ বিশেষ) এবং কান্দায় (পতিত উঁচু ভূমি) থাকায় জন্য তৈরি করা হচ্ছে ‘ওড়া’ (অস্থায়ী খুপড়ি ঘর)।
শেষ মুহূর্তে উজানের ঢল বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে যাতে কষ্টের ফসল কেড়ে না নেয় তার জন্য গ্রামে গ্রামে হিন্দু-মুমলমানের ঘরে পালন করা হচ্ছে বিশেষ লোকাচার। প্রকৃতিকে খুশি রেখে মানত পূরণ করে সোনার ধান গোলায় ভরতে চায় কৃষক।
আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে ধান কাটার উৎসব; স্থানীয়ভাবে যা ‘দাওয়ামারি’ নামে পরিচিত।
দিরাই উপজেলার ভরাউট গ্রামের কৃষক আব্দুল জব্বার বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আশপাশের হাওরেও ধান ভালো হয়েছে। পাকতেও শুরু করেছে। যারা দেশি প্রজাতির ধান রোপণ করেছিলেন সেই ধান কাটতে শুরু করেছেন।
“দাওয়ামারির আবহ শুরু হয়ে গেছে হাওরের গ্রামগুলোতে। এক সপ্তাহ পরেই হাওরের চিত্র বদলে যাবে। যদি ফসল ভালোভাবে গোলায় তোলা যায় তাহলে কৃষকের ভাড়ার ধানে ভরে যাবে”, বলেন আব্দুল জব্বার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, “সোমবার পর্যন্ত আমাদের হাওরের প্রায় ৪০০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। যার বেশিরভাগই দেশি প্রজাতির আগাম বোরো ধান।
“আগামী সপ্তাহে বন্যার আশঙ্কা নাই বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলে হাওরে এবার বাম্পার ফলন হবে।”
তিনি বলেন, হাওরের উৎপাদিত ধান হবে প্রায় ১৩ লাখ ৭০ হাজার টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার ১০ কোটি টাকা।
পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই জলভাণ্ডারের নিচু জমি দেশের খাদ্যশস্যের বড় জোগানদারও। এক ফসলি এই জমির দিকে সারাবছর তাকিয়ে থাকে হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার কৃষক। তবে সবচেয়ে বেশি ধান হয় নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জ জেলায়।
সুনামগঞ্জ জেলার দেশি আগাম ধান কাটা হয় মধ্য চৈত্র থেকে বৈশাখের শুরুতে। হাওরের জমির পুরোটাই এক ফসলি। এই ফসলের ওপর নির্ভর করেই হাওরের কৃষক সারা বছরের খাওয়া-পরা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সবকিছু চালায়। এটাই অনেকের বেঁচে থাকার অবলম্বন।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, হাওরে এবার ৭০ দশমিক ০৫ শতাংশ উফশী (উচ্চ ফলনশীল ধান), ২৯ শতাংশ হাইব্রিড ধান এবং ০.০৫ ভাগ স্থানীয় প্রজাতির দেশি ধান আবাদ হয়েছে। সব মিলিয়ে বোরো আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর। হাওরের প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার পরিবার এবার বোরো ধান চাষ করেছে।
১৫ এপ্রিল থেকে হাওরে পুরোদমে ধানকাটা উৎসব শুরু হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কৃষকের ধান যাতে ১৫ দিনের মধ্যেই কাটা যায় সেই লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন প্রস্তুতি নিয়েছে।
তবে বর্তমানে দেশি বোরো ধান, বিআর ৮৮, ৯৬, হাইব্রিড ধান কাটা হচ্ছে। প্রতিদিনই অল্প অল্প করে ধান কাটা হচ্ছে।
ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক ও যন্ত্র রয়েছে উল্লেখ করে কৃষি বিভাগ জানায়, হাওরের বোরো ধান কাটার জন্য ৮৭০টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর ও ২০০টি রিপার যন্ত্র রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে একটি হার্ভেস্টর ১০০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে। অন্যদিকে রিপার গড়ে ২০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে।
এ ছাড়া হাওরের ১ লাখ ৯০ হাজার নিয়মিত কৃষিশ্রমিক, ৩০ হাজার অনিয়মিত শ্রমিক ও বাইরের জেলার আরও প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক ধান কাটার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ১ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর উফশী ধান, ৬৫ হাজার হেক্টর হাইব্রিড ধান ও ১১৯০ হেক্টর স্থানীয় প্রজাতির ধান চাষাবাদ হয়েছে।
সদর উপজেলার ডুপিকোনা গ্রামের ধানকাটা শ্রমিক ইনসান মিয়া বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। হারাবছর দিনমজুরি করি। বৈশাগ আইলে অন্য কাজ থইয়া আউরো গিয়া ধান কাটি। আমরা দুই ভাই ধান কাইট্যা ছয় মাসের ধান রুজি করতে পারি। আমরার মতো হকল গ্রামের শয় শয় মানুষ ই সময় ধান কাইট্যা বালা রুজি করে। যদি বছর বালা অয় গিরস্তের লগে আমরাও বালা তাকি।”
শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, “হাওরে এবার যথাসময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় বোরো ফসল ভালো হয়েছে। যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে না পড়ে তাহলে বাম্পার ফলন হবে।”
তিনি বলেন, “বিচ্ছিন্নভাবে দেশি বোরো ধান কিছু কাটা হচ্ছে। অন্যান্য ধানও পাকার পথে। আগামী সপ্তাহ থেকেই পুরোদমে ধানকাটা শুরু হবে হাওরে।”
হাওরের বোরো ধান রক্ষায় রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিস্তৃত ফসলরক্ষা বাঁধ। ভারী বৃষ্টি আর উজান থেকে আসা ঢলে এ বাঁধ তলিয়ে গেলে ক্ষেতে পানি ঢুকে যায়; তখন মানুষের দুর্দশার সীমা-পরিসীমা থাকে না।
এরই মধ্যে তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওরের রামসার সাইটভুক্ত (সংরক্ষিত) নজরখালি বাঁধটি স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে টেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই বাঁধটি পাউবো এলাকার বাইরে। এখানের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে।
মূলত মেঘালয়ে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জের নদ-নদীতে পানি বাড়ার পর নজরখালি বাঁধটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে।
যদিও আগামী এক সপ্তাহ হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও বন্যার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন পাউবোর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার।