বীর নিবাস: মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর নামের বাড়ি পেলেন আরেকজন

মুক্তিযোদ্ধার দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে বরাদ্দ বাড়িটি লিখে নিয়েছেন প্রথম স্ত্রীর সন্তান, যিনি সরকারি চাকরিজীবী।

পাবনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2023, 02:00 PM
Updated : 28 March 2023, 02:00 PM

পাবনার বেড়া উপজেলায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত বাড়ি ‘বীর নিবাস’ এর একটি বাড়ি বরাদ্দ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। 

বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া হয় মৃত মুক্তিযোদ্ধার দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে। পরে তা ‘জোর করে’ লিখে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে প্রথম পক্ষের সন্তানদের বিরুদ্ধে। 

যার নামে বাড়িটি লিখে নেওয়া হয়েছে, সেই শফিউদ্দিন ফকির বেড়া উপজেলার কাজীরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পৈত্রিক সূত্রে উপজেলার রূপপুর ইউনিয়নের খানপুরা গ্রামে তিনি একটি বাড়ি পেয়েছেন।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বীর নিবাসের বাড়ি হস্তান্তরযোগ্য নয়। কিন্তু এখানে প্রশাসনিক বাধা আসেনি। উল্টো আইনি ব্যবস্থা নেবেন না, এমন কথা লিখে নেওয়া হয়েছে হালিমার কাছ থেকে। 

শফিউদ্দিনের বড় ভাই উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। ‘বীর নিবাস’ বরাদ্দের ক্ষমতা যে কমিটির হাতে, তিনি সেই কমিটির সদস্য। 

বাবার নামে জমি সৎ মাকে বরাদ্দ, আর সেটি ‘অবৈধভাবে’ ছোট ভাইয়ের নামে লিখে দেওয়ার কাজটিতে কোনো অনিয়ম দেখেন না রফিকুল। 

তবে বাড়িটি লিখে নেওয়ার কাজটি হয়েছে যাদের উপস্থিতিতে, তাদের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু বিষয়টি তখন বুঝতে পারেননি বলে জানান।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলাম মোহন বলেছেন, “পুরো প্রক্রিয়াটিই অবৈধ হয়েছে।” 

মুজিববর্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামে সারাদেশে ৩০ হাজার একতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে সরকার। 

বরাদ্দ নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি আবাসন কিংবা ভূমির সুবিধা পাননি এমন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা পরিবার ‘বীর নিবাস’ এর বরাদ্দ পাবেন। যুদ্ধাহত, প্রতিবন্ধী হলে অগ্রাধিকার পাবেন। পাশাপাশি আবেদনকারীকে অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হতে হবে। 

নীতিমালা অনুসারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি ও সমাজসেবা কর্মকর্তা সদস্যসচিব হিসেবে বরাদ্দ কমিটি করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বাছাই করবেন। 

বেড়া উপজেলায় নির্মাণ শেষে বাড়ি এখন হস্তান্তরের অপেক্ষায়। তার আগেই ঘটে গেছে এত কিছু।

মৃত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর বাড়ির মালিকানা যেভাবে সৎ ছেলের হাতে 

বেড়া উপজেলার কাজীরহাটে নির্মাণ হয়েছে বাড়িটি। সে বাড়ির পাশেই তিনতলা বাড়িতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন ফকিরের বড় ছেলে ও বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। 

শফিউদ্দিন জানান, বরাদ্দ কমিটির কাছে তারা মৃত বাবার নামে বীর নিবাসের বরাদ্দ চান। তাদের বাবার পৈতৃক জমিতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় তারা মাসুমদিয়া ইউনিয়নে জায়গা কেনেন। সেখানেই বীর নিবাসের বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। 

মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন ফকির বিয়ে করেছিলেন দুটি। এদের মধ্যে সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ও শফিউদ্দিন ফকিরের মা মারা গেছেন। 

নথিপত্র অনুযায়ী, দ্বিতীয় স্ত্রী হালিমা খাতুনের নামে বরাদ্দ হয় বাড়িটি। কিন্তু তিনি দখল পাননি।

হালিমার অভিযোগ, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে ‘চাপ দিয়ে’ দলিল করে নেন প্রথম পক্ষের সন্তানেরা। 

সরকারি চাকরি করেও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার ঘর কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে শফিউদ্দিন বলেন, “এ বিষয়ে ইউএনও স্যার বলতে পারবেন।” 

হালিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী হিসেবে বাড়ি প্রাপ্তিতে আমার অগ্রাধিকার রয়েছে। আমার নাবালিকা মেয়েও আছে। প্রথম পক্ষের ছেলেরা সরকারি চাকরি করে, তাদের অবস্থা ভালো।” 

তিনি বলেন, “বাড়ি বরাদ্দের কথা শুনে আমি ইউএনও অফিসে যোগাযোগ করি। কিন্তু তারা আমাকে বরাদ্দ দেয়নি, শফির নামে বাড়ি বরাদ্দ হবে বলে জানায়। পরে ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ রূপপুর ইউনিয়ন পরিষদে বৈঠক করে আমার মেয়ের নামে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে দলিলে সই করিয়ে নেয়। বাধ্য হয়েই তাদের সিদ্ধান্ত আমাকে মেনে নিতে হয়েছে।” 

দুই চেয়ারম্যানের ভাষ্য 

হস্তান্তর অযোগ্য বাড়ি কীভাবে লিখে নেওয়া হলো জানতে চাইলে রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলাম মোহন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বীর নিবাসের বরাদ্দ নেওয়ার পর আবুল হোসেন ফকিরের প্রথম পক্ষের ছেলেদের সঙ্গে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বিরোধ শুরু হয়। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান আমার পরিষদে উভয়পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। 

“সেখানে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নাবালিকা মেয়ের জন্য এক লক্ষ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও বিয়ের সময় সহযোগিতার শর্তে বীর নিবাসের মালিকানা প্রথম পক্ষের মেজ ছেলে শফিউদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।” 

চেয়ারম্যান মোহন নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। পুরো প্রক্রিয়াটিই অবৈধ বলে তিনি মন্তব্য করেন। 

বীর নিবাস হস্তান্তরের এই দলিলে সাক্ষী ছিলেন বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু। 

পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, “বৈঠকে আমি অসচ্ছল বিধবা স্ত্রীর বিষয়টি বুঝতে পারিনি। কিন্তু উভয়পক্ষ সমঝোতা করে স্ট্যাম্প করে। সেখানে সবার অনুরোধে আমি সাক্ষী হিসেবে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেছি। এতকিছু না বুঝে, সবাই চেয়েছেন তাই আমিও স্বাক্ষর করেছি।”

সমাজসেবা কর্মকর্তা যা বলছেন 

সৎ মায়ের নামে বরাদ্দ বাড়ি ছোট ভাইয়ের নামে লিখে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের কাছে জবাব মেলেনি। 

তিনি বলেন, “বীর নিবাসের জন্য আবেদন কম ছিল। আবার যারা আবেদন করেছিল অনেকেরই প্রয়োজনীয় জমি নেই। আমার পরিবারে বীর নিবাস বরাদ্দ আমি একা দেইনি। কমিটি যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটি কমিটির বিষয়।” 

বীর নিবাস বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুর আলী বলেন, “কোনো অনিয়ম করে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, সবার মতামতের ভিত্তিতেই সব হয়েছে। কমিটি তো তার ছেলের নামে দিয়েছে।… শফিউদ্দিনের নিজের বাড়ি নাই। অসচ্ছল হিসেবেই তাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”

ছেলে পান কী করে, ওয়ারিশ সূত্রে পেলে তো তার স্ত্রীর পাওয়ার কথা। আর ছেলে তো সাবলম্বী; তার তো পাওয়ার কথা না – এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আর কিছু বলতে পারব না; যা হয়েছে নিয়ম অনুযায়ীই হয়েছে।” 

শফিউদ্দিন তো সরকারি চাকরিজীবী, তাহলে কীভাবে তার নামে বাড়ি লিখে নেওয়া যায় – এরও কোনো জবাব মেলেনি ইউএনওর কাছে। 

যোগাযোগ করা হলে পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, “সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা পরিবারের বীর নিবাস বরাদ্দ প্রাপ্তির সুযোগ নেই, বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”