“কে বা কারা ওখানে থাকছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের দ্রুত পুনর্বাসন করে হলেও শেরে বাংলার জন্মভবন রক্ষা করা জরুরি।”
Published : 27 Apr 2025, 04:32 PM
বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়ার মিয়া বংশের জমিদার বাড়িতে জন্মেছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক। শেরে বাংলার জন্মস্থানে তার বহু স্মৃতি থাকলেও তা এখন বিলুপ্ত প্রায়। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে তার জন্মভবনটি।
অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও ‘বাংলার বাঘ’ খ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জন্ম ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর। শৈশবের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন তার এ মামাবাড়িতে। তার জন্মস্থান সাতুরিয়ায় মিয়া বাড়ির সেই আঁতুরঘর ও দালান এখন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তার স্মৃতি রক্ষার্থে শুধু একটি শ্বেতপাথরের ফলক ছাড়া চোখে পড়ার মতো আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুর পর তাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা গেইট সংলগ্ন বর্তমান তিন নেতার মাজারে। সর্ব উত্তরে তিনি আর তার দক্ষিণ দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং সর্ব দক্ষিণে খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর।
এই জাতীয় নেতার জন্মভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গেজেটভুক্ত হলেও তাদের পক্ষ থেকে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, বাজেট স্বল্পতা এবং ভবনটিতে শেরে বাংলার আত্মীয়রা থাকায় অধিদপ্তরের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে।
প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো শেরে বাংলার জন্মভবনে এখন ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তার উত্তরসূরীরা। ফজলুল হকের স্মৃতি সংরক্ষণে এই এলাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শেরে বাংলার জন্মভবনকে ১৯৬৮ সালের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ আইন (১৯৭৬ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ভবনটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত ঘোষিত পুরাকীর্তি তালিকা অনুযায়ী বাড়িটিকে ২০১০ সালের ১৮ মার্চ গেজেটভুক্ত করা হয়।
ভবনটি কেন সংস্কার করা হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেরে বাংলার জন্ম ভবনটিই কেবল অধিদপ্তরের মালিকানায় আছে, আশপাশের জায়গা নয়। বাজেট স্বল্প থাকায় এই অর্থবছরও ওই জায়গায় সংস্কার করা যাবে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া কোথাও কাজ করা হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে সামনের বছর সংস্কারের ইচ্ছা আছে।”
তিনি বলেন, “সংরক্ষিত ভবনটিতে শেরে বাংলার আত্মীয়রা থাকায় অধিদপ্তরের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসন করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। অথবা সরকার চাইলে অন্য কোথাও জায়গা দিতে পারে তাদেরকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া এখন স্থগিত থাকায় অধিদপ্তর কিছু করতে পারছে না।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান মান্নু বলেন, “ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একই সময়ে মুসলিম লীগের সভাপতি ও ভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি বলেন, “প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণ আইন-১৯৭৬ এর ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো প্রত্নসম্পদের সুরক্ষার ঘোষণা করা হয়। ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এর মালিকানা। একই সঙ্গে ইউনেস্কোর কতগুলো প্রস্তাবিত ধারা এই আইনে যুক্ত হওয়ায় কালচারাল হেরিটেজ ঘোষণা হওয়া মানেই এর পুরোপুরি দায়দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও সরকারের।
“এ কারণে শেরে বাংলার জন্ম ভবনে কেউ মাটি খুঁড়লেও জেল-জরিমানা হবে। ভবনের কেউ কিছু পরিবর্তন করতে পারবে না। অধিদপ্তর কাউকে থাকার অধিকার দিলেও সেখানে কোনো কিছু পরিবর্তন করতে চাইলে আবার অনুমতি লাগবে।”
অধ্যাপক মান্নু বলেন, “শেরে বাংলার জন্মভবন এখন পৃথিবীর সবার সম্পদ। শেরে বাংলার জন্মগ্রহণের গল্পকে কেন্দ্র করে ওখানে একটি জাদুঘর বানানো উচিৎ। যেখানে সারাদেশ থেকে মানুষ দেখতে যাবে। কারণ বাংলাদেশে শেরে বাংলার প্রয়োজনীয়তা কোনোদিন ফুরাবে না।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের ঝালকাঠি জেলা সভাপতি ও পরিবেশকর্মী ইলিয়াস সিকদার ফরহাদ বলেন, “কে বা কারা ওখানে থাকছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের দ্রুত পুনর্বাসন করে হলেও শেরে বাংলার জন্মভবন রক্ষা করা জরুরি। এতো গুরুত্বপূর্ণ একজন জাতীয় নেতা যাকে বাদ দিয়ে উপমহাদেশের ইতিহাস লেখা যাবে না, অথচ তার জন্মভবন রক্ষায় সরকারের বাজেট নেই, লোকবল নেই এটা মানা যায় না।
“রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরসহ তিনটি স্থানকে সংরক্ষণ করা হয়েছে, কবি নজরুলের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। এভাবে শেরে বাংলার ক্ষেত্রে করাও খুবই জরুরি।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, “ঝালকাঠির রাজাপুরে শেরে বাংলার জন্মভিটা ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। যা সংরক্ষিত থাকা খুবই জরুরি। তবে সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এগুলোর দেখাশোনা করলেও বাজেট স্বল্পতা ও লোকবল সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না।
“এগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর শতভাগ ভরসা করলে হয় না। সংরক্ষণের জন্য প্রথমে এগিয়ে আসতে হয় স্থানীয় মানুষদের। তাদের সচেতন করা গেলে তারাই এগুলো বুক দিয়ে আগলে রাখেন।”
ঝালকাঠি জেলার বাসিন্দা গবেষক ও সাংবাদিক (নেক্সাস টেলিভিশন কারেন্ট অ্যাফেআর্স এডিটর) আমীন আল রশীদ বলেন, শেরে বাংলার জন্ম যে বাড়িটিতে, সেটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণে নিলেও সেভাবে দেখাশুনা বা যত্ন-আত্তি হয় না। এটি দুর্ভাগ্যজনক। স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ তার জন্ম ও মৃত্যুদিনকে কেন্দ্র করে একটি অনুষ্ঠান করা। বাড়িটিতে যারা থাকে তারা বৈধ বা অবৈধ যাই হোন তাদেরও দায়িত্ব এটিকে সংরক্ষণ করা।
“স্থানীয় প্রশাসন, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, সুশীল সমাজসহ স্থানীয়দের দায়িত্ব কেবল তার জন্ম-মৃত্যুদিনে না, সারাবছরই বাড়িটিকে খেয়াল করা।”