প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ‘সেন পরিবার’ জাতীয় সংসদের এই এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেছে।
Published : 26 Nov 2023, 07:21 PM
পাকিস্তান আমলে সেই সত্তরের নির্বাচন থেকে বলতে গেলে হাওর-ভাটির দুর্গম এলাকা দিরাই-শাল্লার আসনটি একচ্ছত্রভাবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দখলে ছিল। মোট আটবার তিনি সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। ‘বামপন্থার ঘাঁটি’ হিসেবে একদা পরিচিত এই এলাকায় তিনি সবার কাছেই ‘সেনবাবু’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
২০১৭ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর সেখানে সংসদ সদস্য হন তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা। একাদশ জাতীয় সংসদের তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচিত হন। ফলে বলা যায়, প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ‘সেন পরিবার’ জাতীয় সংসদের এই এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেছে।
এবার সেই আসনে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ থেকে এবার এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে।
দীর্ঘদিন পর এই আসনে এমন পরিবর্তনে আবার আলোচনায় ফিরে এসেছেন প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময় দিরাই-শাল্লা ছিল বাম রাজনীতির ঘাঁটি। সেখান থেকে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী অক্ষয় কুমারকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন ছাত্রনেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
সংসদে প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য ও বাগ্মিতা তাকে জাতীয়ভাবে পরিচিতি এনে দেয়। ধীরে ধীরে তিনি একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিবেচিত হতে থাকেন। তিনি ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি ও আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।
১৯৭৩ সনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদকে পরাজিত করে ন্যাপ থেকে নির্বাচিত হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেবার তিনি পেয়েছিলেন ৮০ হাজার ৮২০ ভোট ও আব্দুস সামাদ আজাদ পেয়েছিলেন ৪৫ হাজার ১৭২ ভোট। ১৯৭৯ সনে তিনি আবারও ন্যাপ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সনের জাতীয় নির্বাচনেও তিনি ন্যাপ থেকে নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সনের জাতীয় নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গণতন্ত্রী পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সনের ১২ জুনের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগদানের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভেদের কারণে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী নাসির উদ্দিন চৌধুরীর কাছে মাত্র ৫০৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
এই নির্বাচনে তিনি পেয়েছিলেন নৌকা প্রতীকে ৫৮ হাজার ৪৯৬ ভোট এবং নাসির উদ্দিন চৌধুরী লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছিলেন ৫৯ হাজার ভোট।
তবে এই সংসদেই পাশের বানিয়াচং-আজমীরিগঞ্জ আসনে তিনি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছিলেন।
২০০১ সাল, ২০০৮ সাল এবং ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। সবশেষ তিনি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন।
২০১৭ সালে তিনি মারা গেলে তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা নির্বাচিত হন। পরে একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও তার স্ত্রী বিজয়ী হন।
এবার এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ; যিনি পুলিশের আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছোট ভাই। তাদের বাবা আব্দুল মান্নান ছিলেন শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর।
স্বাভাবিকভাবেই চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মনোনয়ন পাওয়ায় তার শিবিরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। হাতশায় পড়েছেন জয়া সেনগুপ্তের অনুসারীরা।
শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ মো. অলিউল হক বলেন, “আমরা অর্ধ শতাব্দী ধরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে রাজনীতি করেছি। তার হাত ধরে এই আসনে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হয়েছে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই।
“তার স্ত্রী চাইলে তাদের সন্তান সৌমেন সেনকে সামনে নিয়ে আসতে পারতেন। সৌমেনের দুই উপজেলাতেই গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কিন্তু তিনি সেটা না করেই নিজেই নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলেন। তবে বয়সের কারণে তিনি বাদ পরেছেন।
অলিউল হক আরও বলেন, “এবার নেত্রী যাকে প্রার্থী করেছেন তিনিও পরীক্ষিত আওয়ামী পরিবারের সন্তান। রাজনীতির পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদাও আছে তার। আগামীতে সুরঞ্জিতের আসনে তিনিই আমাদের এমপি হবেন।”
শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, “জয়া সেনগুপ্তা ছিলেন বয়সের ভারে ন্যূব্জ। তিনি দুইবার এমপি হলেও বয়সের কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না। এই সুযোগে উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকায় আল আমিন চৌধুরী নিরবে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সেই মূল্যায়নই করেছেন।”
দিরাই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা মোহন চৌধুরী বলেন, “আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এখন সেই শূন্যতা পূরণ করতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি আল আমিন চৌধুরী। যোগ্য লোকই এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। আমরা ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ তাকে নিয়ে কাজ করে নৌকাকে বিজয়ী করব।”
সেন পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়ের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “আমি পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের মানুষ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন আমার প্রেরণা। নেত্রী আমাকে নৌকা প্রতীক দেওয়ায় এলাকার মানুষ খুশি।
“আমি দিরাই-শাল্লা আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে নৌকাকে বিজয়ী করে নেত্রীকে এই আসন আবারও উপহার দেব।”