বন বিভাগ জানিয়েছে, সুন্দরবনের কুমিরের জীবনাচরণ ও গতিবিধি জানতে সম্প্রতি চারটির শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়।
Published : 13 Apr 2024, 08:04 PM
গ্রামের এক ছোট্ট পুকুরে কুমির এসেছে। এ খবরে শুক্রবার সকাল সেই পুকুর ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়।
হবেই বা না কেন? বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার নিভৃত পল্লী বাংলাবাজারে কুমিরের দেখা পাওয়া সবার কাছেই বিষ্ময়ের।
এলাকার প্রবীণরাও জানালেন, এই গ্রাম বা পাশে মধুমতি নদীতে কুমির দেখা গেছে বা কুমির এসেছে এমনটা তারা কখনো শোনেননি।
তাহলে কুমিরটি এল কোথায় থেকে? বন বিভাগ জানাচ্ছে, শত কিলোমিটার দূরের সুন্দরবন থেকেই জনপদে চলে এসেছে কুমিরটি। এক মাস আগে গবেষণার জন্য সুন্দরবনের নদী-খালে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে চারটি কুমির ছাড়া হয়েছিল। এটি তার একটি।
চিতলমারীর কলাতলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ঈদের রাতে (বৃহস্পতিবার) স্থানীয় কয়েক যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। হেডলাইটের আলোতে তারা প্রথম কুমিরটি দেখতে পায়। এর মাথায় কিছু একটা লাগানো ছিল। তারা তখন ওই কুমিরের ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন।
পাশের মধুমতি নদী থেকে রাস্তায় উঠে পড়েছিল কুমিরটি। রাস্তার পাশে একটি খালও ছিল। কয়েকজন কুমিরটিকে তাড়া দিলে সেটি দ্রুতই পাশের ওই পুকুরে গিয়ে নামে।
পরে এই খবর স্থানীয়দের মাঝে ছড়ায়, ফেইসবুকে ঘুরতে থাকে সেই ছবি আর ভিডিও। শুক্রবার ভোর থেকে বিভিন্ন এলাকার লোকজন কুমির দেখতে পুকুর পাড়ে ভিড় জমায়।
পরে স্থানীয় প্রশাসনসহ বন বিভাগের কর্মীরা সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। সন্ধ্যার দিকে পুকুরের পানি সেচে জালের সাহায্যে কুমিরটিকে ধরা হয়। বনবিভাগের কর্মীরা কুমিরটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা কার্যালয়ের বিভাগীয় বন সংরক্ষক (ডিএফও) নির্মল কুমার পাল বলেন, “কুমিরটি সুস্থ আছে। তাকে খুলনার বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেসকিউ সেন্টারে নেওয়া হয়েছে। এটিকে সুন্দরবনের গভীরের ঝাপসি বা করাপুটিয়া এলাকার অবমুক্ত করা হবে।”
কয়েকশ মাইল ঘুরে মধুমতিতে
বন বিভাগ জানিয়েছে, জীবনাচরণ ও গতিবিধি জানতে সম্প্রতি সুন্দরবনের চারটি কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়। মাথার উপর বসানো এই স্যাটেলাইট ট্যাগ যুক্ত কুমির ছাড়া হয়েছিল সুন্দরবনে নদী ও খালে।
করমজলের এই কুমিরটি সুন্দরবনের জোংড়া খালের মুখে ছাড়া হয়েছিল। সুন্দরবনের পশুর নদ ধরে কুমিরটি বন থেকে বের হয়। এরপর মোংলা নদী ধরে রামপাল হয়ে পিরোজপুর চলে যায়। সেখানে তুশখালী বলেশ্বর, কঁচা নদী হয়ে সন্ধ্যা ও কালিগঞ্জা নদী পার হয়ে কুমিরটি মধুমতি নদীতে যায়।
এভাবে বেশ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন নদী খাল ঘুরে গেল প্রায় এক সপ্তাহ ধরে কুমিরটি অবস্থান করছিল গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাটের সীমান্তবর্তী মধুমতি নদীতে।
বিভাগীয় বন সংরক্ষক (ডিএফও) নির্মল কুমার পাল বলেন, ১৩ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ সুন্দরবনের করমজল কেন্দ্রের দুটি, যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ির একটি পার্ক থেকে উদ্ধার একটি এবং সুন্দরবনের প্রকৃতি থেকে ধরা একটি- মোট চারটি কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে সুন্দরবনে ছাড়া হয়। এর মধ্যে যে কুমিরটি ধরা পড়েছে, এটি করমজল কেন্দ্রে কুমির দম্পত্তি রমিও-জুলিয়েটের বাচ্চা। এটির বয়স হবে ৮-১০ বছর।
“সুন্দরবনের কুমিরের উপর গবেষণা করতেই শরীরে স্যাটেলাইট ট্যাগ বসানো হয়। সুন্দরবনের নদীতে ছাড়া চারটি কুমিরের মধ্যে করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পুরুষ কুমির জুলিয়েটও ছিল। তবে জুলিয়েটসহ অন্য তিনটি কুমির এখনও সুন্দরবনেই আছে “ বলেন ডিএফও।
কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে নদীতে অবমুক্ত করার কাজটি যৌথভাবে করছে বনবিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। তাদের সহযোগিতা করছে জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (জিআইজেড)।
কেন এই গবেষণা
বন থেকে কুমিরটি লোকালয়ের দিয়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে আইইউসিএনের ম্যানেজার সারোয়ার আলম দীপু সাংবাদিকদের বলেন, সুন্দরবনের নদী থেকে কুমিরটি এমন দূরে যেতেই পারে। নদীতে তো আর বেড়া নেই। কুমির বিচরণ করবে, ছাড়ার পর থেকেই এটি ঘুরছিল।
“সুন্দরবনের কুমির কোথায়, কীভাবে বিচরণ করে তা নিয়ে বিস্তারিত কোনো গবেষণা আগে কখনো হয়নি। সে জন্যই স্যাটেলাইট ট্যাগ বসিয়ে এই গবেষণাটি করা হচ্ছে। সারাবিশ্বেই পাখি, কচ্ছপ, নেকড়েসহ বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে তাদের আচরণ নিয়ে গবেষণার নজির রয়েছে। তবে কুমির নিয়ে এমন গবেষণা দেশে এই প্রথম হচ্ছে।
বন বিভাগ ও গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইল্ড লাইফ কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠান কুমিরের শরীরে লাগানো এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার কিট তৈরি করেছে। পানির নিচে গেলেও এটির কোনো ক্ষতি হয় না। কুমিরের শরীরে বসানো এ ট্রান্সমিটার কিটটির মেয়াদ এক বছর। শরীরে বসানোর পর তা সংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তথ্য ম্যাপের মাধ্যমে দিতে থাকে। ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্রে একটি ক্ষুদ্র অ্যান্টেনা আছে। যার মাধ্যমে এটি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
কুমিরের মাথার ওপরের অংশে আঁশের মতো একটি স্কেল থাকে। সেখানে ছোট একটি ছিদ্র করে ওই স্যাটেলাইট ট্যাগটি বসানো হয়। এই চিপটি খুব হালকা। ওজন দুই গ্রামেরও কম। এই ধরনের স্যাটেলাইট চিপ বসানোর কারণে কুমিরের ক্ষতি হয় না।
আইইউসিএন কর্মকর্তা সারোয়ার আলম দীপু বলেন, “কুমিরটি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালির নদী পর্যন্ত যাওয়ার পর আবার ফিরে আসছিল। একদম সুন্দরবনের কাছাকাছি চলে আসছিল। তারপর আবার উপরের দিকে আসছে।”
বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনে কুমির ছাড়া হয়েছে। বনের করমজল কেন্দ্রে ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চাগুলো একটু বড় হলে মাঝে মাঝেই বনবিভাগ এগুলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করে। এর আগেও বনে ছাড়ার পর লোকালয় থেকে কুমির উদ্ধার হয়েছে।
বনে ছাড়ার পর এবারও স্যাটেলাইটযুক্ত কুমির বন থেকে উপরের দিয়ে উঠে আসার ঘটনা দেখা গেল। এটি গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে মনে করছেন গবেষণা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।