Published : 30 Apr 2025, 03:23 PM
ফরিদপুরে আরও একমাস আগেই মাঠ থেকে পেঁয়াজ উঠানো শেষ করেছেন চাষিরা। কিন্তু এখনও পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর পাননি তারা, ফলে কমদামে ফসল বিক্রি করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন অনেকে। একই সঙ্গে এসব ঘরের নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগের মধ্যে আছে, যোগ্য কৃষকদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের বরাদ্দ দেওয়া, ডিজাইনে পরিবর্তনসহ নানাভাবে প্রতিটি ঘরের প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ হাতিয়ে নেওয়া। এছাড়া ঘর বরাদ্দ পাওয়া কৃষকদের প্রশিক্ষণের টাকাও নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে।
সালথা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সুদর্শন শিকদার বলেন, “মডেল ঘর পাওয়ার জন্য সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে ৭০ জন কৃষক আবেদন করেন। কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে ৩০ জন কৃষকের নাম প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়।
“কিন্তু এই তালিকা থেকে কাউকেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এছাড়া কারা এসব ঘর পেয়েছে সে বিষয়েও আমাদেরকে অবগত করা হয়নি।”
জানা গেছে, ফলন ও দাম ভাল হওয়ায় প্রতিবছরই সালথায় পেঁয়াজের আবাদ বাড়ছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে যার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়।
এ অবস্থায় প্রান্তিক পেঁয়াজ চাষিদের দাবির মুখে পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণের উদ্যেগে নেওয়া হয়।
এর অংশ হিসেবে এ বছর কৃষিবিপণন অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে সালথায় ৪৫টি মডেল ঘরের বরাদ্দ দেওয়া হয়।
পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে টিন-বাঁশ, লোহা ও কংক্রিটের সমন্বয়ে নির্মাণ করা প্রতিটি ঘরের আয়তন প্রায় ৩৭৫ বর্গফুট। চাষির ঘর বাড়ির উঠান বা ফাঁকা জায়গায় মাত্র এক শতাংশ জমিতে ঘরগুলো তৈরি করা হচ্ছে।
এসব ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ৬টি বায়ু নিষ্কাশন পাখা সংযুক্ত রয়েছে। মূলত ভ্যান্টিলেশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণেই সংরক্ষিত পেঁয়াজ পচবে না। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য প্রতিটি ঘরে হাইগ্রোমিটার রয়েছে।
প্রতিটি ঘরে সংরক্ষণ করা যায় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ মণ পেঁয়াজ। আলাদা আলাদা স্তরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন অন্তত পাঁচজন কৃষক। এ ঘরে নয় মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ ভালো থাকে।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ফরিদপুরের মেসার্স জাকির অ্যান্ড ব্রাদার্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৭ শতাংশ লেস দিয়ে এই ঘরগুলোর কাজ শুরু করেন। চলতি বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে ঘরের কাজ শেষ করার কথা।
এখনও একটি ঘরের কাজও সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এমনকি কিছু কিছু ঘরের কাজ এখনো শুরুই করা হয়নি। অভিযোগ আছে- ঠিকাদার ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণেই এখনো ঘরগুলোর কাজ শেষ হয়নি।
সালথা উপজেলার যদুনন্দি ইউনিয়নের কাজীপাড়ার হিরু শেখের ছেলে মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমি এই বছর ৬-৭শ মন পেঁয়াজ পেয়েছি। পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশীয় মডেল ঘরের আশায় আমি পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করিনি।
“কিন্তু ঘরের ঠিকাদারের চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় আমার ঘরের কাজ এখনো শুরু করা হয়নি। তাই আমি বাধ্য হয়ে কম দামে পিঁয়াজগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। এতে আমার কয়েক লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
এদিকে সালথা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের নাম পাঠালেও সে তালিকার কোনো কৃষক পাননি ঘর।
অভিযোগ উঠেছে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী ও আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিনের যোগসাজশে ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে তাদের পছন্দ মতো চাষিদের এ সকল সরকারি ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন।
স্থানীয় গট্টি ইউনিয়নের কানইড় গ্রামের এক চাষি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমি ১০ হাজার টাকা খুশি হয়ে শাহজাহান স্যারকে দিয়েছি। অন্যরা ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিয়ে ঘর পেয়েছে।”
রামকান্তুপুর ইউনিয়নের নারানদিয়া গ্রামের আজিজ মাতুব্বরের ছেলে শাহিদ মিয়া বলেন, “টাকা ছাড়া কি ঘর পাওয়া যায়? ঘর পেতে ৫০ হাজার টাকা লাগে।”
তবে টাকাটা কাকে দেওয়া লাগবে তার নামটি বলেননি এই কৃষক।
বল্লভদী ইউনিয়নের পশ্চিম পিশনাইল গ্রামের আক্কাস মোল্যার ছেলে নান্নু মোল্যা বলেন, “ঘরের সকল খরচ সরকার বহন করার কথা থাকলেও মিস্ত্রি খাবারের খরচ আমাদের বহন করা লাগতেছে। এছাড়া আমরা ঘরের ফ্লোরে বালু না দেওয়া পর্যন্ত ঠিকাদারের লোক কাজে আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তাই ঘরের ফ্লোরের বালুও আমরা দিয়েছি।”
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকির অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাকির হোসেন বলেন, “আমরা কোনো অতিরিক্ত টাকা পয়সা নিচ্ছি না। মিস্ত্রিদের খাওয়াচ্ছে ওই কৃষক নিজে স্বেচ্ছায়। আর যে সকল ঘরে বেশি বালু লাগছে সেই ঘরে ওই কৃষকই বালু ফেলে দিচ্ছে এবং যে ঘরগুলোতে বেশি মেটেরিয়ালস খরচ হচ্ছে সেই বেশি মেটেরিয়ালস এর টাকাগুলো কৃষকদেরকে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ঘরগুলো সমতল জায়গায় করার কথা ছিল। অনেক কৃষক সমতল জায়গায় ঘর করছেন না বিধায় এই সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে।”
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা কৃষি অফিসের একাধিক মাঠ কর্মী বলেন, ৪৫টি মডেল ঘরের আওতায় ৪৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া কথা। প্রশিক্ষণ বাবদ প্রতি কৃষকের জন্য ১ হাজার করে টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সেই হিসাবে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন।
কিন্তু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জনকে। অতএব কৃষকদের প্রশিক্ষণ বরাদ্দ থেকেই অন্তত চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, “সালথায় সরকারি ঘর বরাদ্দের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকায় আমরা সবাইকে ঘর দিতে দিতে পারি নাই। তাই আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।
“এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না। আরও কিছু জানার দরকার হলে প্রকল্প পরিচালককে ফোন করেন। কারণ তিনি নিজে এই এলাকায় এসে কৃষকদের বাড়িতে গিয়ে যাচাই-বাছাই করে ঘরগুলো দিয়েছেন।
“খোঁজ নিয়ে দেখেন আমি অনেকের বাড়িতে গিয়ে পানি পর্যন্ত খাই না।”
ফরিদপুর জেলার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. শাহদাত হোসেনও এই বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গেই কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন।
আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, “টাকা-পয়সা নিয়ে ঘর দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। টাকা পয়সা নিয়ে ঘর দেয়ার ব্যাপারে আমরা অবগত নই।”
তিনি বলেন, “এই মডেল ঘরগুলো পাওয়ার জন্য গণ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। গণবিজ্ঞপ্তির প্রকাশ হওয়ার পরে কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যাচাই-বাছাই করে ঘরগুলো কৃষকদের সুবিধার্থে বিনামূল্যে দিয়েছি।”
হেলাল উদ্দিন বলেন, “আর আমাদের ডিজাইনের বাহিরে ঘর করা বা বাড়তি টাকা নিয়ে ঠিকাদার ঘর করে দিবে এই ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়ে যদি কোনো কৃষক আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।“
এখনো ঘর তৈরি না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী এই ঘরের কাজ ৩০ মার্চ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদার ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। তাও বিভিন্ন কারণে ঠিকাদার ঘর নির্মাণ শেষ করতে পারেননি। “
মূলত অর্থছাড়ে বিলম্ব হওয়ায় ঠিকাদার সময়মত কাজ শুরু করতে পারেনি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “আমাদের জানামতে ৭০ শতাংশ ঘরের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে।দ্রুতই কাজ শেষ করে কৃষকদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে।”
এসব বিষয়ে সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, “পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের মডেল ঘর বিতরণ, নির্মাণ ও টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।”