“সন্ন্যাসীরা এই পূজার সময়ে আধ্যাত্মিক জগতে চলে যায়। নিজেকে একদম ঈশ্বরের কাছে সঁপে দেয়। এ কারণে কোনো ব্যথাই অনুভব হয় না।”
Published : 15 Apr 2025, 11:03 AM
সবুজ চা বাগান ও উঁচু টিলার মাঝখানে খালি জায়গায় বসানো হয়েছে চড়ক গাছ। পিঠে বড়শির গেঁথে তাতে ঝুলছেন কেউ। উলুধ্বনি আর ঢাক, কাসর, শাঁখের শব্দে মুখরিত চারপাশ।
প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে সিলেট নগরীর লাক্কাতুরা চা বাগানে চড়ক বা বড়শি গাঁথা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠান হলেও এ আয়োজন দেখতে হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষদের ঢল নামে।
লাক্কাতুরা চা বাগানে সোমাবার বিকাল ৪টা থেকে পূজা শুরু হয়ে চলে দুই ঘণ্টা ধরে। পূজা দেখতে দুপুরের পর থেকেই নগরীর বাসিন্দারা লাক্কাতুরা চা বাগানে ভিড় করতে শুরু করেন।
৪০ বছর ধরে চৈত্র সংক্রান্তিতে লাক্কাতুরা চা বাগানে এই চড়ক পূজা হয়ে আসছে। মূলত লাক্কাতুরা চা বাগান দুর্গা মন্দির ও চা শ্রমিকদের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা উপলক্ষে বসে ‘চৈত্র মেলা’।
লাক্কাতুরা চা বাগান দুর্গা মন্দিরের পুরোহিত রনজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে চড়ক পূজার প্রচলন শুরু হয়েছিল। আমরা এখানে ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে এ পূজা করে এসেছি। প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুরুতে চড়ক পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলে মাসের শেষ দিন মূল পূজাটি হয়।”
দুর্গা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রক্ষা বিজয় ভট্টাচার্য বলছিলেন, “বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী, প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বা চৈত্রের শেষ দিনে চড়ক পূজা হয়। এটি দেবতা শিবের ‘গাজন উৎসব’ হিসেবেও পরিচিত। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। পূজাতে শিব ও কালির নৃত্যও করে দেখানো হয়। কয়েকটি ধাপে পূজার মূল আকর্ষণে থাকেন সন্ন্যাসীরা।”
লাক্কাতুরা চা বাগান দুর্গা মন্দিরের পুরোহিত ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ‘শৈব্য’ সম্প্রদায় বা শিব উপাসকরা এই পূজা করেন। পূজার নেতৃত্ব দেন একজন গুরু সন্ন্যাসী। তাই প্রতিবছরই পূজার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে গুরু সন্ন্যাসী তার দলবল নিয়ে এসে মন্দিরের আশপাশে অবস্থান নেন। চড়ক পূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব হচ্ছে ‘চড়ক ঘুরানো’। প্রায় ২৫-৩০ ফুট উঁচু সোজা একটি গাছকে ‘চড়ক গাছ’ বলা হয়। সারা বছর এ গাছকে পূজা স্থলের আশপাশের পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে তা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গাছটি উঠানো হয়। তারপর মাঠে চড়ক গাছটি পুঁতে পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু করা হয়।
গাছের আগায় কাঠের সঙ্গে দড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়। সন্ন্যাসীরা স্নান করে নতুন ধুতি পরে ‘মূল সন্ন্যাসীর’ কাছে মন্ত্র নেন। মন্ত্র শেষ হলে তাদের পিঠে লোহার বড়শি গেঁথে দেওয়া হয়। এরপর সে অবস্থায় বেঁধে রাখা কাঠের দুই প্রান্তে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
সোমবার পূজাস্থলে গিয়ে দেখা য়ায়, চড়ক ঘোরানোর আগে কয়েকজন পূজারী কালী সেজে নাচ করছেন। এরপর বিশাল দা হাতে সম্মিলিত শিব ও কালীর নাচ হয়। এর পরপরই লোহা দিয়ে তৈরি বড়শি বা শিক দুজনের শরীরের হাতের নিচের অংশে গেঁথে দেওয়া হয়। ওই অবস্থায় চড়কগাছে ঘোরানো হয় তাদের। সন্ধ্যায় আগে পূজার মূল আনুষ্ঠিকতা শেষ হয়।
বড়শি গেঁথে পূজা করতে গিয়ে ব্যথা হয় কি-না, বা কি অনুভূতি হয় জানতে চাইলে সন্ন্যাসীরা বলেন, প্রতিবছর এ সময়ে তারা নিজেদের ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। বড়শি গাঁথার আগে গায়ে কোনো কিছু মালিশ করেন না; এমনিতেই প্রস্তুত হয়ে যান। বড়শি গাঁথার আগে উপুড় হয়ে শুয়ে পরার পর থেকেই আর কোনো অনুভূতি থাকে না। প্রথমদিকে ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে উঠলেও এখন কিছু হয় না; রক্তাক্তও হন না। তবে শরীরে যে ক্ষতটা হয়, সেটা সারতে কিছুদিন সময় লাগে বড়জোর।
পুরোহিত রনজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “মন্ত্রের দ্বারা সাধকদের দেহে বড়শি গাঁথা হয়। এজন্য কোনো রক্তপাত হয় না। প্রতিবছর নতুন করে দুইজনের শরীরে বড়শি গাঁথা হয়। যে দুইজনের দেহে বড়শি গাঁথা হয়, তাদেরও কোনো সমস্যা হয় না। এই পূজাতে ২৫ থেকে ৩০ জন লাগে।”
তার ভাষ্য, “সন্ন্যাসীরা এই পূজার সময়ে অন্য এক আধ্যাত্মিক জগতে চলে যায়। নিজেকে একদম ঈশ্বরের কাছে সঁপে দেয়। এ কারণে কোনো ব্যথাই অনুভব হয় না। তারা আলাদা এক মানুষ হয়ে যায়।”
ভক্তরা বলেন, প্রতি বছর ঐতিহ্যবাহী চড়ক উৎসবের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে থেকে পূজারীরা ‘শিব-গৌরী’ সেজে নেচে-গেয়ে এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করেন। এ সময় তারা সারাদিন উপবাস থাকে এবং রাতে নিরামিষ খেয়ে পবিত্রতার সঙ্গে এ সন্ন্যাস ব্রত পালন করেন। চড়ক পূজার দুদিন আগে তারা স্থানীয় শ্মশানে গিয়ে পূজা করেন। এ সময় গৌরীর বিয়ে, গৌরীনৃত্য এবং বিভিন্ন সংগীত ও ঢাক-ঢোলের বাজনায় গোটা এলাকা উৎসবের আমেজ তৈরি হয়।
‘চা–শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির’ সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, “আমাদের চা বাগানে বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে গত প্রায় ৪০ বছর ধরে এই চড়ক পূজা হয়ে আসছে। এখানে সন্ন্যাসীরা যে নিজেদের পিঠে বড়শি গেঁথে নিজেকে শিবের কাছে সমর্পণ করেন। এতে তাদের শারীরিক কোনো কষ্ট মেলে না; এমনকি রক্তপাতও হয় না।
“প্রতি বছরের মত এবারও বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে চড়ক পূজার আয়োজন করা হয়েছে। এ আয়োজনে সব ধর্মের মানুষ যাতে আনন্দ-উৎসবে মিলিত হতে পারে, এটাই আমাদের মূল সিদ্ধান্ত। চা বাগানের যুবসমাজ এই পূজা আয়োজন করেন। তবে পঞ্চায়েতের লোকজন ও গণমান্য ব্যক্তিরা এতে সার্বিক সহযোগিতা করেন। এখানে উৎসবের দিনে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ জড়ো হন।”
তিনি বলেন, “শিব ভক্তরা এই চড়কের সাধক। তারা মাসব্যাপী ধ্যান ও নানা প্রচেষ্টায় চড়কে উঠে বড়শি গাঁথানোর বিষয়টি রপ্ত করেন। সকল ধর্মের লোকজন এই পূজা উপভোগ করছে, এটাই আমাদের জন্য খুশির খবর।”
চড়ক পূজা দেখতে আসা রবিন দাস বলেন, “আমি এই প্রথম চড়ক পূজা দেখতে এলাম। এখানে এসে দেখলাম ভক্তরা খুব উল্লাস করছেন; আনন্দে মেতে রয়েছেন। খুব শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজাটা হচ্ছে। হুকে বিদ্ধ করে মানুষ ঘোরানোর ব্যাপারটা অদ্ভুদ। কিন্তু আমরা সবাই খুব আনন্দিত।”
মিহির দেব নামের আরেকজন বলেন, “আসলে চড়ক পূজা আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখছি। এক সময় এই পূজাকে কেন্দ্র করে নগরীর চালিবন্দর এলাকায় বিশাল মেলার আয়োজন করা হতো। কিন্তু জায়গা সংকটের কারণে কিছু বছর ধরে সেখানে মেলাটি আয়োজন করা যাচ্ছে না। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এটাকে আমরা চৈত্র সংক্রান্তির চৈত্র মেলা বলি।
“এই পূজায় সন্ন্যাসীদের শরীরে বড়শি গাঁথা হলেও তাদের কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না কিংবা এর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও নেই। এ দিনটায় আমরা সবাই মিলিত হয়ে আনন্দ-উৎসব করি।”
প্রতি বছরের মতো এবারও চড়ক পূজার মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এতে শিশুদের খেলনা, হস্তশিল্প পণ্য ও খাবারের দোকানসহ নানা পণ্যের সমারোহ দেখা গেছে।
এছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও পণ্যের স্টলও রয়েছে মেলায়।