সবকিছু ছাপিয়ে জুলাই-অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বদলে দিয়েছে বাংলাদেশকে।
Published : 31 Dec 2024, 10:40 PM
ইতিহাসের খেরোখাতায় ২০২৪ চিহ্নিত হয়ে থাকবে আরো একটি বাঁক বদলের বছর হিসেবে, অগ্নিগর্ভ যে বছরে বাংলাদেশ যাত্রা করেছে নতুন গন্তব্যের পথে।
শুরুটা হয়েছিল আরো একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দিয়ে, সময় যত গড়িয়েছে, চেনা অচেনা ঘটনা-দুর্ঘটনায় নিজের রূপ স্পষ্ট করেছে ২০২৪।
বছরের শেষে এসে ভুগিয়েছে ডেঙ্গু, কিন্তু জিনিসপত্রের লাগামহীন দাম ভুগিয়েছে সারা বছর।
হানা দিয়েছে নজিরবিহীন বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ; আবার অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে বহু প্রাণ।
সবকিছু ছাপিয়ে জুলাই-অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বদলে দিয়েছে বাংলাদেশকে। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের প্রশ্নবিদ্ধ শাসনের অবসান ঘটেছে, ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শাসক শেখ হাসিনা।
বলা হচ্ছে এটা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, বলা হচ্ছে এটা ‘নতুন বাংলাদেশ’। খোল নলচে পাল্টে সেই নতুন বাংলাদেশকে আকৃতি দিতে চলছে সংস্কারের মহাযজ্ঞ।
অস্থির এ সময় পেরিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় পৌঁছাতে যে নির্বাচন দরকার, তার সুনির্দিষ্ট তারিখ জানাতে পারেনি ২০২৪। তবে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর ধারণা দিয়েছে, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে হতে পারে কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচন।
তার আগে নতুন বছরেও বাংলাদেশের সঙ্গী হবে অর্থনীতির ভগ্নদশা। বাজার দরের সঙ্গে জীবনকে মানিয়ে নেওয়ার আপস করতে করতেই ২০২৫ সালকে স্বাগত জানাবে আশায় বুক বাঁধা বাংলাদেশ।
‘ডামি আর আমি’
টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার মধ্যে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ সরকার। এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মত সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার শঙ্কা ছিল শুরু থেকেই। আওয়ামী লীগের আরেকটি সাজানো নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্যে বিএনপিসহ ২৬টি দল ভোট বর্জন করে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়।
ভোট অংশগ্রহণমূলক দেখাতে ‘ডামি’ প্রার্থীদের জন্য পথ খুলে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়নের বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থীরা দাঁড়িয়ে যান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। অধিকাংশ আসনে ভোট হয় আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের। অনেকে বলতে শুরু করেন, এটা আওয়ামী লীগের ‘ডামি আর আমি’ নির্বাচন।
সব মিলিয়ে ভোটার উপস্থিতির কম হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। ৭ জানুয়ারি দিন শেষে ৪০% ভোটার উপস্থিতির তথ্য জানানোর পর নির্বাচন কমিশনকেও তোপের মুখে পড়তে হয়। ২৯৮ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২, জাতীয় পার্টি ১১, স্বতন্ত্র ৬২, জাসদ ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি ১টি আসন পায়।
৭ জানুয়ারির ভোটে জিতে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড গড়েন। আগের তিন মেয়াদে সব আন্দোলন দমিয়ে দিতে পারলেও জুলাই-অগাস্টের গণ অভ্যুত্থানে তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
৩৬ জুলাইয়ের উপাখ্যান
আন্দোলনের শুরুটা ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল বা সংস্কারের দাবিতে। সেদিন ছিল ১ জুলাই, আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এরপর ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্যে আগুনে যেন ঘি পড়ে। তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরির কোটা) পাবে?”
ওইদিন গভীর রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মিছিল বের হয়। সেখানে স্লোগান ওঠে, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’। এরপর থেকে সহিংস হয়ে ওঠে পরিস্থিতি।
আন্দোলন দমাতে আলোচনার পথে না গিয়ে সরাসরি ‘গুলি’, ডিবি অফিসে ধরে এনে নির্যাতনের মত বিষয়গুলো ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয় দেশজুড়ে। একদিকে রক্ত ঝরতে থাকে রাজপথে, আরেকদিকে আন্দোলনে জমায়েত বড় হতে থাকে।
পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না দেখে আলোচনার প্রস্তাব দেয় সরকার। আন্দোলনকারীরা তাতে সাড়া না দিলে সহিংসতা মারাত্মক রূপ পায়। জারি করা হয় কারফিউ, মাঠে নামে সেনাবাহিনী। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট।
কিন্তু তাতে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পুরো দেশ। কোটা সংস্কারের আন্দোলন পরিণত হয় শেখ হাসিনার পতনের ১ দফার আন্দোলনে।
শেখ হাসিনার পতনের আগের দিনও চোটপাট দেখিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ঘুণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেননি, তাদের পতন আসন্ন।
৫ অগাস্ট ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঢাকামুখী রোডমার্চ। সেদিন সকালেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মাঠে নেমে পুলিশের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারী ওপর হামলা ও গুলি চালায়।
উত্তরায় সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের পথ ছেড়ে দিলে শেখ হাসিনার সরকারের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। ঢাকার পথে পথে শুরু হয় জনস্রোত। তার মধ্যেই খবর আসে, পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন ১৫ বছরের শাসক শেখ হাসিনা, তার গন্তব্য ভারত।
উন্মত্ত জনতা গণভবনের দখল নেয়, চলে ভাংচুর, লুটপাট। সংসদ ভবনেও দেখা যায় একই চিত্র। ফিরে আসে কলম্বোর গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতি।
ছাত্ররা বলেছিল জুলাই মাসেই শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করবে তারা। ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে তারা নতুন হিসাব শুরু করে। ৫ অগাস্ট হল সেই ৩৬ জুলাই।
সবচেয়ে বেশি দিনের শাসক, এখন ফেরারি আসামি
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফেরেন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এরপর দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ চালিয়েছেন টানা সাড়ে পনের বছর। তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নিজের অধীনেই একের পর এক নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে গেছেন। সবশেষ ২০২৪ এর জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে সরকার গঠন করেন।
বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় সরকারের ভেতর-বাইরে তৈরি হয় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। তার বক্তব্যেও তার ছাপ পড়ে।
২০২২ সালের অগাস্টে ‘পলায়নের মনোবৃত্তি আওয়ামী লীগের নেই বলে’ মন্তব্য করে বিএনপির উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, ‘ভোট চুরির’ কারণে দুইবার যাদের নির্বাচন বাতিল হয়েছে, তাদের মুখে ‘এত লম্বা কথা’ আসে কীভাবে?
আওয়ামী লীগ সভাপতি সেদিন বলেন, “বিরোধী দল সংসদে না থাকলেও তারা বক্তব্য দেয়- আমাদের নাকি পালানোর কোনো পথ থাকবে না। আমি এমন বক্তব্যদাতাদের উদ্দেশে বলতে চাই- শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ কখনও পালায় না।”
একইরকমভাবে তিনি নিজের অবস্থান ফের জানান দেন চলতি বছরের জুলাইয়ের আন্দোলনে। তার ‘পালিয়ে যাওয়ার’ সম্ভাবনা নিয়ে বিরোধীদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা পালায় না। আমার ফ্রান্সে যাওয়ার কথা, ব্রাজিলের যাওয়ার কথা, আমি ক্যানসেল করে দিয়েছি।”
বারবার ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলে দম্ভোক্তির মধ্যেই প্রবল আন্দোলনে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনাকে পালাতে হয়েছে ভারতে। বাংলাদেশ সরকার তার লাল পাসপোর্ট বাতিল করেছে, অন্যদিকে ভারত সরকার তাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিলেও ভারতের বাইরে অন্য কোনো দেশে যাওয়া তার জন্য সহজ নয়।
স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তার বিকল্প ছিল যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়। ওই দরজা সম্ভবত বন্ধ থাকায় দিল্লিতেই বাস করছেন তিনি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের তথ্য অনুযায়ী, দিল্লির লুটিনস বাংলো জোনের একটি সুরক্ষিত বাড়িতে থাকছেন শেখ হাসিনা। ভারত সরকারই ওই বাড়িতে তার থাকার বন্দোবস্ত করেছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এ সময়ে তার সরকারের বিরুদ্ধে ‘স্বৈরাচারী’ শাসন, বিরোধীদের দমন এবং নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। হত্যা ও গুমের মামলাও হচ্ছে এখন।
ক্ষমতার পালাবদলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা এখন ফেরারি আসামি। ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ ও ‘গণহত্যার’ অভিযোগে তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকও তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
সরকার পতনের পর এক মাসেই বিগত সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে প্রায় পৌনে তিনশ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম প্রকাশ করে আসামি করা হয়েছে ২৬ হাজারের বেশি মানুষকে; অজ্ঞাতপরিচয় আসামি রয়েছে দেড় লাখের ওপরে।
ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ কার্যত ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে। দলের অনেক নেতা কারাগারে, অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। বিদেশে কারও কারও উপস্থিতি মিলছে। ভার্চুয়ালিও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যুক্ত হওয়ার খবর মিলছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে বলতে হয়েছে, দেশের ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ প্রয়োজন হলে বিএনপির সঙ্গে একযোগে কাজ করতেও তার দল প্রস্তুত।
জানুয়ারিতে দণ্ডিত আসামি, অগাস্টে রাষ্ট্রক্ষমতায়
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২৪ সালের প্রথম দিনই মিলেছিল আদালতের ছয় মাসের দণ্ডাদেশ। কিন্তু মাত্র দুইশ বিশ দিনের ব্যবধানে দেশের হাল ধরতে প্যারিস থেকে ফিরলেন ঢাকায়। একজন শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ আর ‘গরিবের ব্যাংকার’ হয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ীর পরিচয়ের পর নতুন এক পরিচয় পেলেন মুহাম্মদ ইউনূস। শপথ নিলেন বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে।
ছাত্র জনতার প্রবল গণ আন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুহাম্মদ ইউনূসকে বিমানবন্দরে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় অর্ভ্যথনা।
সরকার পরিচালনার অংশ হওয়ার অভিজ্ঞতা ইউনূসের আগেও রয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে গত সাড়ে চার মাস ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশ পরিচালনায়।
ক্ষুদ্রঋণের ধারণাকে বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তার হাত দিয়ে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।
শান্তিতে নোবেল জয়ের পর বিশ্বজুড়ে দেশের সুনাম কুড়িয়ে আনা এ ব্যক্তিত্বকে কদিন আগেও কিছুদিন পর হাজির হতে হয়েছে আদালতের প্রাঙ্গণে। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে শ্রম আদালত ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়।
এরপর ৪ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তিনি পরিহাসের ছলে বলেন, “আজকের এ ছবিটা আপনারা তুলে রাখুন। দুর্নীতি দমন কমিশন ও বটতলার এটি একটি ঐতিহাসিক ছবি হয়ে থাকবে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এটি প্রকাশিত হবে। যুগ যুগ ধরে নানান বইতেও এটা প্রকাশিত হবে। আপনারা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবেন।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন একসময় প্রবল গণআন্দোলনে পরিণত হয়। ব্যাপক সহিংসতা ও গণদাবির মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। পদত্যাগ করে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান।
এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করলে তাতে সম্মতি দেন রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধানসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। রাজনীতিতে আসার অভিপ্রায় না থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার প্রধান হতে তিনি সম্মতি দেন।
সেই সময়ের কথা তুলে ধরে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, “ঘটনাপ্রবাহের অদ্ভূত পালাবদল। আমি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেওয়ার আগে প্যারিসে ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, আমি যদি ফিরে যাই, আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে, কারণ তিনি (শেখ হাসিনা) আমার ওপর ক্রোধান্বিত হবেন এবং আমাকে জেলে পাঠাবেন। তাই ভাবছিলাম ফিরতে দেরি করব কি না।
“হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে একটা ফোন পেলাম যে, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) দেশ ছেড়েছেন। আমরা চাই আপনি সরকারপ্রধান হন।’ এটা ছিল একটা বড় চমক।”
রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সব মামলায় আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। একাধিকবার তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে যোগদান বা ভোট করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। বাংলাদেশে ‘নতুন বাংলাদেশে’ পরিণত করতে সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাই তিনি করে যাচ্ছেন।
অবশেষে মুক্তি
বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি, অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলের চার দশকের নেতা। আওয়ামী লীগের সময়ে দুর্নীতির মামলায় তাকে পাঠানো হয়েছিল কারাগারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মুক্তি এনে দিয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই বছরের অক্টোবরে হাই কোর্টে আপিল শুনানি শেষে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও আরও সাত বছরের সাজা হয় তার।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। ওই বছরের ২৫ মার্চ গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফেরেন খালেদা। কিন্তু তিন শর্তের পাকে পরের চারটি বছর তার জীবন আবদ্ধ থাকে ওই বাসায় আর হাসপাতালের মধ্যে।
৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পরদিনই রাষ্ট্রপতির আদেশে দণ্ড মওকুফ করে খালেদা জিয়াকে ‘পুরোপুরি’ মুক্তি দেওয়া হয়। পরে এক মামলায় তিনি উচ্চ আদালত থেকেও খালাস পান। অন্য মামলার ক্ষেত্রেও একই রায় আসবে বলে আশায় আছেন বিএনপি নেতারা।
গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যান বিএনপি চেয়ারপারসন। ছয় বছর পর প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাকে।
আগামী ২১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশেও অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে খালেদা জিয়ার। সেক্ষেত্রে অর্ধযুগ পর প্রথম কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সশরীরে দেখা যাবে তাকে।
দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনি, ডায়াবেটিসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন ৭৯ বয়সী সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী; চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়ারও প্রস্তুতি চলছে। যুক্তরাজ্য হয়ে তার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা, তবে সেই দিন তারিখ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
চাপে চুপ্পু
গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই রাতেই বঙ্গভবনে বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা, তিন বাহিনীর প্রধান, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
এরপর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আভাসও দেন।
ওই ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন,”প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।”
পরদিন বঙ্গভবন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও সংসদ বিলুপ্ত করার কথা জানানো হয়। আগের দিনের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দণ্ড মওকুফ করে ‘মুক্তি’ দেওয়া হয়।
প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র আওয়ামী শাসনের চিহ্ন মুছে ফেলার কাজ জোরেশোরে চললেও সাংবিধানিক প্রয়োজনে টিকে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। কিন্তু আড়াই মাস পর দৈনিক মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে তারও বিদায় ঘণ্টা বাজার উপক্রম হয়।
সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই। ওই বক্তব্য দিয়ে তিনি ‘শপথ ভঙ্গ করেছেন’ দাবি করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, এরপরও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে রাখা চলে কি না, তা বিবেচনার সুযোগ সংবিধানে আছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা অক্টোবরের শুরু থেকেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে আসছিলেন। রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও এ ধরনের কথা বলতে শুরু করেন।
এ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষতের বৈঠকে আলোচনা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি সংগঠন রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে বঙ্গভবনের সামনে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করে।
সবাই ধরেই নিয়েছিল, রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর সময় বুঝি শেষ। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন সে জল্পনা কল্পনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে বিএনপি ভিন্ন অবস্থান নিয়ে ‘সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট’ এড়ানোর পরামর্শ দেয়। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে টিকে যান মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।
কবে ফিরবেন?
আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর থেকে আরও একটি প্রশ্ন বার বার ঘুরেফিরে আসছে– বিএনপি নেতা তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কবে?
বিএনপি নেতারা উত্তরে বলছেন, তিনি ফিরবেন ‘সময় হলেই’। সেই সময়টা কবে, কেউ বলছেন না। তবে তারেক যাতে নির্বিঘ্নে ফিরতে পারেন, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
জরুরি অবস্থার সময় ২০০৮ সালে সপরিবারে লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে সেখানে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপর আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে পাঁচটি মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তাকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আপিল করার সুযোগ না পেলেও হাই কোর্ট তাকে এবং দণ্ডিত সব আসামিকে খালাস দিয়েছে। বিভিন্ন আদালতে আরো কয়েকটি মামলায় তারেকের খালাসের রায় এসেছে।
১২ ডিসেম্বর লন্ডন ঘুরে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “উনার বিরুদ্ধে আপনারা জানেন অনেক মিথ্যা প্রতিহিংসামূলক মামলা রয়েছে। সেগুলো প্রত্যাহার হলে বা আদালতের মাধ্যমে শেষ হলে তিনি ফিরবেন।”
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের সাজা, অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ৯ বছরের সাজা, বিদেশে অর্থপাচার মামলায় ৭ বছরের সাজা এবং বঙ্গবন্ধুকে ‘কটূক্তির’ অভিযোগে দুই বছরের সাজা হয়েছিল তারেকের। সেসব মামলাতেও তিনি খালাস পাবেন বলে আশা করছে বিএনপি।
নিষিদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞামুক্ত
জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন যাদের ভাগ্য সবচেয়ে বেশি বদলে গিয়েছে, নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে সামনের কাতারে আছে জামায়াতে ইসলামী।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে দলের শীর্ষ নেতাদের। আদালতের রায়ে হারাতে হয়েছে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন। মামলায় মামলায় নেতাকর্মীদের থাকতে হয়েছে দৌড়ে ওপর। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে এমনই ছিল জামায়াতে ইসলামীর দশা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই আন্দোলনের সহিংসতার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী জামায়াত এবং এর সকল অঙ্গ সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র চার দিন আগে তড়িঘড়ি করে জারি করা ওই নিষেধাজ্ঞা চার সপ্তাহও টেকেনি।
পট পরিবর্তনের পর ২৮ অগাস্ট নিষেধাজ্ঞার সেই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী, এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির বা এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও সহিংসতায় সম্পৃক্ততার ‘সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ’ সরকার পায়নি।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যে কোনো বৈঠকে এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকছে জামায়াত। আওয়ামী লীগ শাসনামলে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে তাদের সম্মেলন না হলেও পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়মিত চলছে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতে ইসলামীর যে আপিল আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক বছর আগে খারিজ করে দিয়েছিল, গত ২০ অক্টোবর তা পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। আদালতের রায় পক্ষে পেলে দলীয় পরিচয়ে জামায়াত নেতাদের প্রার্থী হতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
ফাঁটা বাঁশে জাপা
জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মঞ্চস্থ হয় জাতীয় পার্টির নতুন নাটক। নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়া এবং দলের কর্তৃত্ব নিয়ে দেবর-ভাবির মতবিরোধ নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে দূরে থাকেন। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস করে আরো এক মেয়াদ সংসদের বিরোধী দল হওয়ার আশায় নির্বাচনে অংশ নেন এরশাদের ভাই, পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের অনুসারীরা।
শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি পায় ১১টি আসন। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দিষ্ট কয়েকটি আসন ছাড়া বাকিগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কাছে হেরে যাওয়ার পর জাতীয় পার্টি দুই ভাগ হয়ে কর্মসূচিও ঘোষণা করে। দুই গ্রুপই নিজেদের জাতীয় পার্টি দাবি করে কেন্দ্রীয় অফিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কার্যালয় ভাঙচুর করে।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জিএম কাদের মন্ত্রীর মর্যাদায় বিরোধী দলীয় নেতা হন। কিন্তু ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের গতন ঘটলে সংসদও ভেঙে দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টি পড়ে অন্য রকম ঝামেলায়।
গত তিন নির্বাচনে অংশগ্রহণ, মন্ত্রী হওয়া ও বিরোধী দলে থেকেও আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়ে রাজনীতি করায় জাতীয় পার্টিকে এখন ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ বলছে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীরা। তাদের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় প্রকাশ্যে দলীয় কোনো কর্মসূচি করতে পারছে না জাতীয় পার্টি। দুটি জনসভা করার ঘোষণা দিয়েও তা স্থগিত করতে হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার ও জাতীয় ঐক্য তৈরিতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দুই দফার সংলাপেও দাওয়াত পায়নি দলটি। এমনকি নভেম্বর মাসে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
সংস্কারের ডামাডোল
অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দাবি মেনে রাষ্ট্র সংস্কারে হাত দেয়। সেই লক্ষ্যে গঠন করে ১১টি সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন ও সার্বিক অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি করা হয়।
৩ অক্টোবর গঠন করা হয় নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। ৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন।
ছয় কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়ার কথা রয়েছে বছরের শেষভাগে বা জানুয়ারির শুরুতে। সে হিসাবে ২ জানুয়ারি শেষ হতে যাচ্ছে ৯০ দিন।
১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিবেদন দিতে ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ পর্যন্ত সময় পাচ্ছে তারা।
সব কাজ গুছিয়ে সুপারিশ জমা দেওয়ার জন্য ৯০ দিন ‘স্বল্প সময়’ বলে মনে করছেন কমিশন প্রধানদের কেউ কেউ। তবে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন তুলে দিতে আশাবাদী।
ইতোমধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে একগুচ্ছ প্রস্তাব জমা পড়েছে। সেসব বাস্তবায়নের জন্যে সংবিধান সংশোধনের দরকার হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, নির্বাচনী আইনের সংস্কাসহ নানা প্রস্তাব জোর আলোচনায় রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির হাল হকিকত নিয়ে তৈরি করা শ্বেতপত্র ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে এ সংক্রান্ত কমিটি। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ ‘তছরুপ’ বা ‘লুটপাট’ হয়েছে বলে কমিটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
১৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয় সেখানে। ‘গুমের’ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং র্যাব বিলুপ্তিরও সুপারিশ করেছে এ কমিশন।
‘বন্ধু’ থেকে বৈরী
গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকেই দুই দেশের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উল্টে যায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে গত চার মাসে সেই টানাপড়েন জটিল চেহারা নিয়েছে।
হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ যেমন আছে, দুই দেশের পাল্টা পাল্টি বক্তব্য বিনিময়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও তপ্ত হয়ে উঠেছে।
সরকার বদলের সময় থেকেই বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া একরকম বন্ধ করে রেখেছে ভারত। তাতে বেনাপোলসহ সীমান্ত অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভুগছেন কলকাতার ব্যবসায়ী, হোটেল আর হাসপাতাল মালিকরাও। দুই দেশের জনগণের মধ্যে চলাচল এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।
অগাস্টে বাংলাদেশের পূর্ব ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে নজিরবিহীন বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন দুই তরুণ উপদেষ্টা। তাতে দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
বছরের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের গ্রেপ্তার এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে উত্তাপ সৃষ্টি করে। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি বিরোধী দল কংগ্রেস এবং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য সেই উত্তাপকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
এর মধ্যেই ২ ডিসেম্বর একটি বিক্ষোভ থেকে ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে হামলা চালানো হয়। সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ওই ঘটনাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ আখ্যা দিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ঢাকায় দেশটির হাই কমিশনারকে তলব করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
ডিসেম্বরে দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ‘গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রত্যাশা করার কথা বলেন।
অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও তাদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার বিষয়টি ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, এ নিয়ে অন্য দেশের মন্তব্য ‘সমীচীন নয়’।
সবকিছুর পরও উচ্চ পর্যায়ের এ বৈঠক এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মিশ্রির সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে আশার বাণী আসে দু’দেশের তরফেই।
এদিকে ভারতের সঙ্গে টানাপড়েনের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে উদ্যোগী হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সময়ই প্রথমবারের মত পাকিস্তানের জাহাজ ভেড়ে বাংলাদেশে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাকিস্তান থেকে পণ্য এলেও চট্টগ্রাম বন্দরে সেসবের শতভাগ কায়িক পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা ছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক আদেশে ওই শর্ত তুলে দেয়।
বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতির দহন
জনরোষে ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসনের অবসান হলেও মূল্যস্ফীতির পারদ নামানো যায়নি।
বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবার সরকার গঠনের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মৎস্য, কৃষি, খাদ্য, বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রণালয়ের সংযোগে যৌথভাবে কাজ শুরু করেছিল। তাতে লাভ হয়নি।
জানুয়ারি থেকে ৯ শতাংশের উপরে থাকা মূল্যস্ফীতির হার আন্দোলনের উত্তাপে জুলাই শেষে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে পৌঁছায়। অগাস্টে তা কিছুটা কমে ১০.৪৯ শতাংশ হয়।
সেপ্টেম্বরের মূল্যস্ফীতির হিসাব যখন বের হয় ততদিনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হলেও অক্টোবরে তা আবার দুই অংকের ঘর ছাড়ায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন । মুদ্রা সরবরাহে লাগাম দিতে বারবার সুদের হার বাড়ানো হয়। কিন্তু নিত্যপণ্যের বাজারে সুফল মেলেনি।
চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির হার নভেম্বরে আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। আগের মাসে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বাজার ঠাণ্ডা করতে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। কর কমিয়ে চাল আমদানি সহজ করেছে। তারপরও বছর শেষে বাড়তে শুরু করেছে প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম।
ডিসেম্বরের শুরুতে বাজার থেকে হঠাৎ বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় সয়বিন তেল। পরে দাম বাড়ানো হলেও সরবরাহ স্বাভাবিক হতে সময় লেগে যায়।
সরকার পতন হলেও বাজারে সিন্ডিকেটের দাপট যে কমানো যায়নি, সে কথা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও ঘুরে ফিরে আসছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন,ব্যবসার ক্ষেত্রটি ‘বেশ জটিল’। আর সেটা ভাঙা ‘বেশ কঠিন’।
বন্ধুর পথে অর্থনীতি
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক উত্তেজনা নিয়ে শুরু হওয়া বছরটিতে আগ থেকেই চাপে ছিল অর্থনীতি। ডজনখানেক ব্যাংকে তারল্য সংকট, বিদেশি মুদ্রার সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যে টাকার বিনিময় হার স্থির হয়নি তখনো। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক কমিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বছরের মধ্যবর্তী সময়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে উঠা ছাত্রদের আন্দোলন জুলাই মাসে তীব্র আকার ধারণ করলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একরকম স্থবির হয়ে পড়ে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পরিস্থিতি আরো নাজুক হলে কয়েক দিন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়। সেই সঙ্গে জারি হয় কারফিউ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে বহিঃবিশ্ব থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে উৎপাদন থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বড় ধাক্কা খায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর শীর্ষপদে পারিবর্তনের ঢেউ লাগে। অর্থনীতির ক্ষতি সামাল দেওয়া এবং আগের সরকারের অনিয়ম দুর্নীতি তদন্ত করতে ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’সহ ডজনের বেশি টাক্সফোর্স গঠন করা হয়।
নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতের আগের উদ্যোগগুলোতে ভাটা পড়ে। মার্জার কার্যক্রমও ঝুলে যায়। তবে এসআলম গ্রুপের হাতে পড়ে দুর্দশাকবলিত ব্যাংকগুলোর পর্ষদ বদলে দেওয়া হয়।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটে গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়লে ভালো ব্যাংকের মাধ্যমে ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে টাকা ছাপানোর পুরনো পথে হাঁটতে হয় সরকারকে।
পতনের বৃত্তে থাকা পুঁজিবাজার বছরের শেষ দিকেও ঘুড়ে দাঁড়াতে পারেনি সেভাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিবর্তন এলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরেনি।
এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা ও সামিট গ্রুপের মত বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে অর্থপাচারের যে অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে ছিল, তার তদন্তে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। এসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক ও তাদের উপর নির্ভরশীলদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করে শেয়ার লেনদেনে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে।
তারল্য সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা, সরকার স্থিতিশীল না হতে পারা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের অনেকে আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। প্রবৃদ্ধি কমেছে রাজস্ব খাতেও। বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি।
এ সব কিছুর মধ্যেও চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির ৬৪৫ মিলিয়ন ডলার ছাড় করতে রাজি হয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো, আর্থিক খাতের সংস্কার ও অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে আগের ঋণের বাইরে নতুন করে ৭৫ কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়েছে এ আন্তর্জাতিক সংস্থা।
ঝড়ের কবলে শিক্ষা
সার্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ এর বিরোধিতা করে চলতি বছরের মাঝামাঝি আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-কর্মচারীরা। তাদের কর্মবিরতির কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যয় স্কিম বাতিল ঘোষণা করেন।
এর মধ্যেই হাই কোর্ট ২০১৮ সালে সরকারি চাকরির কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। শুরুটা ঢাকায় হলেও পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদেরও বিক্ষোভে দেখা যেতে থাকে।
বিক্ষোভ ঘিরে সহিংসতা শুরু হলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থদের দেওয়া হয় হল ছাড়ার নির্দেশ।
কিন্তু আন্দোলন দমানো যায়নি, বরং তা সরকার পতনের আন্দোলনের রূপ নেয় এবং প্রবল গণ অভ্যুত্থানে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্কুল খুলে দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদলের কারণে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হতে সময় লেগে যায়।
এ বছর ৩০ জুন এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হলেও আন্দোলনের জেরে তা মাঝপথে স্থগিত হয়ে যায়। সরকার পতনের পর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাকি পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরীক্ষার্থীরা বাকি পরীক্ষাগুলো না দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
শিক্ষা প্রশাসন তখন আরও দুই সপ্তাহ পিছিয়ে অর্ধেক নম্বরে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তাতে আপত্তি তুলে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে এবং সচিবের কক্ষের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে। ওই পরিস্থিতিতে বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিলের ঘোষণা আসে।
এ পরিস্থিতিতে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার নম্বর বিবেচনায় নিয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে গত ১৫ অক্টোবর ফল প্রকাশ করে শিক্ষা বোর্ডগুলো। তাতে পাস করে ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে ২০১২ সালের পাঠ্যক্রমে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। সেই সঙ্গে ২০২৫ সালের শুরু থেকে দশম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন ফেরানোর ঘোষণা আসে।
দিকে দিকে অস্থিরতার মধ্যে ঢাকার সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। টানা কয়েক দিন সড়ক অবরোধ ও জনভোগান্তির পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাত কলেজের ‘অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনকল্পে’ একটি কমিটি গঠন করে দেয়। পরে সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ৫ সদস্যের আরেকটি কমিটি করা হয়।
সেই আন্দোলন না থামতেই ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। সিটি কলেজকে ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলা হয় ঢাকা কলেজের পক্ষ থেকে।
এদিকে এক শিক্ষার্থী মৃত্যুর পর ‘চিকিৎসায় অবহেলার’ প্রতিবাদ জানাতে গত ২১ নভেম্বর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে বিক্ষোভ করতে গিয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে মারধরের শিকার হন ডেমরার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এর জেরে ২৪ নভেম্বর দুপুরে ‘সুপার সানডে' কর্মসূচির নামে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল, পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ও কবি নজরুল সরকারি কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এর পাল্টায় সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা পরদিন ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচির নামে ডেমরা সড়কে মোল্লা কলেজে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। প্রায় দুই ঘণ্টার সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। মোল্লা কলেজে ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাটও হয়।
আইনশৃঙ্খলা লাইনচ্যুত
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। নির্বিচারে আক্রমণের পাশাপাশি চলে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
এরপর পুলিশি ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় সড়কে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। ট্রাফিক সামলাতে নেমে পড়ে শিক্ষার্থীরা।
পাড়া-মহল্লায় ডাকাত আতঙ্কের মধ্যে রাত জেগে নিজেরাই লাঠিসোঁটা নিয়ে পাহারায় নামেন রাত গভীর হতেই ফেইসবুকে ‘ডাকাত পড়েছে’ বলে লাইভ পোস্ট পড়তে থাকে বিভিন্ন এলাকায়। আতঙ্ক কাটাতে মাঠে নামে সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বিজিবি।
সরকারি ‘নির্দেশ পালন’ করতে গিয়ে ‘হতাহতের’ অভিযোগ এনে ৬ অগাস্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে একত্রিত হয়ে নানা দাবি জানাতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন ও সাবেক সদস্যদের কেউ কেউ রাজারবাগে গিয়ে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার চেষ্টায় ক্রমান্বয়ে থানায় ফিরতে শুরু করে পুলিশ। সারাদেশে সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহতের তথ্য দেয় পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ ও র্যাবের শীর্ষপদসহ সবগুলো ইউনিটের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। বিগত সরকারের সময়ে দায়িত্বে থাকা অনেক পুলিশ কর্মকর্তার চাকরি যায়; সাবেক আইজিপিসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হন।
প্রায় সকল স্তরে বদলি করে পুলিশকে সচল করার প্রচেষ্টার মধ্যে একপর্যায়ে এ বাহিনীর সংস্কারে গঠিত হয় কমিশন।
প্রকৃতির রুদ্ররূপ
বছরজুড়ে এবার নানা প্রকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। গ্রীষ্মের শুরুতেই রেকর্ড টানা ৩৭ দিনের দাবদাহের কবলে পড়েছিল দেশ। বৃষ্টি তাতে যতি টানলেও গরমের দাপট ছিল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কয়েক দফায় দাবদাহ বিস্তৃত হয়েছিল সারাদেশেই।
৩০ এপ্রিল দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস নথিবদ্ধ করা হয় যশোরে। এমন গরমের ফলে বেড়ে যায় হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ১৫ জন হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, আর মৃত্যু হয় ১০ জনের।
মে মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’। ওই ঝড়ের তাণ্ডবে বাংলাদেশ ও ভারতে মোট ৭৬ জনের মৃত্যু হয়।
অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে প্রবল ঘূর্ণিঝড় দানা ও নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ফেইনজাল তৈরি হলেও বাংলাদেশে তেমন প্রভাব পড়েনি, দুটোই চলে যায় ভারতে।
উজানে পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারি বৃষ্টির কারণে ২০ অগাস্ট থেকে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। উপদ্রুতরা বলছিলেন, জীবদ্দশায় তারা বন্যার এমন ভয়াল রূপ দেখেননি।
এই বন্যা মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির ঘাটতি কথা বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। পূর্বাভাস থাকলেও ঘাটতির কথা স্বীকার করেছিল আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
পূর্বাভাসে ভারি বৃষ্টি এবং বন্যার কথা বলা হলেও ওই বার্তা এলাকায় প্রচার করা হয়নি বলে জানায় সেখানকার বাসিন্দারা। যার ফলে তাদের আরও দুর্ভোগে পরতে হয়।
ভয়াবহ ওই বন্যার পেছনে ‘উড়ন্ত নদী’র প্রভাব থাকার কথা বলেছেন বুয়েটের একদল গবেষক। তাদের ভাষ্য, ১৮ অগাস্ট বঙ্গোপসাগরে একটি ‘উড়ন্ত নদী’ তৈরি হয়। এর ফলে উজানে অস্বাবিক বৃষ্টি হয়, আর তা ভয়াবহ বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অগাস্টের বন্যায় ১১ জেলায় ৭৪ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৬৪ জন। ২৩ জেলায় ২ লাখের বেশি ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর ফসলি জমি আক্রান্ত হয়। এতে কৃষিতে ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয় আর দুর্দশায় পড়েন ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক।
সরকারি হিসাবে কৃষি, ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাটসহ সবমিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে ১৪ হাজার ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৯ লাখ ৪২ হাজার ৮২১ জন মানুষ, ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন ৪৫ লাখ ৫৬ হাজার ১১১ জন।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে টানা ভারি বৃষ্টিতে রংপুর, নীলফামারীসহ উত্তরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে ভারি বৃষ্টিপাতে নদীর পানি বেড়ে তলিয়ে যায় ময়মনসিংহ বিভাগের তিন জেলা। ফলে দুই লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মৃত্যু হয় ১০ জনের।
চলতি বছর বর্ষার শুরুতেই বন্যার মুখে পরে সিলেট-সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা। টানা দুই সপ্তাহ দুর্ভোগে ছিল তারা। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলেও পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়।
উজানের ঢলে জুলাইয়ের শুরুতেও দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। এর ফলে প্লাবিত হয় অনেক গ্রাম।
দুর্যোগ দুর্বিপাক
এ বছর দেশে আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ছিল ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ড। ২৯ ফেব্রুয়ারির ওই ঘটনায় ৪৬ প্রাণ হারায়। যথাযথ নিয়ম না মেনে ভবন তৈরি, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর গাফিলতি ও উদাসীনতার বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় আসে।
সেদিন সন্ধ্যার পর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনের নিচতলায় চা-কফির দোকানে ইলেকট্রিক কেটলি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। লিকেজ থেকে ছড়িয়ে পড়া গ্যাসের কারণে সেই আগুন প্রাণঘাতি রূপ পেয়েছিল বলে পরে জানায় ফায়ার সার্ভিস।
একটি ফ্লোর ছাড়া ওই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরেই ছিল রেস্তরাঁ। মাত্র একটি সিঁড়ি, রেস্তরাঁর গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে। এতে আগুন দ্রুত ছড়ায়, আগুন লাগার পর লোকজন বের হতে পারেনি। তাতেই প্রাণহানি বাড়ে।
ওই ঘটনার পর গ্রিনকোজি কটেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেইলি রোডসহ ঢাকার বিভিন্ন ভবনে থাকা অননুমোদিত রেস্তরাঁর বিরুদ্ধে অভিযানে নামে রাজউক সিটি করপোরেশন।
তখন বেশ কিছু রেস্তরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়, করা হয় জরিমানাও। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই বেশিরভাগ রেস্তরাঁ আবার চালু হয়ে গেছে। ব্যবসা চলছে আগের মত করেই।
এ বছর ১৪ এপ্রিল ঝালকাঠি সদর উপজেলায় গাবখান ব্রিজের টোলপ্লাজায় একটি ট্রাক তিনটি ইজিবাইক ও একটি প্রাইভেট কারকে চাপা দেয়। ওই ঘটনায় শিশুসহ ১৪ জন মারা যান।
সেদিন গাবখান সেতু থেকে নামছিল ট্রাকটি। ব্রেক ফেল করায় সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি চালক। ট্রাকটি সামনে থাকা যানবাহনগুলোকে চাপা দেয়, সেগুলোসহ পাশের খাদে পড়ে গেলে হতাহতের এই ঘটনা ঘটে।
বছর শেষে ডেঙ্গুর দাপট
বাংলাদেশে এবার ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু বর্ষা মৌসুমের শেষভাগে। কিন্তু বছর শেষে মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে, মৃত্যু হয়েছে সাড়ে পাঁচশ মানুষের।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর এই সংখ্যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হয় ১৭০৫ জনের।
২০১৯ সালে ভর্তি হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী, ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল সে বছর। সে হিসেবে এ বছর ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখল বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ বছর বর্ষা মৌসুম দেরিতে শেষ হওয়ায় মশার প্রজনন মৌসুমও দেরিতে শেষ হয়েছে। এটা বোঝা যায় মশার উপস্থিতি নিয়ে করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ জরিপে।
বাংলাদেশে এ বছর ডেঙ্গুর পাশাপাশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে মশাবাহিত আরো দুই রোগ জিকা ভাইরাস ও চিকুনগুনিয়া। দেশে এর আগে কোনো বছর একইসঙ্গে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি।
গত ২ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ বছর সারাদেশে ১১ জন জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছে আইইডিসিআর। চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ৬৭ জন রোগী পাওয়ার তথ্যও সেদিন সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এমভি আবদুল্লাহ: উৎকণ্ঠার এক মাস
১২ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে সোমালিয়া উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। অস্ত্রের মুখে জাহাজ ও এর ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়, নিয়ে যাওয়া হয় সোমালিয়া উপকূলের দিকে।
সেই খবর দেশে পৌঁছালে শুরু হয় উৎকণ্ঠা। নাবিকদের পরিবারের সদস্যরা জাহাজের মালিক কোম্পানি এসআর শিপিংয়ের কাছে ছুটে যায়। সরকারও উদ্যোগী হয়। নাবিকদের উদ্ধারে শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা।
শুরুতেই এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা পরিবারের কাছে পাঠানো অডিও বার্তায় জানায়, মুক্তিপণ না দিলে জলদস্যুরা নাবিকদের এক এক করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।
এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর পেয়ে সেটিকে অনুসরণ করে ভারতীয় নৌবাহিনী এবং পূর্ব আফ্রিকা উপকূলের নৌপথের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইইউএনএভিএফওআর আটলান্টা অপারেশনের যুদ্ধ জাহাজ।
আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযানে আগ্রহী হলেও নাবিকদের পরিবার ও জাহাজের মালিকপক্ষ জানায়, তারা এমন কোনো অভিযান চায় না। সমঝোতার ভিত্তিতে জাহাজটি ছাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল মালিকপক্ষ।
এমভি আবদুল্লাহ ও নাবিকদের জিম্মি করার নয়দিনের মাথায় ২০ মার্চ প্রথমবার জলদস্যুদের প্রতিনিধিরা জাহাজ মালিকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। এরপর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে দেন দরবার চলছিল। এক পর্যায়ে সমঝোতা হয়।
৩ দিন পর ১৩ এপ্রিল রাতে জলদস্যুরা জাহাজ ছেড়ে চলে যায়। পরে জানা যায়, জলদস্যুরা চলে যাওয়ার আগে উড়োজাহাজ থেকে তিনটি ব্যাগ ফেলা হয়েছিল জাহাজের পাশে। জাহাজের মালিকপক্ষ বা বাংলাদেশ সরকার মুখ না খুললেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, নাবিকদের মুক্তির জন্য ৫০ লাখ ডলার দিতে হয়েছে।
মুক্ত আবদুল্লাহ এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতে যায় পণ্য খালাস করতে। সেখান থেকে ১৩ মে দেশে ফেরেন আবদুল্লাহর নাবিকরা। উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি মেলে কয়েক ডজন পরিবারের।
বিদেশের মাটিতে আইনপ্রণেতার ভয়ঙ্কর মৃত্যু
ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার গত ১১ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হলে স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস।
২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার। এরপর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ভারতে গিয়ে একজন জনপ্রতিনিধির উধাও হয়ে যাওয়ার এ ঘটনা দুই দেশেই আলোড়ন তোলে। কলকাতা সিআইডি ও নিজেদের তদন্তের ভিত্তিতে ঢাকার ডিবি জানায়, এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারই বাল্যবন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন।
আনারকে খুনের পর তার হাড়-মাংস আলাদা করে ফেলে দেওয়া হয় একাধিক স্থানে। কলকাতার ওই বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকেও মাংসের টুকরা উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ।
আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন নভেম্বর মাসের শেষ দিকে কলকাতায় গিয়ে ডিএনএ নমুনা দিয়ে আসেন। তার সঙ্গে উদ্ধার হওয়া হাড় ও মাংসের নমুনা মিলিয়ে ভারতীয় পুলিশ নিশ্চিত হয়, ওই দেহাংশগুলো আনারেরই।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশে প্রথমে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে গ্রেপ্তার করা হয় আরো চারজনকে।
কলকাতার পুলিশ গ্রেপ্তার করে জিহাদ হাওলাদার নামে এক কসাইকে। আর শাহীনের সহকারী সিয়াম হোসেন কাঠমান্ডুতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে নেপালের পুলিশ।
গত অগাস্টে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত জেলা আদালতে প্রায় ১২শ পাতার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে কলকাতা সিআইডি। এরই মধ্যে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকায় আনারের মেয়ে ‘হত্যার জন্য অপহরণের’ অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছিলেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই মামলার তদন্তের অগ্রগতির কোনো খবর নেই।
কেএনএফের ত্রাস
গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে যে সশস্ত্র দলটির নাম নানা কারণে আলোচনায় আসছিল, এ বছর তারা নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়।
২ এপ্রিল রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি করে অর্থ লুট করে একদল সশস্ত্র লোক। পুলিশের ১০টি এবং আনসার সদস্যের ৪টি অস্ত্রও লুট করে নিয়ে যায় তারা। অপহরণ করা হয় ব্যাংকটির ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে।
রুমার ঘটনার পরদিনই থানচি উপজেলার সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে দিন-দুপুরে অর্থ লুটের ঘটনা ঘটে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যে দুদিন পর রুমার একটা পাহাড়ি এলাকা থেকে ছাড়া পান নেজাম।
ওই দুটি ঘটনায় পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ’ জড়িত বলে জানায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তাদের গ্রেপ্তারে এবং লুট হওয়া অস্ত্র-অর্থ উদ্ধারে রুমা ও থানচিতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। অভিযানে কেএনএফের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১২ জুন পর্যন্ত ১২ জন নিহত হয়।
সবশেষ ২৪ নভেম্বর বান্দরবানের রুমায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কেএনএফের তিন সদস্য নিহত হওয়ার খবর আসে।
অভিযানের মধ্যে চলাফেরা, খাদ্য সংগ্রহসহ নানা ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মধ্যে পড়তে হয় বমদের। গণগ্রেপ্তারের কারণে ‘ভয় আর আতঙ্কে’ অনেকে বাড়ি ছাড়ায় কৃষিকাজের পাশাপাশি তরুণদের শিক্ষাজীবনও বাধাগ্রস্ত হয়।
সীমান্তে সংকট
রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক ছিল বছরের বড় সময়জুড়ে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মর্টার শেল, বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দে বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্তে বসবাসকারীদের বহু নির্ঘুম রাত কেটেছে। বাংলাদেশের দিকে চলে আসা মর্টার শেল ও গুলি মৃত্যুও ঘটিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া বাংলাদেশি জেলেরা বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির গোলাগুলির মধ্যে পড়েছেন। জেলেদের আটক করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে কয়েকবার।
সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চার শতাধিক সদস্য। দেশটির সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে তাদের দুই দফায় ফেরত পাঠানো হয়।
মিয়ানমারের সংঘাতের জেরে চলতি বছরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। গত কয়েক বছর ধরে আশ্রয় নিয়ে থাকা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনেরও কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি।
দুর্নীতির ত্রিমূর্তি
২০২৪ সালের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে সরকারি কর্মচারীদের নাম ছিল সবার তুঙ্গে। এর মধ্যে সামলোচনার শীর্ষে থাকা পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, ছাগলকাণ্ডে এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমান এবং পিএসসির গাড়ি চালক আবেদ আলীর ঘটনাগুলো আলোড়ন তৈরি করে।
র্যাবের পর পুলিশের শীর্ষ পদে চাকরি করা বেনজীরের পিআরএল শেষে হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ 'বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ' ও ৩ এপ্রিল 'বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট' শিরোনামে একটি পত্রিকা খবর প্রকাশ করলে দুর্নীতির খবর নিয়ে আলোচনায় আসেন বেনজীর।
র্যাবের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় গুম-খুনের অভিযোগের যুক্তারষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা বেনজীর ও তার পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৫০০ কোাটি টাকার বেশি। অথচ ৩৪ বছর সাত মাসের চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট আয় করেছেন এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা।
বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের’ অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। তাদের নামে থাকা সব বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করেছে বিএসইসি। বেনজীরের নামে ৮৩টি দলিলে বিভিন্ন স্থাবর সম্পদ 'ক্রোক' এবং ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও 'ফ্রিজ' করা হয়েছে।
তবে আপাতত তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গত মে মাসের ৪ তারিখ রাতে দিনি দেশ ছেড়ে গেলেও বিষয়টি জানা যায় অগাস্টে সরকার পতনের দুই সপ্তাহ পর।
বছরের মাঝামাঝি একটি ঘটনা তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়, যা পরে পরিচিতি পায় ‘ছাগলকাণ্ড’ হিসেবে।
কোরবানির ঈদের আগে রাজধানীর সাদেক অ্যাগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনার ছবি পোস্ট করে হৈ চৈ ফেলে দেন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ। ওই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার বাবা এনবিআরের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমানের নাম চলে আসে।
এরপর মতিউর রহমানের অঢেল সম্পদের তথ্য বের হতে শুরু করে। হোটেল, আবাসন ও ভূমি উন্নয়ন ব্যবসা খাতে তার বিনিয়োগের তথ্য মেলে।
সমালোচনার মধ্যে তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সেখানে যোগ না দিয়ে গত জুনে চাকরি থেকে ইস্তেফা দেন।
প্রায় ৩০ বছরের চাকরি জীবনে চার বার দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে এলেও প্রতিবার পার পেয়ে গেছেন এ সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু এবার মতিউর এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর বিরুদ্ধে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের’ মামলা করেছে দুদক।
চলতি বছর দুর্নীতিতে আরেক আলোচিত নাম সৈয়দ আবেদ আলী। তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) গাড়িচালক ছিলেন।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে আবেদ আলীর সম্পৃক্ততা এবং তার বিপুল সম্পদের খবর এলে দুদক নড়েচড়ে বসে।
সেই খবরে বলা হয়, ২৫তম বিসিএস থেকে সবশেষ বিসিএস পরীক্ষায় দুর্নীতি করেছেন তিনি। তার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিতেন।
এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবেদ আলী পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সাকিবে শনির ভর
ইতিবাচক-নেতিবাচক, সাফল্য-বিতর্ক, নানাভাবেই ক্যারিয়ারজুড়ে খবরের শিরোনামে ছিলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। তবে এবছর তাকে নিয়ে যা হল, তার জন্যও তা অভূতপূর্ব।
গত জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিশ্বসেরা এ ক্রিকেটারের নামের সঙ্গে নতুন তকমা যোগ হয়। আওয়ামী লীগের টিকেটে মাগুরা থেকে নির্বাচন করে তিনি হয়ে যান সাকিব আল হাসান এমপি।
জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। জুলাইয়ের আন্দোলনে তার চুপ থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। তখন তিনি দেশের বাইরে।
দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর তিনি যখন বাংলাদেশ দলের হয়ে পাকিস্তান সফরে, দেশে তখন তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয় রাজধানীর আদাবর থানায়।
দেশের বাইরে থেকেই দেশের হয়ে খেলতে থাকেন তিনি। পাকিস্তান সফরের পর ভারত সফরেও সঙ্গী হন দলের। সেখানে দ্বিতীয় টেস্টের আগে আচমকাই ঘোষণা দেন, অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুরের ম্যাচ খেলে অবসর নিতে চান টেস্ট ক্রিকেট থেকে।
কিন্তু হত্যা মামলার আসামি হিসেবে তার দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও টানাপড়েন শুরু হয়। দেশের মাঠ থেকে বিদায় নিতে বোর্ড ও সরকারের সহায়তা চান তিনি।
কয়েক দফায় নানারকম বক্তব্য দেওয়ার পর বোর্ড সভাপতি ও ক্রীড়া উপদেষ্টার কথায় ইঙ্গিত মেলে সাকিবকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার। তবে ঘটনা নতুন মোড় নেয় মিরপুর টেস্টের কাছাকাছি সময়ে গিয়ে।
সাকিবের দেশে ফেরা ঠেকাতে মিরপুর স্টেডিয়ামের আশেপাশে আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করেন এক দল লোক। পরে তার দেশে ফেরা নিশ্চিত করতে পাল্টা আন্দোলন শুরু করেন ভক্তরা। কয়েকদিন ধরে তুমুল উত্তপ্ত অবস্থা তৈরি হয় মিরপুর স্টেডিয়ামের আশপাশে।
শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা-শঙ্কায় সাকিবকে দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করা হয়। দেশে ফেরার পথে দুবাই থেকেই ফিরে যেতে হয় তাকে। তার আর দেশে ফেরা হয়নি। টেস্ট থেকে আনুষ্ঠানিক অবসরও হয়নি।
আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ইচ্ছের কথা বলেছিলেন সাকিব। সেই ইচ্ছেপূরণও এখন চরম অনিশ্চয়তায়।
এসবের মধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম বাঁহাতি স্পিনারের উচ্চতায় নিজেকে তুলে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু ইংল্যান্ডে কাউন্টি খেলতে গিয়ে বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর বছরের শেষ দিকে নিষিদ্ধ হয়েছেন বোলিংয়ে।
তার ক্যারিয়ার ও জীবনের সঙ্কট এখন ক্রিকেট মাঠ ছাড়িয়ে আরও অনেক গভীরে।