২০২১: অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে সাম্প্রদায়িকতার ক্লেদ

অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের, মাঝে ঘটেছিল ছন্দপতন; তারপর আবারও শুরুর ধারায় চলার পথে যখন সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন, তখন জন্মের লক্ষ্যকে কালিমালিপ্ত করে গেল দুর্গাপূজার মধ্যে সাম্প্রদায়িক হামলা।

গোলাম মর্তুজা অন্তু জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2021, 06:58 PM
Updated : 28 Dec 2021, 04:13 AM

তিন দশক আগে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর আর ২০০১ সালে নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার মাত্রা ছিল ব্যাপক। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে নানা সময়ে হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ সম্প্রদায় আক্রমণের শিকার হলেও এই বছরের দুর্গাপূজার সময় হামলার ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতের অন্য সব ঘটনা ছাপিয়ে যায়।

 

বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বছর ২০২১ সালে তাই আলোচিত ঘটনা হয়ে উঠেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর এই হামলা।

বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফোরামের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসে দেশের ১৯টি জেলার পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ সহিংসতার ৫৩টি ঘটনা ঘটে।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দাবি, দুর্গাপূজার মধ্যে তিন দিনেই ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাংচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়।

১৩ থেকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নয়জন নিহত ও কমপক্ষে দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। নিহত ৯ জনের মধ্যে ৬ জন মুসলমান ও ৩ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

কুমিল্লার কাপড়িয়াপট্টি শ্রী শ্রী চান্দমনি রক্ষাকালী মন্দির হয়েছিল হামলার শিকার। ফাইল ছবি: মাহমুদ জামান অভি

শারদীয় দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় একটি মণ্ডপে প্রতিমার কোলে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ পাওয়ার পর এই হামলার শুরু হয়।

ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, সেদিনই কুমিল্লায় ১৭টি মণ্ডপে হামলা হয়। একই দিনে হামলা হয় পাশের জেলা চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের আরও ১৪টি মণ্ডপে।

এরপর কয়েকদিনে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর বিভিন্ন জায়গায় মণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা হয়। তারপর ১৭ অক্টোবর রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপল্লীতে আগুন দেওয়া হয়, পুড়ে যায় ২৯টি বাড়ি।

পীরগঞ্জে আগুনে পুড়ছে জেলেপল্লীর ঘর। ফাইল ছবি

হামলা প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা উঠলেও পরে তৎপর হয়ে ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা এবং তার পরের কয়েকদিনের ঘটনায় ১১ নভেম্বর অবধি সারাদেশের ৩৫ জেলায় মোট ১৪২টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ১৩৬ জন।

তবে কোনো মামলায়ই এখনও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি বলে জানান বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রধান বিচারপতি বলেছেন এই যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে সেগুলো অভিযোগ দায়েরের ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। এ বিষয়ে আদেশও হয়েছে।

“কিন্তু কোনো মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে, এমনও দেখছি না। প্রায় দুই মাস হতে চলেছে। তার মানে মামলার এজাহার হয়েছে, আসামিও হয়ত কিছু ধরা হয়েছে। কিন্তু আসামিদের বিচার কবে হবে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমরা কী কেবল কিছু আশ্বাস পেলাম?”

হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার প্রতিবাদে পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড হাতে চট্টগ্রামে পূজা উদযাপন পরিষদের সমাবেশ। ফাইল ছবি: সুমন বাবু

কুমিল্লার চান্দমনি মন্দির কমিটির নেতা হারাধন চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তখন সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে মন্দির সংস্কারের আশ্বাস দেওয়া হলেও সেটা এখনও পাওয়া যায়নি। মন্দিরের ট্রাস্টি ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন, সেটাই একমাত্র অনুদান। এরসঙ্গে মন্দিরের ফান্ড মিলিয়ে গত কালীপূজার সময় খালি মন্দিরের সব বাতি ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।”

রানা দাশগুপ্ত বলেন, “সহিংস হামলাগুলোতে যে মন্দিরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বেশ কিছু জায়গায় এগুলোর পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মান হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছিলেন। তারাও সেরে উঠেছেন। কিন্তু মনের ক্ষতটা কী আর সারবে? আতঙ্ক, উদ্বেগ, নিরাপত্তাহীনতা…”

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা শুরুর পরপর সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠিন বার্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার কঠোর হলে এই ঘটনাগুলো শুরুতেই থেমে যেত। পরে যে রকম আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে যাওয়ার পর এসব ঘটনা থেমে যায়।”

এবারের হামলার কারণ খুঁজতে গিয়ে নূর খান বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, পাশের ত্রিপুরার মুসলিম জনগোষ্ঠৗর সঙ্গে যে বিষয়গুলো ঘটেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।”

সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনায়ও শারদীয় দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশে সহিংসতার প্রসঙ্গটি আসে।

পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, “দুর্গাপূজার পর যে সমস্যা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে আমাদের দেশে সংখ্যালঘু হিসাবে কাউকে ট্রিট করা হয় না। সকলের সমান অধিকার দেওয়া হয়।”

ফেনীতে হামলার শিকার মন্দিরের প্রতিমা। ফাইল ছবি

নূর খান বলেন, “আরেকটা বিষয় হচ্ছে এ ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দল ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে অব্যাহতভাবে। সরকার যদি যথাযথ নজরদারিতে রাখত, কঠোর বার্তা দিতে পারত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। যেসব ঘটনা স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের ললাটে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিল।”

অতীতে এই ধরনের ঘটনায় হামলা প্রতিরোধে অনেকে এগিয়ে এলেও এবার তা ঘটেনি কোথাও। কোনো রাজনৈতিক কর্মীকে পাশে না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন হামলার শিকাররা।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেন। দেখা গেল এর ৮-১০ দিনের মাথায় আবার হবিগঞ্জে একই ঘটনা। এখন আমাদের দেখার বিষয়, জিরো টলারেন্সের ভবিষ্যৎটা আসলে কেমন দাঁড়াচ্ছে।”

সামনে প্ল্যাকার্ডে প্রতিবাদের ভাষা, পেছনে চলছে স্লোগান। মঙ্গলবার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সাংবাদিকের বিক্ষোভ সমাবেশ। ফাইল ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বাংলাদেশ চার মূলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা পুরোপুরি বাস্তবায়নে আরও কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান।

তিনি সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেন, “জাতীয়তাবাদ চূড়ান্তভাবে অর্জিত হয়েছে। এটা নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু চিন্তার কারণ হল গণতন্ত্র নিয়ে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে। কারণ যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সেদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা টেকসই ভিত্তিতে করা সম্ভব না।”

হামলার দুই মাস পর কী অবস্থা এখন- জানতে চাইলে কুমিল্লার হারাধন চক্রবর্তী বলেন, “ওই হামলার পর অনেকের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, সেটা কেটে গেছে তা বলা যাবে না।

“আসলে এগুলো নিয়ে কেউ আলোচনাও করছে না। অনেকে ভেতরে ভেতরে তুষের আগুনের মতো জ্বলছে। এই দেশে আসলে এটাই আমাদের জীবন।”