৯ বছরে হিন্দুদের উপর ‘৩৬৭৯ হামলা’

কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় পূজামণ্ডপে হামলা ভাংচুরের মধ্যে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, গত নয় বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে।

গোলাম মর্তুজা অন্তু জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2021, 06:12 AM
Updated : 18 Oct 2021, 07:34 AM

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাটি প্রতিবছরই মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রতিবেদন দেয়। ২০১৩ সাল থেকে হিন্দুসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর হামলার ঘটনাগুলোও তারা প্রতিবেদনে আলাদাভাবে দিয়ে আসছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আসক নয় বছরে হিন্দুদের উপর সাড়ে ৩ হাজারের বেশি হামলার তথ্য দিলেও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি বলে দাবি করেন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

হামলায় তছনছ কুমিল্লার কাপড়িয়াপট্টি শ্রী শ্রী চান্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরের মূল ফটক। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

দুর্গাপূজার মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকটি মণ্ডপ ও স্থাপনা ভাংচুর হয়।

তার জের ধরে তিন দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ হিসাব দেয়।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে হিন্দুদের উপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে।

এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এই সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে।

প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি।

এসব হামলায় আহত হয়েছে ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নিহত হয়েছে ১১ জন।

এর বাইরেও ২০১৪ সালে দুজন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন। শ্লীলতাহানি করা হয় আরও চারজনের।

এছাড়া ২০১৬, ২০১৭ ও ২০২০ সালে ১০টি হিন্দু পরিবারকে জমি ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দখলের অভিযোগ ওঠে।

আসকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত নয় বছরে হিন্দুদের উপর সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে ২০১৪ সালে।

ওই বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। এর পরবর্তী সহিংসতার শিকার হন হিন্দুরা। ৭৬১টি হিন্দু বাড়ি-ঘর, ১৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ২৪৭টি মন্দির-মণ্ডপে হামলা হয় ওই বছর। তখন নিহত হন একজন।

সবচেয়ে কম হামলা হয়েছে ২০২০ সালে। মহামারীর মধ্যে গত বছর ১১টি বাড়ি ও ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার তথ্য রয়েছে আসকের প্রতিবেদনে। তবে মন্দিরে হামলা হয়েছে ৬৭টি।

তথ্য ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হিন্দু খুন হয়েছে ২০১৬ সালে, মোট সাতজন। এসব হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলো ‘জঙ্গি হামলা’ বলে পরে জানিয়েছে পুলিশ।

‘প্রকৃত হামলা আরও বেশি’

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে আপনারা যে সংখ্যা পেয়েছেন, এটাকে মিথ্যা বলছি না। কিন্তু ঘটনা এর চেয়ে আরও অনেক বেশি। গত ১৩ বছরে হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে কয়েক হাজার।”

জাতীয় পার্টি, বিএনপির আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “১৯৯০ সাল এরশাদের আমলে তিন দিন, ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর ২৭ দিন এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের পুরো আমলজুড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে।”

দুর্গাপূজা ঘিরে তিন দিনের হামলা ও সহিংসতার তথ্য সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

তিনি বলেন, “হামলার খবর শুনে আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি, তারা যেন দেশ ছেড়ে চলে না যান। যে কারণে আমরা বিভিন্ন ঘটনাস্থলে যাই। তাদের দেখানোর চেষ্টা করি যে দেখ তোমাদের পাশে আমরা রয়েছি।”

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই ধারার পরিবর্তন আশা করছিলেন প্রবীণ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত, তবে এখন হতাশ হওয়ার কথাই বলেন।

“আমরা আশা করেছিলাম, এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে গত কয় দিনের হামলা পর্যন্ত একই ধারায় সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়ে আসছে।”

এই ধারার কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ তৈরি হয়েছিল বাঙালিত্বের ধারণা থেকে। এই ধারণা থেকে বাংলাদেশ অনেক সরে এসেছে। সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। এই সংবিধান সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ‍উৎসাহিত করছে।

“বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতার অংশীদার করেছিল। বর্তমান সরকার তাদের ক্ষমতার অংশীদার না করলেও সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে এক রকম আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আঁতাত চলছে। যার কারণে কারণে পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক শক্তির নির্দেশনার ভিত্তিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।”

এই কারণে এখন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকারদের পক্ষে পুলিশ, প্রশাসন কাউকে পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন রানা দাশগুপ্ত।

“সরকারের পক্ষ থেকে যতই আশ্বাস দেওয়া হোক, (সংখ্যালঘু নির্যাতনের) ঘটনার সময় পাশে কেউ নেই। পুলিশ, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক দল কাউকেই পাশে পাওয়া যায় না। অবস্থাটা দেখেন নবমীর দিন প্রধানমন্ত্রী হামলাকারীদের প্রতি কঠোর বার্তা দিয়ে বক্তব্য রাখলেন, এই বক্তব্য সংখ্যালঘুদের মনে আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু বক্তব্যের পরের দিনই চৌমুহনী, চট্টগ্রামসহ নানা জায়গায় হামলা হলো। এখন হিন্দুদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।”

ফেনীতে সংঘর্ষ বাঁধে শনিবার।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনায় বরাবরই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলে।

এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি এবং তাদের জোটসঙ্গী দলগুলোকে দায়ী করেছে হিন্দুদের উপর হামলার জন্য। আবার বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, ক্ষমতাসীনরাই এসব ঘটিয়েছে।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হিন্দুদের উপর বারবার হামলা চলছে। একটা জিনিস স্পষ্ট, এটার নেপথ্যে রাজনীতি রয়েছে।

“যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের কিছু লোকজন এসবে যুক্ত থাকেন। সরকারদলীয় মাঝারি গোছের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা রামুতে দেখেছি, লামায় দেখেছি। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেরা লাভবান হওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়।”

পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক দোষারোপ চললেও মূল অপরাধটি আড়াল হয়ে যায় বলে সঙ্কটের সমাধানও আসছে না বলে মনে করেন নূর খান।

“যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তখনই তারা বিরোধী দলের দিকে আঙুল তোলেন। যার ফলাফল এসবের কোনো বিচার হয় না। গত ১০/১৫ বছরের ঘটনা দেখলে দেখা যাবে, কোনোটারই বিচার হয়নি। এমন কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি হয়নি, যাতে অপরাধীরা ভাবতে পারে যে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়া যাবে না। যার ফলে ঘটনা ঘটেই চলেছে, মাত্রাও বাড়ছে।”

এই সংক্রান্ত খবর