শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্কের উত্তর কিন্তু দিয়ে গেছেন মারাদোনা!

কাতার বিশ্বকাপ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্কও শুরু হয়েছে নতুন করে।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Nov 2022, 08:02 AM
Updated : 25 Nov 2022, 08:02 AM

‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’, নামে একটা বই-ই লিখেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন। তবে কেবল এই উপমহাদেশের নয়, সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরাই তর্কপ্রিয়। লিওনেল মেসি, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো পরস্পরকে যতই শ্রদ্ধা, সমীহের কথা বলুন, তাদের ভক্তদের কানে সে কথা পৌঁছায়ই না। কালেভদ্রে পৌঁছালেও বিশ্বাসের ভিত পায় না। ফুটবলের দুই মহাতারকার কাতার বিশ্বকাপে পথচলা শুরুর পর তাই পুরানো সেই শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্ক শুরু হয়েছে নতুন করে। 

ফুটবলে এমন অমীমাংসিত বির্তকের অন্ত নেই। পেলে না মারাদোনা, মারাদোনা না মেসি, ইউজেবিও নাকি রোনালদো-এগুলোর সঙ্গে সক্রেতিস, জিকো, আলফ্রেদো দি স্তেফানো, গারিঞ্চারাও চলে আসেন তর্কের টেবিলে। ইদানিং এই বিতর্ক মূলত মেসি ও রোনালদোকে ঘিরে। মাঝে কিছুদিন কিছুটা থেমে থাকার পর এর পালে হাওয়া লেগেছে কাতার বিশ্বকাপে দুজনের ভিন্নরকম পথচলা শুরুর কারণে। 

গোলের আনন্দ অবশ্য সঙ্গী হয়েছে দুজনেরই, কিন্তু জয়ের উচ্ছ্বাস কেবল রোনালদোর। বিষাদের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন মেসি। রোমাঞ্চকর ম্যাচে ঘানার বিপক্ষে ঘাম ছোটানো জয়ে কাতার বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করেছে রোনালদোর পর্তুগাল। অন্যদিকে আশা জাগিয়ে সৌদি আরবের বিপক্ষে হারের হতাশায় ডুবেছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। 

দুজনের এই পথচলায় যে একেবারে অন্তমিল নেই, তা নয়। দুজনের গোল পেনাল্টি ভাগ্যে পাওয়া। সৌদি আরবের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে হেরে যাওয়া ম্যাচের দশম মিনিটে মেসি, ঘানার বিপক্ষে ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচের ৬৫তম মিনিটে স্পট কিকে জাল খুঁজে নেন রোনালদো। দুজনে পরে আর পাননি গোলের দেখা। 

ওই গোলেই রেকর্ডের দুই বরপুত্র যথারীতি আচঁড় ফেলেছেন অনেক পাতায়। সেখানেও দুজনের মধ্যে জমজমাট দ্বৈরথ চলছে বছরের পর বছর ধরে! আর্জেন্টিনার প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের চারটি ভিন্ন আসরে জালের দেখা পেলেন মেসি। এ পাতায় এগিয়ে রোনালদো। পর্তুগাল তো বটেই, বিশ্বকাপের ইতিহাসে টানা পাঁচ বিশ্বকাপে গোল পাওয়া প্রথম খেলোয়াড়ের মুকুট এখন তার মাথায়। 

আন্তর্জাতিক গোলের পাতায় শীর্ষে থাকা রোনালদোর গোল এ নিয়ে ১১৮টি, পেছনে থাকা মেসির হলো ৯২টি। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা অধিনায়কের গোল হলো এ নিয়ে ৭টি, পর্তুগিজ অধিনায়কের ৮টি। রেকর্ডের পাতায় দুজনের এমন ইদুর দৌড় চলছে বিরামহীনভাবে। ফলে সমর্থকদেরও বিতর্ক থামিয়ে একটু দম নেওয়ার ফুসরত নেই। তাই তাদের মধ্যেও এই বিতর্কের স্রোত অনুক্ষণ বইতে থাকা নানা যুক্তি-তর্কের বাঁক পেরিয়ে।

মেসি সমর্থকদের দাবি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলতে পেরেছেন, রোনালদো পারেননি আজও। অন্যদিকে রোনালদো ভক্তদের দাবি, পর্তুগালকে যেখানে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ও নেশন্স লিগের শিরোপা এনে দিয়েছেন ‘সিআর-৭’, সেখানে মেসি কেবল দিয়েছেন কোপা আমেরিকার একটি মাত্র ট্রফি। বর্ষসেরা পুরস্কার পাতায় দুজনের দুই বারের ব্যবধানের ফিরিস্তিও সুড়সুড় করে চলে আসে বিতর্কের টেবিলে, সেখানে আবার ৭টি জেতা মেসি ভক্তরা এগিয়ে। 

সমর্থকদের এই বিতর্কের বাইরে নয় গণমাধ্যম কর্মীরাও। তারাও শামিল প্রবলভাবে। কাতার বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কয়েকজনের কাছে মেসি না রোনালদো সেরা, এই প্রশ্ন করেছি। শৈল্পিক ফুটবলের একনিষ্ঠ পূজারিদের ভোট মেসির বাক্সে, শক্তি ও সাফল্যের জন্য দুনির্বার আকাঙ্ক্ষার প্রতি যাদের নিদারুণ টান, মোহ, তারা রোনালদোর পক্ষে। 

কর্মব্যস্ততার ফাঁকে বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মিলেছে দুই রকম উত্তর। যথারীতি তারাও বিভক্ত। সিঙ্গাপুর থেকে আসা ফ্রিল্যান্সার কিম হিম যেমন রোনালদোকে সেরা বেছে নিলেন উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে। ওদিকে স্পেনের আরইটিভির পাকোর কাছে মেসি ফুটবলেরই সমার্থক। 

ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল ১০টি বিশ্বকাপ কাভার করা ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক বাতিস্তা নাদাল। ৭৭ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ সাংবাদিক তার অভিজ্ঞার দৃষ্টিতে মেসি ও রোনালদো কাউকেউ সেরা বেছে নেননি। তার কাছে এই দুজনে অসাধারণ, কিন্তু সেরা নয়। 

তাহলে সেরা কে? যথারীতি এই বিতর্ক গড়ায় পেলে-মারাদোনা ইস্যুতে। বাতিস্তাও যেন থেমে যাওয়া এ বিতর্ক উস্কে দিলেন নতুন করে। দুই গ্রেট পেলে ও মারাদোনার শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে একবাক্যের উত্তরে বলেছিলেন-এদসন আরেন্তোস দো নাসিমেন্তো। ফুটবল বিশ্ব যাকে একনামে পেলে বলে চেনে। 

শ্রেষ্ঠত্বের এই বিতর্কের সমাধান কিন্তু জীবদ্দশায় দিয়েছিলেন মারাদোনা! ‍দুই বছর আগে ২০২০ সালে এই ২৫ নভেম্বরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন মারাদোনা। শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্ক নিয়ে একবার এই জাদুকর কথা ছিল বেশ আবেগ অথচ চিরায়ত সত্য মোড়ানো। 

“আমার মা মনে করেন আমিই সেরা এবং মা আমাকে যেটা বলেছেন, আমি সবসময় সে অনুযায়ী বেড়ে উঠেছি।” 

পৃথিবীর সব মায়ের কাছে তো তার সন্তানই সেরা। মেসি, রোনালদোর মায়ের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয় একবিন্দু। খামাখা কেন এত তর্ক? স্রেফ তর্কপ্রিয় বলে?