হঠাৎ দেখা ডাচ-নায়কের সঙ্গে

অ্যাডিলেইডের রেস্টুরেন্টে নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটার বাস ডে লেডের সঙ্গে দেখা ও আড্ডার গল্প।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2022, 01:03 PM
Updated : 4 Nov 2022, 01:03 PM

ম্যাকডোনাল্ডসের খাবার ডেলিভারির লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দেখে চেনা চেনা লাগল। কাছাকাছি গিয়ে ডান চোখের নিচে সেলাই দেখে ধারণাটা আরও পোক্ত হলো। তিনিই তো…! 

কাছে গিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললাম, “বাস ডে লেডে…?” 

ফোন থেকে চোখ সরিয়ে চমকে ওঠা হাসিতে তিনি বললেন, “ইয়েস… আই অ্যাম। হাউ আর ইউ ডুয়িং, মেট?” 

মানে, আসলেই বাস ডে লেডে দাঁড়িয়ে আছেন সামনে! 

ঘড়ির কাটায় তখন অ্যাডিলেইড সময় রাত আড়াইটা। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের পর কাজ শেষ করে বাংলাদেশের কয়েকজন সংবাদকর্মী রাতের খাবারের সন্ধানে ইতিউতি ঘুরে শেষ পর্যন্ত দেখা পান ম্যাকডোনাল্ডসের। সেখানেই দেখা হয় নেদারল্যান্ডসের এই অলরাউন্ডারের সঙ্গে। 

বিশ্ব ক্রিকেটের বড় তারকা নন তো বটেই, খুব পরিচিত কোনো নামও তিনি নন। তবে এই মুহূর্তে বিশ্বকাপ তিনি বেশ আলোচিত নাম। আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি ওই চোখের নিচে সেলাইয়ের কারণেই। 

গত রোববার পার্থে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ওই আঘাত পান ডে লেডে। ম্যাচের ষষ্ঠ ওভারে হারিস রউফের বাউন্সারে পুল করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু গতি আর বাড়তি বাউন্সে তাল মিলিয়ে টাইমিং ঠিকঠাক করতে পারেননি। বল লাগে তার ফেস গার্ড বা হেলমেটের গ্রিলে। 

আঘাত পেয়ে তখনই হেলমেট খোলার চেষ্টা করেন তিনি। তবে পারছিলেন না খুলতে। কাছে থাকা ফিল্ডার শান মাসুদ গিয়ে সহায়তা করেন তাকে হেলমেট খুলতে। 

হেলমেট খুলতেই দেখা যায়, তার মুখ রক্তাক্ত। দ্রুতই মাঠে প্রবেশ করেন দলের ফিজিও। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে মাঠ ছাড়তে হয় তখনই। 

তবে তার সাহসিকতার প্রমাণও মেলে তখনই। প্রচণ্ড ওই আঘাতের পরও তার মুখে দেখা যায় হাসি। তোয়ালে চেপে রক্ত আটকানোর চেষ্টা করতে করতেই তিনি মাঠ ছাড়েন হাসিমুখে। 

পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাকে মাঠ ছাড়তে হয় ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে। তবে বিশ্বজুড়ে অনেক ক্রিকেট ভক্তের হৃদয়ে জায়গা পেয়ে যান তিনি। সেদিন আর ব্যাটিংয়ে নামতে পারেননি তিনি। তার ‘কনকাশন সাব’ হিসেবে একাদশে আসেন লোগান ফন বিক। 

তবে খুব বেশি সময় মাঠের বাইরে রাখা যায়নি তাকে। চোখের নিচে সেলাই পড়ে গোটা ছয়েক। তারপরও পরের ম্যাচেই অ্যাডিলেইডে জিম্বাবুয়ে বিপক্ষে মাঠে নেমে যান তিনি। পারফর্মও করেন দারুণ। শুরুতে বল হাতে ২ উইকেট নেন ৪ ওভারে স্রেফ ১৪ রান দিয়ে। পরে ব্যাট হাতে ১২ রানে অপরাজিত থাকেন দলের দারুণ জয়ে। 

সেই ম্যাচ শেষেই রাতে কাকতালীয়ভাবে দেখা বাস ডে লেডের সঙ্গে। “চোটের অবস্থা তো এখন বেশ ভালো… এটা বলতেই স্বতস্ফূর্ত হয়ে তিনি বললেন, “হ্যাঁ, অনেক ভালো। সেদিন তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভয় মানে খেলার ভয় নয়। কিন্তু বলটা লাগার পর যখন রক্তারক্তি কাণ্ড হলো, মনে হলো বিশ্বকাপই শেষ হয়ে গেল কিনা। শেষ পর্যন্ত এমন গুরুতর কিছু হয়নি, এটাই বড় ব্যাপার।” 

প্রতিটি কথা বলার সময় তার চোখেমুখে ছিল উচ্ছ্বল হাসি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দারুণ উপভোগ করছিলেন তিনি। নিজ দেশে তারকা খ্যাতির কিছুই পান না তারা। নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলছে, তাদের দেশে কজন তা জানেন, এটা গবেষণার বিষয়। সেখানে সুদূর বাংলাদেশের সংবাদকর্মী মনোযোগ পেয়ে দারুণ খুশি ডে লেডে। 

তার পাশে থাকা একজনকে দেখিয়ে বললেন, “আজকে যে আমি ম্যাচ খেললাম, এখন তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি, এসব কিছুই এই লোকের অবদান। তিনিই আমার শুধু সেলাই-টেলাই করে দিয়েছেন নয়, মাঠে নামার প্রেরণাও জুগিয়েছেন।” 

যাকে নিয়ে এসব বলছেন ডে লেডে, তিনি নেদারল্যান্ডসের দলীয় চিকিৎসক। তার সঙ্গেও পরিচয় হলো। 

জিম্বাবুয়ের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের দারুণ জয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতেই ডি লেডে বেশ আপ্লুত। আরও চমক দেখানোর আশার কথাও বললেন। 

দুর্ঘটনার ম্যাচটিও ফিরে এলো। ম্যাকডোনাল্ডসে তখন খাবার প্রস্তুত হচ্ছে। এই ফাঁকে ঘটনার আগে-পরের নানা গল্প শোনালেন ডে লেডে। 

“হারিস রউফের গতি অনেক বেশি, বল স্কিড করে, এসব জানতাম। তারপরও আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, কারণ পুল শট আমি ভালো খেলি। কিন্তু ওই বলটিতে টাইমিং হলো না। এরপর তো যা হবার তা হলো…।” 

“পাকিস্তানিরা অনেকেই এসেছিল কাছে। খোঁজ-খবর নিয়েছে। পরেও নিয়েছে। ম্যাচের পর হারিস এসে বলেছে, ‘এই অভিজ্ঞতার পর তুমি আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরবে। আর পরেরবার আমি শর্ট বল দিলে তুমি ছক্কা মেরে দিও।’ বেশ মজা হয়েছে তখন।” 

নিজেই দেখালেন, তার ডান চোখের কোনা তখনও রক্ত লাল। উইকেট কিপিং করার বেলস চোখে লেগে সাবেক পদক্ষিণ আফ্রিকান কিপার মার্ক বাউচারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল একটু আগেভাগে। ডে লেডে বললেন, তিনি আপাতত নিরাপদ। 

“হ্যাঁ, বাউচারের ঘটনা জানি। আমার এখন সব ঠিক আছে। শুরুতে একটু ভয় পাচ্ছিলাম যে চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হলো কিনা। কিন্তু ভাগ্য ভালো, দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা হয়নি।” 

বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ নিয়েও বেশ আগ্রহ দেখালেন, “বেশ ভালো ম্যাচ হলো তো, তাই না? দেখতে পারিনি খেলা খুব একটা, তবে স্কোর দেখছিলাম। বাংলাদেশ ভালোই খেলেছে তো, তবে জেতা উচিত ছিল হয়তো…।” 

নেদারল্যান্ডসের এই দলের সবচেয়ে বড় উঠতি প্রতিভা মনে করা হয় তাকে। বয়স এই মাসে হবে ২৩। এখনই দলের ব্যাটিংয়ের বড় ভরসা হয়ে উঠেছেন। ৩০ টি-টোয়েন্টি খেলে ৬০৯ রান করেছেন ৩২.০৫ গড়ে। স্ট্রাইক রেট যদিও খুব ভালো নয় (১০৭.০২), তবে উন্নতির সুযোগ তো আছেই। 

গত অগাস্টে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে করেন তিনি ফিফটি। কদিন পর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে খেলেন ৮৯ রানের ইনিংস। গত জুনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও ওয়ানডেতেও করেন ফিফটি। 

তার উঠে আসা ক্রিকেট পরিবার থেকে। বাবা টিম ডে লেডে ছিলেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার। একসময় ছিলেন নেদারল্যান্ডস দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২৯টি ওয়ানডে খেলেছেন দেশের হয়ে, অংশ নিয়েছেন ১৯৯৬ ও ২০০৩ বিশ্বকাপে। ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে শচিন টেন্ডুলকার ও রাহুল দ্রাবিড়ের উইকেটসহ ৪ উইকেট নেন ৩৫ রানে। ভারতকে সেদিন ২০৬ রানে আটকে দিয়ে অঘটনের স্বপ্ন দেখছিল নেদারল্যান্ডস। কিন্তু পরে আর পেরে ওঠেনি। তবে ম্যাচের সেরা পুরস্কার পান টিম ডে লেডেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৯৯০, ১৯৯৪ ও ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে মাঠে নামেন টিম। 

তার বাবার প্রসঙ্গও তুলব বলে ভাবছিলাম। এর মধ্যেই কাউন্টার থেকে ডাক পড়ল। তার খাবার হয়ে গেছে। খাবার নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আন্তরিক হাসিতে বিদায় নিলেন। তাতে পরের ম্যাচ নিয়ে শুভ কামনা জানাতেই তিনিও শুভ কামনা জানালেন বাংলাদেশের জন্য।