ব্রাজিলের জয়ের আগেই স্টেডিয়াম-৯৭৪-এর প্রবেশ পথে দারুণ দ্যোতনা তুলে বাজতে থাকে এই সুর!
Published : 06 Dec 2022, 10:11 AM
ম্যাচ তখনও শুরু হয়নি। স্টেডিয়ামের দিকে বইছে হলুদ জার্সির স্রোত। এক দল ব্রাজিল সমর্থক নেচে-গেয়ে মাতিয়ে রাখলেন মেট্রোতে গাদাগাদি করে যাওয়া পথটুকু। এরপর মাঠের প্রবেশ মুখে দারুণ দ্যোতনায় বাজতে থাকে ওই সুর। যে সুরের পরতে পরতে আছে ২০ বছরের হাহাকার; আছে কাতার থেকে শিরোপা নিয়ে ফেরার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষাও।
মেট্রো থেকে নেমে দোহার প্রতিটি স্টেডিয়ামে যেতে কমপক্ষে এক-দুই কিলোমিটার হাঁটতে হয়। এজদান থেকে আল ওয়াকরা গিয়ে মেট্রোতে চেপে মোশাইরেফ হয়ে রাস বু আবুদে যাওয়ার পথটাও কম দীর্ঘ নয়। তবে এই যাত্রাটুকুতে ক্লান্তি থাকে না। থাকবেই বা কী করে? সেলেসাও সমর্থকরা যে প্রতিটি কেবিন সরাক্ষণ মাতিয়ে রাখেন নেচে-গেয়ে।
স্টেশিনে নামার পর হাঁটা শুরু ‘আজব’ এক স্টেডিয়াম অভিমুখে। এমন বলার কারণ, এর নাম ‘স্টেডিয়াম-৯৭৪।’ ৯৭৪টি শিপিং কনটেইনার দিয়ে বানানো বলে এমন অদ্ভূতুড়ে নাম। কেউ কেউ বলেন কাতারের আন্তর্জাতিক কলের কোড +৯৭৪ হওয়া এমন নামকরণের আরেকটি কারণ।
স্টিল-টিনের কন্টেইনার দিয়ে বানানো এই স্টেডিয়ামে নান্দনিকতার তেমন কোনো ছাপ নেই। ব্রাজিল ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যেকার শেষ ষোলোর ম্যাচটিই এর সবুজে হওয়া শেষ ম্যাচ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র অপসারণযোগ্য এই স্টেডিয়ামটি আসরের শেষে ভেঙে ফেলা হবে। কন্টেইনারগুলো ফিরে যাবে নিজেদের কাজে। কিন্তু আজ থেকে অনেক বছর পরও এর অন্দরে কান পাতলে ঠিকই শোনা যাবে, এ মাঠে একদা ব্রাজিল ফুটিয়েছিল সুন্দর ফুটবলের সুর।
প্রতিটি মেট্রো স্টেশনের ভেতরে-বাইরে স্বেচ্ছাসেবকদের ছড়াছড়ি, গুণে শেষ করা কঠিন। প্রায় প্রত্যেকের হাতে পথনির্দেশক। তর্জনি তাক করা হাতের কব্জির আকৃতির বড় বড় প্ল্যাকার্ডের মতো। কেউ পকেট ভর্তি করে রেখেছেন দোহার অলি-গলির মানচিত্রে। কেউ চাইলে তাকে দিচ্ছেন, বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোনটা রেড লাইন, কোনটা গ্রিন কিংবা ইয়োলো লাইন। কোন লাইন ধরে কোন মাঠে যাওয়া যাবে, ইত্যাদি-ইত্যাদি।
কারো হাতে মাইক, এই পথ এদিকে, ওই পথ ওদিকে, স্টেডিয়ামের রাস্তা এদিকে-এমন নানা নির্দেশনা তারা দিয়ে চলেছেন তো চলেছেনই। মূলত প্রতিটি মেট্রোর বাইরেই একটি বিষয় মোটামুটি কোরাসের মতো শোনা যায়। স্বেচ্ছাসেবকদের যিনি নেতা, তিনি একবার চেঁচিয়ে বলেন ‘স্টেডিয়াম’, বাকিরা গলা ফাটিয়ে সমস্বরে বলে ওঠেন ‘দিস ওয়ে।’ এই নির্দেশনায় দর্শক, সমর্থক, গণমাধ্যমকর্মী সবাই যেন মরুভূমিতে দিশা খুঁজে পায়। পা বাড়ায় গন্তব্যের পানে।
রাস বু আবুদ স্টেশনের বাইরেও সেচ্ছ্বাসেবকরা অনর্গল বলে চলছিলেন, ‘স্টেডিয়াম-দিস ওয়ে।’ হঠাৎ এই স্লোগান গেল বদলে! ব্রাজিল সমর্থকদের ঢল থেকে এক সমর্থক গিয়ে এক ভলান্টিয়ারের কাছ থেকে মাইক নিয়েই বলা শুরু করলেন, ‘হেক্সা’, বাকি ভলান্টিয়াররা বুঝে হোক, না বুঝে হোক হাসি মুখে তাল মেলালেন, “দিস ওয়ে’ বলে।
এই কোরাসের সুর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। নাম না জানা ওই ব্রাজিলিয়ানের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায় স্টেডিয়ামে আসা হাজারো সেলেসাও সমর্থক। মুহূর্তেই ‘হেক্সা-দিস ওয়ে’, ‘হেক্সা-দিস ওয়ে’-এই ছন্দের মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে ওঠে চারিধার। মরুপ্রান্তে যেন ব্রাজিলের দুই দশকের ষষ্ঠ শিরোপার আক্ষেপ, তা কাটানোর দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে অন্যরকম দ্যোতনা ছড়িয়ে।
নেইমার-রিশার্লিসনদের কানে গিয়েও যেন বেজে ওঠে কোরাসের ওই সুর। দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করেন হেক্সার অভিযানে ঠিক পথেই আছে ব্রাজিল।