দেশে বিদেশে চলার পথে

সুইডেনে বসবাসরত লেখিকা তার দেশে-প্রবাসের কিছু টুকরো স্মৃতি তুলে ধরেছেন এ লেখায়।

রাবেয়া মীর, সুইডেনের স্টকহোম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2022, 08:30 AM
Updated : 4 Dec 2022, 08:30 AM

কয়েকবছর আগে, এক বিকেলে আমি আর আমার জা শামসাদ ঢাকায় শিশু একাডেমির পথ ধরে হাঁটছি। হঠাৎ টের পাই, পেছন থেকে কেও একজন আমার গায়ে হাত দিয়েছে। ফিরে দেখি এক প্রাপ্তবয়স্ক লোক। শরীরের সকল শক্তি দিয়ে তৎক্ষণাৎ তাকে ঘুষি মারি। লোকটা এক দৌড়ে পালায়। শামসাদ বলে ওঠে, “ভাবী, তোমার সাহস দেখে আমি ভয় ও গর্ব দুটোই অনুভব করছি। ভয় পাচ্ছি, লোকটা পাশের চলমান মিছিলের অংশ বলে, যদি উল্টো ঝাঁপিয়ে পড়ে। গর্ববোধ করি তোমার প্রতিবাদ দেখে”। আমি বললাম, যে অন্যায় করে সে দুর্বল। 

দ্রেসদেন শহরে

২০১১ সালের দিকে জার্মানির দ্রেসদেন শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করি।  একদিন আমার ১১ মাসের পুত্র-সন্তানকে নিয়ে একটি ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেন ধরবো বলে অপেক্ষা। পাশেই একজন বৃদ্ধ নারী তার রোলিং চেয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিও ট্রেন ধরবেন। আমাদের চোখাচোখি হয়। আন্তরিকতার ছাপ পরস্পরের মুখে। আমাদের কথার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম তিনি আমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি এসো, আমি একা থাকি’। সেদিনই আমার ছেলেকে কিন্ডারগার্টেন থেকে নিয়ে ফেরার পথে ফুল নিয়ে তার দরজায় টোকা দিই। তিনি খুব খুশি। বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা। পরেরদিন বিকেলে তিনি কেক বানিয়ে নিয়ে আমার বাসায় হাজির। অনেক গল্প। তারপর থেকে প্রতি বিকেলে আমাদের চায়ের আড্ডা। সেইসাথে আমার জার্মান ভাষা শেখার চেষ্টা, গল্প, হাসি কত কী । আমি তখন তিরিশের কোঠায় । 

উনি আমার দ্বিগুণের চেয়ে একটু বেশি বয়সী । বয়সের পার্থক্য টের পাইনি আমরা। এখন ওর বয়স আশি ছাড়িয়ে গেছে। দুজন ভিন্নদেশে থাকি, ফোনকলে ওপার থেকে ও বলে ওঠে, "রাবেয়া, প্রতি বিকেলে আমার দরজায় তোমার টোকা, আমি এসেছি বলে তোমার জানান দিয়ে যাওয়া ভুলতে পারি না। আমাদের একত্রিত সেসময়টি আমাকে এখনও আন্দোলিত করে”। 

সুইডেনে 

প্রত্যেক শ্রেণিতেই কিছু শিক্ষার্থী থাকে যাদের শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিতে কষ্ট হয়। খুব নড়াচড়া, অন্যের সাথে কথা বলা, এটা ওটা ছুঁড়ে মারা ইত্যাদি।  এটা হতে পারে। শিক্ষককে তখন বিভিন্ন  উপায়ে কথা বলে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ স্বাভাবিকে আনতে হয়। আমি ভিনদেশে ভিন্ন ভাষায় কলেজে শিক্ষকতা করি। এ ধরনের  পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন। আমার ভেতরের শক্তি চূড়ান্তে। দুর্বল, লাজুক, অমনোযোগী শিক্ষার্থীটিও পারবে, এরকম আমার প্রত্যয়। দুর্বল শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াতে হবে।  ওকেও শ্রেণিকক্ষে সমানভাবে বা প্রয়োজনে অধিকতর গুরুত্ব দিই। শিক্ষার্থীটি মনোযোগী হয়, শ্রেণীকক্ষে তার উপস্থিতি বাড়ে। মনে পড়ছে আমার ছাত্রজীবনের কথা।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 

ভিনদেশে পিএইচডির গবেষণা কাজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ গবেষণাগারে  ফিরি।  একদিন  বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে স্যার ডেকে পাঠান,  অন্যদের সঙ্গে আমিও যাই।  স্যার একটি চিঠি বের করেন। একটু ঘাবড়ে যাই। কিসের চিঠি? কেনইবা স্যার আমাদের ডেকে আয়োজন করে পড়ছেন? জার্মানির যে গবেষণালয়ে গবেষণা কাজ করেছি চিঠিটি ওখান থেকে পাঠানো। ওখানকার সিনিয়র গবেষক স্যারকে লিখেছেন, ঠিক রাবেয়া-র মতো ছাত্র পাঠাও। ওর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আর দায়িত্বের সাথে কাজ আমাদের মুগ্ধ করেছে। স্যার শুধু বলেছিলেন, ”আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর না হওয়াটা সর্বত্র প্রয়োজন। অন্যকে প্রাধান্য দিতে হয়”।  

কেনিয়ায়

২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আমার সহকর্মী মারিনা ইউং, আমি ও আমাদের দুইজন ছাত্র কর্মস্থল থেকে একটি কাজ নিয়ে কেনিয়ার কিসি নামক জায়গার একটি কলেজে যাই। পাশেই অবস্থিত স্কুলটির মাঠ পেরিয়ে আমরা যখন কলেজের দিকে যাই স্কুলের বাচ্চারা আমাদের দেখা মাত্রই ছুটে  আসে এবং মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে। আমরা ওখানেই দাঁড়িয়ে যাই। ওরা মারিনার সাদা হাত, বাদামি চুল স্পর্শ করে দেখতে থাকে। এক পর্যায়ে একটি বাচ্চা মারিনার হাত টেনে নিয়ে ওর গালে চেপে ধরে এবং ইংরেজিতে বলে ওঠে, ”ইউ অরে সো বিউটিফুল”। মারিনা দেরি না করে প্রতিউত্তরে বলতে থাকে, ”ইউ টু”! ও আরো বলে ”এটা আমার চামড়া, তোমার চামড়ার মতোই। আমাদের দুজনের শুধু দুরকমের রং- কালো আর সাদা, সব রংই  সুন্দর"।

স্কুলটি পেরিয়ে কলেজে পৌঁছাতেই আমরা একটি বিষয়ে অবাক হয়। কলেজটির কোনো শিক্ষার্থীরই মাথায় চুল নেই। আমরা ওখানকার শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস না করে আলাদাভাবে একজন শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে তাদের  মাথায় চুল না থাকার বিষয়টি জানতে চাই। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের পরিবারের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা। চুল রক্ষণাবেক্ষনে অর্থ লাগে যা তাদের পরিবারের সামর্থের বাইরে। তাই স্কুল থেকেই নিয়ম করে দেওয়া কোন ছাত্র মাথায় চুল রাখতে পারবে না।

স্টকহোমের রেস্তোরাঁয় 

রাতের বেলা খাবার টেবিলে পরিবারের সবার সারাদিন কার কেমন কাটলো এসব নিয়ে আলাপ জমে উঠে প্রায়ই। এর মধ্যে একদিন আমাদের ঊনিশ বছরের মেয়ে অনন্যা আমাকে বলছে, “মা জানো, আজ তোমার মতো করেছি”। 

ও বলে, ”আমরা তিন বন্ধু মিলে স্টকহোমের একটি নামকরা রেস্তোরাঁয় নাস্তা জাতীয় কিছু খেতে গিয়েছি। আমাদেরই আরেক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি বলে আমরা ধীরে ধীরে খাচ্ছি। পরিচারক এসে বলে, তোমাদের উঠে যেতে হবে, এতক্ষণ বসে থাকা যাবে না”।  অনন্যা ও তার বন্ধুরা এদিক ওদিক তাকায়, দেখে চারপাশের টেবিল ফাঁকা তবুও পরিচারক এমনটি বলছে।  ওরা  একটু অপমানবোধ করে এবং বের হয়ে আসে ওখান থেকে। অনন্যা বলে, "আমার তখন মনে পড়ে তোমার কথা।  তুমিতো অধিকার আদায়ে তখনই বুঝিয়ে বলো লোককে"। ও তখন বন্ধুদের বলে, “আমি ভেতরে যাবো, মালিকের সাথে কথা বলবো।” বন্ধুরা একটু ইতস্তত ও শঙ্কিত হয়। 

একজন বন্ধু ওর সাথে ভেতরে যায়। অনন্যা ঘটনাটি রেস্তোরাঁর মালিককে বুঝিয়ে বলে, ”তোমার পরিচারক অবন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছে”। বলা শেষে ওরা যখন বের হয়ে আসে, রেস্তোরাঁর মালিক খুব অনুরোধ করে ওদেরকে ফ্রি-ডিনার খেয়ে যেতে।সেই সাথে কথা দেয়- এমনটি হবেনা আর।