আরও একটি ঈদ উদযাপন করছি পরিবার-পরিজন ছাড়া। তাদের ছাড়া একা ঈদ উদযাপন করার যে বেদনা, তা লিখে প্রকাশ করার মতো না।
Published : 15 Jun 2018, 12:30 PM
আমার কয়েকজন বন্ধু মালয়েশিয়া থাকেন। তাই এবার বন্ধুদের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য গতকাল মালয়েশিয়া আসি। সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া আসতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে।
মালয়েশিয়া আসার পর গতকাল বাড়িতে কল দেওয়ার পর ছেলে বলেছিল, “আব্বু, তুমি বাড়ি আসো না কেন? তোমার সাথে আমি ঈদের নামাজ পড়তে যাব।” তার কথা শুনে আমি কিছু বলতে পারিনি। খুব ইচ্ছে ছিল এবার পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপন করব। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে পরিবারের সকলের সাথে ঈদ উদযাপন করা হলো না।
ছেলের কথা শোনার পর গতকাল ঘুমহীন, বিভীষিকাময় ভয়াবহ রাত কাটিয়েছি। রাতে ঘুমাতে গিয়ে মনে হয়েছিল, অনন্তকাল ধরে ঘুমাচ্ছি কিন্তু চোখ খুলে দেখি কয়েক মিনিট ঘুমিয়েছি মাত্র। চোখ বন্ধ করলে দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ কানে বাজে, মনে হয়েছিল অনন্তকাল ধরে এই শব্দ বাজছে আর আমি শুনছি- ঠক্ ঠক্।
আশ্চর্য! শব্দটার সাথে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ঘড়ির ব্যাটারি খুলে রাখার পর কেমন যেন শূন্যতা অনুভব করেছি। আবারও ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা। এভাবেই আধো ঘুম, আধো জাগরণে সারারাত কেটে গিয়েছে। এভাবেই হয়তো প্রতিটি প্রবাসী গতকাল নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে।
ঈদের নামাজ পড়তে যাবার আগে সকালে একজন পরিচিত ব্যক্তির সাথে দেখা, তিনি বাংলাদেশে নিজের ব্যবসা নিয়ে সুখেই জীবনযাপন করতেন। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, আমি গতকাল এখানে এসেছি আর আজ আপনাকে দেখলাম?” পরিচিত ভাই মলিন হাসি হেসে বললেন, “ভাই, আমাকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে হয়। পুলিশ আমাকে প্রকাশ্যে দেখলে জেলে নিয়ে যাবে কিংবা দেশে পাঠিয়ে দেবে।”
তিনি জানালেন, এছাড়া তার উপায় ছিল না। নিজের ব্যবসায় লোকসান খেয়ে পুঁজি হারিয়ে বসেছিলেন। তাই উপায়হীন হয়ে বিদেশে এসেছেন। প্রথমে কাতার যাবার জন্য একজনের কাছে তিন লক্ষ টাকা জমা দিয়েছিলেন। ওই লোক তাকে কাতার পাঠাতে পারেননি।
পরে বাধ্য হয়ে সে টাকা তুলে সৌদি আরব যাবার জন্য জমা দেন। সেখানেও এক বছর টাকা পড়ে থাকে। বাধ্য হয়ে তার কাছ থেকেও টাকা তুলে ফেলেন। বেকার ছিলেন, তাই বসে বসে সেই টাকা প্রায় খেয়ে বসেছিলেন। অবশেষে উপায়হীন হয়ে একজনের পরামর্শে দুই লক্ষ আশি হাজার টাকা দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ঢুকে পড়েন।
উনি বললেন, “জানেন ভাই, এখানে আসার পর প্রথম এক মাস বন-জঙ্গলে পালিয়ে ছিলাম। আপনাকে কি করে বুঝাব, কতো ভয়াবহ আমার দিনগুলো ছিল। পরে একজন বাংলাদেশির সহায়তায় এই ওয়ার্কশপে কাজ নেই। তবুও মনে শান্তি নেই। গত এক বছর যাবত পলাতক জীবনযাপন করছি। মনে হচ্ছে এই যে বনবাসে আছি।”
সে আর কিছু বলতে পারল না। তার দুই চোখে অশ্রুধারা দেখে বললাম, “থাক ভাই, মন খারাপ করবেন না। সবই নসিবের লিখন।”
আমার কথা শুনে ভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ওমর ভাই, পরিবার-পরিজন ছাড়া তো আমি একদিনও দূরে থাকার কথা চিন্তা করতে পারতাম না। আর এখন তাদের ছাড়াই ঈদ করতে যাচ্ছি একা নির্জনে। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন না জানি পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করে। যে আমি সিনেমার নায়ক-নায়িকাকে বনবাসে পাঠালে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তাম, সেই আমি আজ এক বছর যাবত পরিবার ছেড়ে প্রবাসে আছি। এ তো এক প্রকার বনবাসই?”
আমি আর কথা বাড়াইনি। শুধু সে না, তার মতো হাজার হাজার প্রবাসী বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জলে ঈদ উদযাপন করছে। আর কথা না বাড়িয়ে আমরা ঈদের নামাজ পড়তে বের হলাম। কিছু বন্ধুবান্ধব আর অপরিচিত হাজারখানেক বাংলাদেশিদের সাথে ঈদের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, অধিকাংশ মুসল্লিই বাংলাদেশি। এ যেন মালয়েশিয়া নয়, একটি বাংলাদেশের অংশ!
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |