অদ্ভুত এক শব্দ ‘প্রবাস’। স্বদেশ থেকে যোজন যোজন দূর। ভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি আর সভ্যতা।
Published : 09 Feb 2017, 11:12 AM
আর এর ভেতরেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে মানিয়ে চলার নামই বোধহয় প্রবাস জীবনের প্রধান শর্ত। তবে আরেকটি কঠিন বাস্তবতার মাঝে প্রবাসী শিক্ষার্থীদের নিজের জীবন টেনে নিতে হয়। আর তা শুধু দেশ থেকে যোজন যোজন দূরত্বই নয়, বরঞ্চ স্বজন-পরিজনকে পেছনে রেখে আসার অভিজ্ঞতা।
চাইলেই শিক্ষার্থীদের যে কেউ পারে না মায়ের হাতের এক বেলা রান্না খেতে কিংবা বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। এ কষ্ট শুধু তারাই বুঝবে, যারা বছরের পর বছর পড়ালেখা, কাজ কিংবা ভিসাগত জটিলতার কারণে তাদের প্রিয় মুখগুলোকে দেখতে পায় না, আদর-ভালোবাসা নিয়ে আলিঙ্গন করতে পারেন না।
অনেকেই ভাবে, বিদেশ মানেই হৈ-হুল্লোড় আর উদ্দীপনায় ভরা এক জীবন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ঠিক নয়। বিলেতে পড়তে আসা বাঙালি শিক্ষার্থীদের ক্লাস, কাজ ছাড়াও ঘাড়ের ওপর ভিসা নামের একটি তলোয়ার ঠিকই ঝুলতে থাকে ঘড়ির কাঁটার মতো।
‘ইউকেভিআই’ (ইউকে ভিসা অ্যান্ড ইমিগ্রেশন) তথা হোম অফিসে যখন এ ভিসাগত সরল অংকে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র খালাস পায় না, তখনই হিসাবটা আরও জটিল হয়ে ওঠে। আর ঠিক সেই মুহুর্তে দেশ থেকে পাওয়া স্বজনদের দুঃসংবাদে শিক্ষার্থীরা হার মানে পরিস্থিতির কাছে। না পারে চটজলদি দেশে ছুটে যেতে, আবার অনেক সময় ছুটে গেলেও দেখা হয় না প্রিয়জনের মুখটি শেষবারের মতো। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস মেনে নেওয়ার মতো শক্তি, সামর্থ কিংবা সাহসটুকুও অবশিষ্ট থাকে না অনেক শিক্ষার্থীদের।
১.
২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ছুটির দিনে ঘুম ভাঙলো কিছুটা বেলা করে। এক ছোট ভাই ফাতিনের মিসড কল আর সেই সাথে একটি ক্ষুদে বার্তা- “আপু, শশী ভাইয়ের বাবা আমাদের মাঝে আর নেই।”
ভোরের ফ্লাইটে তাড়াহুড়ো করে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন ছেড়েছে শশী। বার্তাটা পেয়ে আচমকা মাথার ওপর যেন বাজ পড়লো। ২২ তারিখ শশীর সাথে দেখা হয়েছিলো পূর্ব লন্ডনে। একসাথে বেশ কিছুক্ষণ আমরা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়েছিলাম। তখন শশী জানিয়েছিল তার ভবিষ্যৎ কিছু পরিকল্পনা। এপ্রিলে দেশে গিয়ে মা-বাবার সাথে লম্বা একটা সময় কাটাবে আর সেই সাথে গুছিয়ে আনবে তার পরবর্তী কাজগুলো।
বাবা-মার একমাত্র সন্তান হওয়ায় দায়িত্ব আর অভিভাবকদের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়ই একটু চিন্তায় থাকতো শশী। কয়েকমাস আগে নিজের ফুফা মারা যাওয়ায় শশীর বাবা মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলেন অনেকটাই। আর সে কারণেই শশীর চেষ্টা ছিলো, ভার্চুয়ালি তার বাবা-মাকে সাহস যোগানোর। ছেলেকে উল্টো মনোবল জুগিয়ে তার বাবা হঠাৎ করেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে!
এপ্রিলের পরিবর্তে ডিসেম্বরে, চার মাস আগে শশী ঠিকই গেলো বাংলাদেশে তার বাবাকে শেষবারের মত দেখতে। ইস! আঙ্কেল যদি একটিবারের মতো জানতে পারতেন, তার ছেলে ফিরে এসেছে সকল বাধা-বিপত্তি আর দূরত্বকে জয় করে। যদি দেখতে পারতেন একটিবার, শুধু একটিবার!
তবে শশীকে ভাগ্যবান বলতে হবে এক দিক থেকে। সে শেষ পর্যন্ত তার বাবার লাশ দেখতে পেয়েছিলো। আর সেই সাথে উপস্থিত হতে পেরেছিলো প্রিয় মানুষকে বিদায় দেওয়ার সব আনুষ্ঠানিকতায়।
এটি সম্ভব হয়েছিল শুধু তার ভিসাগত জটিলতা না থাকায়। একটিবার ভাবুন তো, যাদের কাগজপত্র এখনও হোম অফিসে আটকা পড়ে আছে, তারা যদি কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়ে, কী করবে তারা?
২.
ফারলিনা ভাবি বছর দুয়েক আগে বিলেতে এসেছেন পড়ালেখার তাগিদে। সাথে এসেছেন আমাদের ভাইও। একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করেই বিলেতে ঠিক-ঠাক এগিয়ে চলছে টোনাটুনির সংসার। এরই মাঝে ঘর আলো করে এসেছে তাদের আদুরে সন্তান।
শত প্রতিকূলতার মাঝেও ভাবি এগিয়ে চলছেন, চালিয়ে যাচ্ছেন তার লেখাপড়া আর সংসার। এমনকি ২০১৫ সালের অক্টোবরে কোর্স ব্রেকে সপরিবারে ঘুরে এসেছেন দেশ থেকেও। বাবা-মার সাথে দু’সপ্তাহের ছোট্ট সময় কাটিয়ে এসে বেশ ভালোই কাটছিলো তাদের দিনকাল। বছর না ঘুরতেই সামনে এসে হাজির ভিসার জটিলতা। আর তারপর হঠাৎ ছন্দপতন।
২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশ থেকে হঠাৎ ভাবির বাবার অসুস্থতার খবর আসলো। হাসপাতালে আইসিইউ’তে ভর্তি হবার একদিন পর সবকিছুর মায়া ছেড়ে তিনি চলে গেলেন ওপারে। অসুস্থতার খবর শুনেই এক দৌঁড়ে ছুটে যেতে পারলেন না দেশে। কারণ পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হোম অফিসে রয়েছে ভিসা এক্সটেনশনের জন্য।
আর তাই হাজার চাইলেও যেকোন প্লেনে চেপে ফারলিনা ভাবি যেতে পারছেন না তার বাবার মুখটি শেষবারের মতো দেখতো। কোন ভাষাতেই বোধ করি স্বান্তনা দেওয়া যায় না এমন অবস্থায়।
বহু দূর দেশে বসে স্বজন হারানোর বেদনা কতটা নিষ্ঠুর হয়, সেটা শুধু তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন যারা এ ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছেন। ইংল্যান্ডের কড়া নিয়ম-কানুনে শিক্ষার্থীদের হাত-পা কতটা বাঁধা- তা হয়তো কিছুটা হলেও আজ অনুভব করা যাচ্ছে।
দীর্ঘ সময় প্রবাসে শিক্ষাজীবন পার করার পর যখন অনেক শিক্ষার্থী বিলেতে স্থায়ী হবেন, ঠিক তখন দেশ থেকে আসা যে কোন ধরনের দুঃসংবাদ গুড়িয়ে দিতে পারে সকল আশা। ঠেলে দিতে পারে চরম হতাশায়!
৩.
আমাদের বন্ধুমহলে সবার প্রিয় আর হাসি-ঠাট্টার খোরাক যোগানো একমাত্র বন্ধুটি হচ্ছে জাহিদ। আড্ডায় কেউ মুখ গোমরা করে জাহিদের সামনে বসে থাকবে- তা একেবারেই অসম্ভব।
কোন বন্ধুকে কীভাবে হাসাতে হয়, সব ট্রিক্সই জানা জাহিদের। আর তাই তো আমরা সবাই দেখা করার আগে জেনে নেই জাহিদ থাকবে কিনা সেই আড্ডায়। কারণ দিনশেষে আমরা সবাই হাসিমুখে আর ভাল স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই। ও হ্যাঁ, স্মৃতি রোমন্থন করার জন্য অবশ্য মাঝে-মধ্যে ভাল ছবিরও দরকার হয়। আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের সুন্দর সুন্দর ছবি তোলার দায়িত্ব অলিখিতভাবে জাহিদের কাঁধেই থাকে সবসময়। কারণ কথা দিয়ে আর ছবি তুলেই জাহিদ আমাদের মুখে হাসি এঁকে দেয়।
এ বন্ধুটিই হঠাৎ করে তার হাসি হারিয়ে ফেললো ২০১৫ সালে অক্টোবরের ৩০ তারিখ। জাহিদ জানালো, হঠাৎ করে তার মায়ের বুকে ব্যথা শুরু হলো মধ্যরাতে।
সিএনজি করে হাসপাতালে নিতে নিতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার মায়ের দেহটি। অসাড় হয়ে হেলে পড়ে তার বাবার কোলে। কাউকে কিছু না বলে চুপিসারে চলে গেলেন পৃথিবীর সব বন্ধন ছিন্ন করে। আর এ খবরটি লন্ডনে এসে যখন পৌঁছালো, তখন এখানকার সময় রাত ১১টা, আর বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা।
খালাকে শেষবারের মতো জাহিদ যে দেখতে যাবে তাও সম্ভব হয়নি। পরের দিন যে ফ্লাইটের টিকেট পেয়েছে জাহিদ, তাতে দুবাইয়ে দীর্ঘক্ষণ ট্রানজিট রয়েছে। আর সব সময় হিসেব করে দেখা গেলো, জাহিদ পৌঁছাবে পাক্কা একদিন পর।
পরিবার থেকে জাহিদকে বোঝানো হলো, এতটা সময় দাফন কাজ অসম্পন্ন রাখাটা অসম্ভব। তাই দূরদেশে বসেই মায়ের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে জাহিদ।
বাস্তব ও নির্মমতার কাছে হার মানতে হয় জাহিদের। যে মা তার সন্তানদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করেন বলে জাহিদ কখনোই তার বিলেত জীবনের কোন কষ্টের কথা তার মাকে জানায়নি, অথচ সেই মাকে হারানোর বেদনা আর কষ্ট নিয়ে প্রতিটি ক্ষণ পার করতে হচ্ছে জাহিদের। বাবা বলে, বুকে টেনে নেওয়া মাকে জাহিদ শেষবার দেখেছিলো বছর চারেক আগে।
বাবা-মায়ের হাজারও স্মৃতি এভাবেই বুকে আকঁড়ে ধরে, কান্না চেপে রেখে, কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে স্বপ্ন পূরণে এক পা, দুই পা করে এগোচ্ছে প্রবাসী বাঙালি শিক্ষার্থীরা। প্রবাস হয়তো দিতে পারে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা, তবে মুহুর্তের মধ্যে এটি ছিনিয়েও নিতে পারে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্ক আর বন্ধনকে। বাস্তবতা বুঝলেও প্রিয়জন হারানোর খবর শুনে দেশে আসতে না পারলে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। মনে হয়, এতো এতো গতি কিসের ও কার জন্য?
যারা একই শহরে থেকেও বাবা-মাকে দেখতে যাওয়ার ফুরসত পান না, তাদের থেকে অভাগা বোধহয় পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না। কর্মদোষেই বোধ হয় কপালও হাসে, তবে সে হাসি হয় অট্টহাসি।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার
ই-মেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |