জার্মানির ওবারকাসেলের একদিকে রাইন নদী, অন্যদিকে পাহাড় এবং গহীন জঙ্গল। এক শনিবার সকালে নাশতা করে বেরিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলের উদ্দেশে।
Published : 16 Dec 2016, 05:50 PM
ওবারকাসেলে আমার বাসার পেছনেই ট্রাম লাইন। সেটা পার হয়ে কিছুটা হেঁটে উপরের দিকে উঠতে হয়। অনেকটা পথ হাঁটার পর কিছু দূর উঠে গিয়ে দেখলাম ঘোর জঙ্গল।
কিন্তু গাছে গাছে তীর চিহ্ন দেয়া আছে। অর্থাৎ হারানোর ভয় নেই। তাই চলতে লাগলাম। অপূর্ব বিশাল বিশাল গাছ চারপাশে। যার কারণে আলো প্রবেশ করে না। তবে কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ খুব ভয় লাগলো। অজানা এক ভয় আমাকে যেন গ্রাস করতে এলো। কোন মানুষজনের শব্দ নেই। মনে হলো যদি আর ফিরতে না পারি!
হঠাৎ ঘোড়ার খুড়ের শব্দ পেলাম। একাধিক। মুখ ফিরিয়ে দেখি দু’টো মেয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসছে। আমি কী স্বপ্ন দেখছি?
তারা আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ঘোড়ার ডাকে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। তাদের পথ ধরে আমিও হাঁটতে লাগলাম। গাছগুলোর ঘনত্ব একটু কমে গিয়ে একটু একটু করে আলো বেরিয়ে আসতে লাগলো।
হঠাৎ করে সামনে বেরিয়ে এলো সমতল ভূমি। আমি বিস্ময়ে হতবাক। একেবারে দিগন্তজোড়া সবুজ আর সবুজ জমি। অনেক ঘোড়া সেখানে। বেঞ্চে ঘোড়ার মালিকরা বসে জিরোচ্ছেন। আমিও একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম।
কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে এবার একটা সোজা পথ পেয়ে গেলাম। সেটা ধরে নেমে এলাম ওবারকাসেলে। কিন্তু সেই দিনটা আমার জন্য অনন্য হয়ে রইল। এরপরও বহুবার নানা পথ দিয়ে ওই জঙ্গলে গেছি। কিন্তু আর পথ হারাইনি। ভয়ও পাইনি।
কোনটা ষোড়শ, কোনটা সতের বা আঠারো শতকের। আমি সম্প্রতি নারায়ণ সান্যালের 'রূপমঞ্জরী' পড়ছিলাম। সেই ১৬৬৭ সালের ঘটনা পড়ছিলাম তখন, যেখানে নারীদের পড়ালেখা ছিল নিষিদ্ধ।
বলা হত নারীরা পড়ালেখা জানলে স্বামীর অকালমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সেই উপন্যাস যখন পড়ছি, তখন একদিন বিকালে ওবারকাসেলে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়িতে দেখলাম, নির্মাণকাল লেখা ১৬৬৭। দেখে থমকে গেলাম।
মনে হলো ভারতীয় উপমহাদেশে যখন এই অবস্থা তখন এখানে এই বাড়িটি এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। কোন বড় বিল্ডিং সেখানে তৈরি হয়নি, ছোটখাটো ইমারত দাঁড়িয়ে। অবাক না হয়ে পারা যায় না।
কারণ দিনাজপুরে আমাদের বাড়িটি যখন তৈরি হয় তখন ওই শহরে আর কোন আধুনিক দোতলা বাড়ি ছিলো না বলে জানা যায়। রাস্তা থেকে তাকালে কেবল আনন্দ নিকেতনই চোখে পড়ত। অথচ ২০ বছরের মধ্যে আশপাশে এমন জঙ্গলের মতো ভবন নির্মাণ শুরু হলো যে বাড়িটাতে আলোই প্রবেশ করে না।
তাই এই বাড়িগুলো দেখে অবাক না হয়ে উপায় কী? বন এর বাড়িগুলোর ক্ষেত্রে আর একটা ব্যাপার চোখে পড়ার মতো। জার্মানির অন্যান্য শহরে এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করিনি। তবে বন শহরে লক্ষ্য করেছি। এখানকার বাড়ির দরজাগুলোর ভিন্নতা।
কোন একটা বাড়ির সঙ্গে অন্য বাড়ির দরজার মিল খুঁজে পাবেন না। কিছুটা হলেও ভিন্নতা রয়েছে। জার্মানরা প্রাইভেসি পছন্দ করে, তাই তাদের বাড়িঘর বা শিশুদের ছবি তোলাটা অত সহজ নয়। এ কারণে ভিন্ন ভিন্ন দরজার ছবি দেয়া সম্ভব হলো না। তবে যখন বন এ আসবেন তখন অবশ্যই লক্ষ্য করে দেখবেন আমার কথা ঠিক কিনা!
এসব পথে একা একা হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ প্রিয় মানুষটির হাত ধরতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে তাকে নিয়ে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য উপভোগ করতে! এসময় মনের মধ্যে একটা হাহাকার তৈরি হয়। সেটা বুকের মধ্যে নিয়েই আমি নিরবে হেঁটে চলি আর গুনগুনিয়ে গান গাই- ‘টেক মি হোম...’
(চলবে)
লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়েচে ভেলে, বাংলা বিভাগ
ইমেইল: [email protected]
ছবি কৃতজ্ঞতা: অমৃতা পারভেজ
এই লেখকের আরও পড়ুন:
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |