“আমরা নতুন করে আহ্বান জানাব, এদেশের মানুষ তাদের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই বর্তমান বাংলাদেশে স্বৈরাচারী যে অবস্থা, সেই অবস্থার তারা পরিবর্তন ঘটাবে।”
Published : 08 Jan 2024, 04:46 PM
‘একতরফা’ নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে তাকে, ‘অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান।
তিনি বলেন, “বিএনপি এবং গণতন্ত্রের পক্ষে ৬৩টি রাজনৈতিক দলের বক্তব্য আজকে অত্যন্ত স্পষ্ট। এই সরকারের অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক যে ব্যবস্থাপনা, সেটাকে জনগণ সরাসরি গতকাল প্রত্যাখান করেছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যে পর্যায়ে বৈধতা পাবার যে চেষ্টা করেছিল, সেটা কিন্তু আজকে দেশে-বিদেশে সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
“আগামীতে তারা (ক্ষমতাসীনরা) যা কিছু চিন্তা করছেন, যদি তারা ক্ষমতার বলে বন্দুকের নলে নির্ভর করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার প্রচেষ্টা বা দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টা করেন, তাহলে কিন্তু তারা বাংলাদেশের মানুষ শুধু নয়, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে তারা অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক হিসেবেই বিবেচিত হবেন। সুতরাং জনগণের ইচ্ছায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহি সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম রাজপথে অব্যাহত রাখব এবং সেই আন্দোলন-সংগ্রাম হবে শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক।”
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্যে রোববার যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মত সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ২০০৭ সালের পর আর সরকারে যেতে না পারা বিএনপি ২০০৯ সাল থেকেই সরকারপতনের আন্দোলন করে আসছে, তবে সফল হতে পারেনি।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে ধাপে ধাপে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে গতবছর আন্দোলন কিছুটা জমিয়ে এনেছিল বিএনপি। কিন্তু ২৮ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর তারা ফের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে ফিরে যায়, দেশে নতুন করে ফিরে আসে নাশকতা।
মঈন খান বলেন, “আমরা দেশবাসীর উদ্দেশে আবার নতুন করে বলতে চাই, বিএনপির একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল…আমরা লগি-বৈঠার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা অন্যায়ভাবে কারো গায়ে হাত দিই না। আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী।
“আপনারা দেখেছেন আমাদের যে পর্যায়টি শেষ হয়েছে, আমরা প্রতিটি বিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি জেলা-উপজেলা এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার ইউনিয়ন পরিষদের আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সভা, মিছিল, প্রতিবাদ সভা এবং পদযাত্রা দিয়েছিল। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, বিএনপি জনগণের সঙ্গে থেকে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এই সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে চায় এবং একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে… সেই ভোটের মাধ্যমে পরবর্তীতে এদেশের জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের একটি সরকার গঠিত হবে, কোনো ডামি প্রতিনিধি দিয়ে নয়।”
এই বিএনপি নেতা বলেন, “আমরা নতুন করে আহ্বান জানাব, এদেশের মানুষ তাদের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই বর্তমান বাংলাদেশে স্বৈরাচারী যে অবস্থা, সেই অবস্থার তারা পরিবর্তন ঘটাবে। বিএনপি জনগণের দল, বিএনপি জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে এবং এই জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা রাজপথে নেমেছি জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে।
“সেই আন্দোলনে আমরা রাজপথে ছিলাম, আমরা রাজপথে আছি এবং আগামীতে আমরা রাজপথে থাকব, যতদিন না সত্যিকার অর্থে জনগণের অধিকার আমরা জনগণের হাতে তুলে দিতে পারব, এটাই এই বিএনপির প্রতিজ্ঞা।”
দেশবাসী ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করেছে দাবি করে সেজন্য অভিনন্দন জানিয়ে মঈন খান বলেন, “গতকাল ভোটাররা যে কাজটি করেছেন, তারা বিদ্যমান আওয়ামী লীগের এই একদলীয় বাকশাল সরকারকে বয়কট করেছে। দেশের মানুষ ভোট দিতে যায়নি। ভোট বর্জন করে জনগণ গণতন্ত্রকামী বিরোধী দলগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই।”
দেশের জনগণ এখন এ সরকারকে নিয়ে ‘অনেক হিউমার করে’ মন্তব্য করে মঈন খান বলেন, “আগামীতে সরকার যে চিন্তাভাবনা করছে নতুনভাবে, যে সরকার গঠন করবে এই ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে, সেটা আমরা এভাবে বলতে পারি, এই ধরনের ‘অব দ্যা ডমি, বাই দ্যা ডামি, ফ্রম দ্যা ডামি’… পরনির্ভরশীল ডামি সরকার নয়, জনগণ প্রত্যাশা করে জনগণের সুষ্ঠু নির্বাচনে একটি জনপ্রতিনিধিত্ব সরকার, যেজন্য ৫২ বছর আগে গণতন্ত্রকামী মানুষ এই দেশ সৃষ্টি করেছিল।”
নতুন কর্মসূচি ‘গণসংযোগ’
মঈন খান বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল থেকে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি না দেওয়া পর্যন্ত গণসংযোগ অব্যাহত রাখব।রাজপথে হাটে-ঘাটে আমরা মানুষের কাছে যাব, তাদের সাথে কথা বলব এবং তাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করব।
“গণসংযোগের মাধ্যমে আমরা গণসচেতনতা সৃষ্টি করব, সেই সচেতনতা হচ্ছে গণতন্ত্রের সচেতনতা, মানুষের যে অধিকার প্রশ্নের মানুষের অধিকার পুণঃপ্রতিষ্ঠার সচেতনতা। আমরা আগামীকাল ও পরশু এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখব। তার পরে আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব।”
নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কয়েকটি দেশের অভিনন্দন বার্তার বিষয়ে প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান বলেন, “আমরা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে কথা বলি, আওয়ামী লীগের মত নয়। তিনটি দেশ সরকারের সঙ্গে দেখা করেছে অথবা সরকার একটি দেশকে নির্বাচনে জয়ের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকেও তারা ধন্যবাদ জানায়নি।
“তারা তাদের আচরণ এবং কথা-বার্তার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্ভর করে না, তারা যার ওপর নির্ভর করে এই নির্বাচনে অন্যায় ফলাফল ছিনিয়ে নিয়েছে, তাতে কি দাঁড়াল?”
‘ডামি নির্বাচন, ডামি অবজারভার’
মঈন খান বলেন, “৭ তারিখ কোনো নির্বাচন হয়নি, ডামি নির্বাচন কমিশন, ডামি প্রার্থী, ডামি ভোটার এবং সর্বশেষ ডামি অবজারভার নিয়ে একটা নাটক হয়েছে। ৭ তারিখ যে নাটকটা সাজিয়েছে, সেই নাটকের ফলাফল তারা গতকাল রাত থেকে আজকেও ঘোষণা করছে। এটা কোনো নির্বাচন না। দেখুন তাদের যে নির্বাচনী অবজারভার, যাদেরকে ভাড়া করে এনেছিল, তাদের মধ্যে একজন বিদেশি অবজারভার নিজেই বলেছেন, এটা কোনো নির্বাচন নয়। গণমাধ্যমেও তার বক্তব্যে এসেছে।
“৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের ডামি নির্বাচন বর্জন সুস্পষ্টভাবে বিরোধী দলের দাবির প্রতি এদেশের গণমানুষের গণরায়। বাস্তবতা হচ্ছে, গতকাল এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শোচনীয় ও নৈতিক পরাজয় হয়েছে, এটাই হচ্ছে সত্য।”
তিনি বলেন, “সরকারের এই নাটকের প্রতি জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনের নামে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ মারামারি করেছে, খুনোখুনিও হয়েছে। জোর করে ব্যালেটে সিল মারা আবার ভোট কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। সারা দেশে ৪০ হাজারের ওপর ভোটকেন্দ্র ছিল। একটা বা চারটা ভোট কেন্দ্র বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে এটা হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই না।”
‘অবৈধ সরকার, গণপ্রতিনিধিত্ববিহীন সংসদ এবং বর্তমান মেরুদণ্ডবিহীন নির্বাচন কমিশন’ দিয়ে বাংলাদেশে কোনোদিন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেও মনে করেন মঈন খান।
তিনি বলেন, “আমরা যেটা চাই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সেটার জন্য দরকার একটা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা হয় নাই। ফলে এই নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখান করেছে এবং যে পরিমাণ ভোটের উপস্থিতি দেখানো হচ্ছে ,এটা যে ভুয়া… এটা আপনারাও, সকল মিডিয়া বলেছে, সোশাল মিডিয়া বলেছে, দেশ-বিদেশের ব্যক্তিরা সবাই বলেছেন। আর ভাড়াটিয়া অবজারভার পর্যবেক্ষকও বলেছেন।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “মূলত আমরা অসহযোগ, শব্দগুলো খেয়াল করবেন, আমরা বলেছিলাম যে, নির্বাচনে ভোট না দেয়া, নির্বাচন বর্জন করা। এই অসহযোগ আন্দোলনটা নির্বাচনের উদ্দেশে আমরা ঘোষণা করেছিলাম। তার জন্য আরও কিছু কাজ করতে বলেছি। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলব।
“মূলত আমরা নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে অসহযোগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। এই ভোট বর্জন হয়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক দল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাস করি। আমরা এটাতে (নির্বাচন) বাধা দিতে যাইনি। তারা নিজেরা বাধা দিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলি করেছে, মানুষের প্রাণ ক্ষয় হয়েছে, আহত হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে… সবই হয়েছে তারা তারা।”
“আজকে নিজেরা নিজেরা ডামি প্রার্থী বানিয়ে ৬৩ জন ডামি স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে। দেখেন, জাতীয় পার্টিকে ২৬টা আসন বণ্টন করেছিল, তার মধ্যে ১১টায় জিতছে, বাকিগুলো জিতে নাই। ১৪ দলীয় জোটে যে কয়টি দিয়েছিল তার মধ্যে কিছু হেরে গেছে।
“এখন দেখা যাচ্ছে, ক্রেইন দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে কিছু লোককে তোলার, তারা জয় পেয়েছে। আবার কাউকে কাউকে ক্রেইন দিয়ে টেনে তোলা হয়নি, তারা পরাজিত হয়েছে। এটা কোনো নির্বাচন হল? গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংবিধান এগুলো নিয়ে রসিকতা করার কোনো অধিকার কারো নাই।”
কত লোক ভোট দিয়েছে- এ বিষয়ে বিএনপির ধারণা জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আমার মনে হয় এটি আপনারা যে কোনো একজন রিকশাওয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, যে কোনো একজন দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা যে কোনো একজন সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা আমার মনে হয় ভালো জবাব দেবে।”
আর মঈন খান বলেন, “সরকার ঠিক যত পারসেন্ট বলে দেবে, নির্বাচন কমিশন ঠিক তত পারসেন্ট ঘোষণা করবে। এটা অর্থহীন একটা ফিগার হবে।”
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার সোমবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আসেন দলের নেতারা। জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানও ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।