“নদীকে সঠিকভাবে পরিশুদ্ধ রাখাতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত চোখে পড়ে না,” বলেন বিএনপি মহাসচিব।
Published : 05 May 2023, 05:48 PM
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় সরকারের ‘কোনো পরিকল্পনা নেই’ বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেছেন, “এখন এগুলোর (পরিবেশ দুষণ রোধ) উপরে কোনো গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে ঢাকা দেশের অন্যতম না, বোধহয় সবচেয়ে দূষিত নগরীতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া সরকারের কোনো লক্ষ্য নেই। এই বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করার জন্য, জনগণের ভবিষ্যতকে সুন্দর করার জন্য, জনগণের অন্তত বেঁচে থাকার জীবন-জীবিকার পথগুলোকে সুগম করার জন্য সেখানে তাদের খুব বেশি একটা তাদের আগ্রহ নেই।
“কারণ তাদেরকে তো জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না, তারা নির্বাচিত নয়, জোর করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। লক্ষ্য একটাই যে, আমাকে যে করেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। এই কারণে পরিবেশ রক্ষায় তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।”
শুক্রবার ঢাকার রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে বিএনপি আয়োজিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন: বাংলাদেশ ও নদী’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, “এখন যখন আমি বাংলাদেশের যেসব জায়গায় যাই, নদী আর বেশি দেখতে পাই না। দূরে যাওয়ার দরকার নেই… ঢাকার পাশেই বুড়িগঙ্গা… আগে কেমন ছিল, আর আজকে সেই বুড়িগঙ্গায় কী দেখছি, শীতালক্ষ্যায় কী দেখছি। আজকে আমাদের মানুষের অবহেলায়, সরকারের অব্যবস্থাপনায়, তাদের পরিকল্পনার অভাবে সেগুলোকে নিয়ে আমরা বেঁচে আছি, আমাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অবিবেচ্ছদ্য-সেগুলোকে আমরা নিজেরাই হত্যা করছি, ধ্বংস করে দিচ্ছি।
“সরকার উন্নয়নের ঢাকঢোল বাজায় সর্বক্ষণ। কিন্তু নদীকে রক্ষায় নদীকে সঠিকভাবে পরিশুদ্ধ রাখার তাদের কোনো পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত চোখে পড়ে না। বুড়িগঙ্গা নদীর পাশ দিয়ে যান, দেখবেন- এতো দুর্গন্ধ।”
নদী দখলের বর্ণনা করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সাভার-ধামরাইতে ছোট ছোট যে নদীগুলো ছিল, সেগুলো প্রায় মরে গেছে। আপনারা দেখেছেন যে, তুরাগ নদীর পাশে সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ও তাদের সমর্থনের ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ক্লাব গড়ে উঠেছে। সেই ক্লাবগুলো একেবারেই নদীর উপরে নদী ভরাট করে গড়ে উঠেছে।
“পানি কমে যাচ্ছে, নদী দখল করা হচ্ছে- এটার বিষয়ে যা কিছু খবর নেবেন- এই সরকারের সঙ্গে যারা জড়িত, তারাই এই কাজগুলো করছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থায় নেওয়া হচ্ছে না।”
বিএনপির শাসনামলে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা, খাল খনন কর্মসূচি চালু করা, থ্রি স্ট্রোক বেবি ট্যাক্সি চলাচল নিষিদ্ধ করাসহ পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া বলে অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন দলটির মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, এই প্ল্যানেট বড় রকমের হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা তো আদার-ব্যাপারী, জাহাজের খবর দরকার নাই। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমরা বেঁচে থাকব কি থাকব না, সুস্থ-সুন্দরভাবে আমরা এখানে বাঁচতে পারব কি না- সেটা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
“আজকে বাংলাদেশের মানুষকে যদি টিকে থাকতে হয়, ভবিষ্যতকে যদি সুন্দর করতে হয়, ভবিষ্যতকে যদি সত্যিকার অর্থেই জনগণমুখি করতে হয়, তাহলে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আজকে গণতন্ত্র নেই বলেই কোনো জবাবদিহিতা নেই।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “মেজর হাফিজ সাহেব (সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ) যেটা বলেছেন যে, তিনি দিল্লিতে গিয়ে- যখন উনি সেই নদী কমিশনে নেগোসিয়েশন করছিলেন- এই শক্তি তার ছিল। হি প্রেজেন্টেড এ ইলেক্টেড গভর্মেন্ট… একটা নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন বলে, জাতীয়তাবাদ বিশ্বাস করেন বলেই বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র…. ওই সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
“আমাদের ফারাক্কা বাঁধে কত বড় ক্ষতি হয়েছে- সেটা আমরা জানি, তিস্তার পানি নিচ্ছে যার ফলে ওই অঞ্চল (উত্তরাঞ্চল) পুরোপুরি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। অথচ এখনও এই সরকার সেইভাবে কথা বলে নাই, সেভাবে কথা বলেই না।”
টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিএনপির ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গিয়ে ফখরুল বলেন, “টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যখন নির্মাণ করতে যায়- তখনই আপত্তি করেছিল বিএনপি সরকার; একই সঙ্গে বিএনপি আপত্তি করেছে, বিএনপি আন্দোলন গড়ে তু্লেছিল। যার জন্য আমাদের ইলিয়াস আলীকে সম্ভবত অনেক মনে করেন, সেই কারণে তাকে গুম হতে হয়েছে।
“এটা বড় লড়াই, বড় সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদেরকে জিততে হবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতেই হবে। সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে পারলেই আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারব, উদ্যোগ নিতে পারব।”
‘পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি’
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন হাসনা জসীমউদদীন মওদুদ। চার পৃষ্ঠার প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি প্রবাহ, ভারতের উজানে বাঁধ নির্মাণে ক্ষতিকারক দিক এবং প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের হুমকির মুখে পড়ার কথা তুলে ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আপনারা দেখেছেন যে, মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে আমাদের বাংলাদেশের নদীগুলো কী পরিমাণ গতি হারিয়েছে এবং কী পরিমাণ চরিত্রগতভাবে পরিবর্তন হয়েছে। একটা উদাহরণ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা ফারাক্কা চুক্তি।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, “আওয়ামী লীগ আমলের চুক্তিতে আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে গ্যারান্টি ক্লজ রাখেনি। এখানে যা পানি ভাগাভাগি হবে, সেটার একটা সমঝোতা এবং সেখানে আমাদেরকে ফাঁকি দেয়া হলো… বলা হলো যে, ৩৩ হাজার কিউসেক পানি থাকবে।
“এখন কিন্তু অনেক সময়ে সেখানে ১২ হাজার কিউসেক পানিও থাকে না। কেননা ফারাক্কা পয়েন্টে গ্যারেন্টি নাই। তারা (ভারত) উপরিঅঞ্চলে বেশির ভাগ পানি ব্যবহার করে ফেলছে, ফারাক্কার সেই পয়েন্টে পানি আর আসছে না। অতএব বাংলাদেশ পানির ন্যায্য ভাগ পাচ্ছে না। তার প্রতিক্রিয়া কী, আপনারা বাংলাদেশের পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তনে তা দেখছেন।”
খন্দকার মোশাররফ বলেন, “তিস্তাসহ ৫৪ নদীর উপরিভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে তারা (ভারত)। ফলে আমাদের নদীতে পানি কম আসছে, আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীর পানির মাধ্যমে যে পলি আমাদের দেশে আসতো, সেই পলি কমে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে কৃষি ও কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে।
“বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, কৃষিনির্ভর দেশ। এখানে আমরা অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা, আমাদের পরিবহন, ব্রিজ ইত্যাদি নির্মাণ করছি শুধু লোক দেখানোর জন্য; অথবা কোনো দেশের ইঙ্গিতে ভয়ে তাদেরকে খুশি করার জন্য করছি। এতে আমরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে এটা, কিন্তু আমাদের সকলকে আরও বেশি গভীর অনুভব করতে হবে। আমরা যদি জাতীয়তাবাদী চেতনার স্বার্থে কথা বলি তাহলে আমরা যে পার্শ্ববর্তী দেশ দ্বারা ডিপ্রাইভ হচ্ছি, এটা জনগণকে অনুধাবন করতে হবে।”
সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এই থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। সরকারকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে, সরকারের মেরুদণ্ড সোজা থাকতে হবে। বলতে হবে আমার দেশের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা চাই।
“যৌথ নদী কমিশনের মিটিং বছরে চারবার হতে হবে, সেখানে আমাদের ন্যায্য হিস্যা গ্যারেন্টি করে দিতে হবে… প্রত্যেকটা চুক্তির গ্যারেন্টি ক্লজ থাকতে হবে, আরবিটেশন ক্লজ থাকতে হবে। ইউএন কনভেনশন অব ১৯৯৭ ক্লজ আমাদেরকে রেটিফাইড করতে হবে।”
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের প্রধানি নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, “একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির নদী বিষয়ে শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া উচিত… সে যত বড় শক্তিশালী হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক আপনারা নদী দখলের ব্যাপারে নদী দূষণের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত।”
এ জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বলেন, “নদী দখলকারী, নদী দূষণকারী মানবতার শত্রু, প্রকৃতির শত্রু। আজকে বাংলাদেশ বাঁচবে- যদি নদী বাঁচে। যারা নদীকে মেরে ফেলছে, তারা বাংলাদেশের মানুষকে মেরে ফেলার অবদান রাখছে।”
বিএনপির মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও দলের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সহ বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল ও কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপুর যৌথ সঞ্চালনায় সেমিনারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন এবং সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন।