ভোট ঘনাচ্ছে, আওয়ামী লীগের এমপিদের সঙ্গে তৃণমূলের দ্বন্দ্বও বাড়ছে

এমন দ্বন্দ্বকে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের কেউ কেউ ‘প্রতিযোগিতা’ বলতে চাইলেও কেউ কেউ উদ্বিগ্ন।

কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2022, 07:08 PM
Updated : 9 August 2022, 07:08 PM

“কিছু কিছু জায়গায় মন্ত্রী-এমপিরা আসলেই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে,” বললেন খোদ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ। অবশ্য নিজের নির্বাচনী আসনে তিনি কোণঠাসা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের কাছে। তবে অনেক এলাকাতেই চলছে এমন দ্বন্দ্ব, যার এদিকে ক্ষমতাসীন দলটির সংসদ সদস্য, অন্যদিকে স্থানীয় নেতারা।

এমন দ্বন্দ্বকে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের কেউ কেউ ‘প্রতিযোগিতা’ বলতে চাইলেও কেউ কেউ উদ্বিগ্ন। দলটির সাধারণ সম্পাদক অবশ্য বলছেন, নির্বাচনের সময় আর এসব দ্বন্দ্ব থাকবে না।

ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য, নিজের অবস্থান শক্ত করতে অন্য দলের লোক ভেড়ানো এবং তাদেরকে দলীয় পদ-পদবি পাইয়ে দেওয়ার মতো ছোটখাটো অনেক ঘটনায় আওয়ামী লীগের বহু সংসদ সদস্য এখন সমালোচিত দলীয় নেতাদের কাছেই। স্থানীয় নেতাদের কথায়, তারা এখন ‘এমপি লীগের হাতে জিম্মি’।

সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, এমন দ্বন্দ্ব ততই প্রকট হচ্ছে। এর সর্বশেষ নজির দেখা গেল গত ১৬ জুলাই জাতীয় সংসদের পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের হাতাহাতিতে।

সংসদ সদস্য রাজী উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আর উপজেলা চেয়ারম্যান সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে রয়েছেন। ঢাকায় হাতাহাতির পর এলাকায় দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে উত্তেজনা ছড়ায়। পরে দুজনের বিরোধ সামলাতে নামতে হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের।

দেবিদ্বারের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী সংসদ নির্বাচনে রাজী ফখরুলের পাশাপাশি আবুল কালামও নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হতে চাইছেন। আর সেই কারণেই তাদের বিরোধ এখন প্রকাশ্যে আসছে।

কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রওশন আলী মাস্টার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় ‘বিরোধ মিটে গেছে’ বললেও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তেমন আভাস মিলল না।

স্থানীয় পর্যায়ে এমন দ্বন্দ্ব চলছে পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা ও গলাচিপা) আসনে, যেখানে সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা, ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া) আসনে, যেখানে সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে, যেখানে সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী।

টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে দলীয় সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছেন গোপালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার।

নাটোর সদর আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের সঙ্গে জেলার আরেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুসের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। নোয়াখালী-৪ আসনের (সদর) সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য।

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগে বিভক্তি প্রকট হচ্ছে। গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে স্থানীয় দুই সংসদ সদস্য শাজাহান খান ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম একে অন্যের উপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন।

টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে রয়েছে উপজেলা ও বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ। চাঁদপুরের আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির দূরত্ব রয়েছে আলোচনায়। তা নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গত ২ ও ৩ মার্চ বৈঠকও ডাকতে হয় কেন্দ্রীয় নেতাদের।

কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের ক্ষোভের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ এনেছেন চৌদ্দগ্রাম উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহ জালাল মজুমদার।

আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলছেন, এই কোন্দল নিরসন করতে না পারলে দেড় বছর বাদে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে ভুগতে হবে দলকে।

তাদের সেই শঙ্কায় ভিত্তি দিচ্ছে গত বছর অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। বিএনপির বর্জনের পরও যেখানে সাড়ে চার হাজারের মতো ইউনিয়নের মধ্যে দেড় হাজারের বেশিতে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে হারতে হয়েছিল। আর নৌকাকে ডুবিয়ে বিজয়ী হওয়া সেই প্রার্থীদের অধিকাংশই ছিলেন আওয়ামী লীগেরই নেতা।

মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রায় সর্বত্রই আছে বলে স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপি-জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের আওয়ামী লীগে এনে যেমন পুনর্বাসন করেছেন অনেক এমপি, ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন, আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে পৃথক বলয় গঠন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করায় বেশ কিছু এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগও জমা পড়েছে কেন্দ্রে। আমরা সেটা আগামী বৈঠকে তুলে ধরব।”

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাফরউল্যাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব ক্ষমতা তো এমপি-মন্ত্রীদের হাতে। মন্ত্রী-এমপিদের সাথে জেলা-উপজেলার নেতারা কি পাল্লা দিয়ে উঠতে পরেন? এটাকে বলে ‘ক্ল্যাশ অফ ইন্টারেস্ট’। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে যে সকল জায়গায় দ্বন্দ্ব বেশি সেটা চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য কাজ করছি।”

আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামে প্রায় দুই দশক ধরে থাকলেও গত দুটি নির্বাচনে ফরিদপুর-৫ আসনে তাকে হারতে হয়েছে দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের কাছে। তাদের দ্বন্দ্ব গত ৯ বছর ধরেই প্রকাশ্যে।

নিক্সন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে চরভদ্রাসন, ভাঙ্গা ও সদরপুরের সব কয়টা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আমার সঙ্গে আছেন। কিন্তু দেখা যায় কি, যখনই স্থানীয় পর্যায়ের কোনো নেতা আমার সঙ্গে চলে আসেন, তখন জাফরউল্যাহ সাহেব মৌখিকভাবে কমিটি থেকে তাদের সরিয়ে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত নেতা বানিয়ে সংগঠন চালানোর চেষ্টা করেন।”

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য নিক্সন চৌধুরী কখনও দলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন না। তবে যুবলীগের সম্মেলেন শেষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময় ২০২০ সালের নভেম্বরে তাকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়।

তাদের দ্বন্দ্বের ফল নিক্সনের কথায়ই স্পষ্ট। “আমার নির্বাচনী এলাকার তিন উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নে উনার দেওয়া নৌকার নমিনেশন নিয়ে জয় পেয়েছেন মাত্র তিন জন। তিনিজনের একজন আবার আমার সঙ্গে চলে এসেছেন। অন্য দুটোর মধ্যে একটি উনার নিজের ইউনিয়ন। এছাড়া সদরপুর সদর ইউনিয়নে তিনি নৌকা দেওয়ার মতো প্রার্থী খুঁজে পাননি। একই অবস্থা হয়েছে চরভদ্রাসনের চর ঝাউকান্দা ইউনিয়নে, সেখানেও কোনো প্রার্থী পাননি।”

কাজী জাফরউল্যাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে আছি, আর সে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে।”

মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব ঘুচাতে কাজ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবু-উল আলম হানিফ। তিনি আশাবাদী, ভোটের আগেই মিটে যাবে সব।

হানিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও কিছু কিছু জায়গায় যে দ্বন্দ্ব আছে, সেটা আমরা কাউন্সিলের মাধ্যমে সমাধান করতে শুরু করেছি, আমাদের কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কাজ চলমান আছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবে না।”

স্থানীয় পর্যায়ের এই দ্বন্দ্বকে প্রতিগোগিতা হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য একটা প্রতিযোগিতা হয়। সেই প্রতিযোগিতার কারণে এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যদের একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তবে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়ার পর জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবেই নির্বাচন করে।”

একই কথা বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যা আপনারা চোখে দেখছেন, সেটা আওয়ামী লীগে সব সময়ই ছিল। নির্বাচন আসলে এগুলো থাকবে না, কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। নির্বাচন আসলে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে, এটাই আওয়ামী লীগ।”