পুলিশের বাধায় যেতে পারেননি যমুনায়। এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রতিনিধি এসে স্মারকলিপি নিয়ে যায়।
Published : 03 Nov 2024, 10:23 PM
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের চার নেতাকে হত্যার দিন ৩ নভেম্বরকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালনের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে স্মারকলিপি দিয়েছেন জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বাস্তবতায় জেল হত্যা দিবসে রোববার কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কর্মসূচি না থাকার মধ্যে রোববার তিনি এই স্মারকলিপি নিয়ে যেতে চান রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রোববার বিকেল ৪টায় রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল সংলগ্ন সাকুরা রেস্টুরেন্টের সামনে হাজির হন তাজউদ্দিন পুত্র, যিনি ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ পান। তবে অভিমান করে মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেন। সেই থেকে রাজনীতির বাইরে আছেন তিনি। বর্তমানে তিনি শরীর চর্চায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।
তার আসনে পরে আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য হন বোন সিমিন হোসেন রিমি, যিনি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
সোহেল তাজ ৫০ থেকে ৬০ জন লোকজন নিয়ে পদযাত্রা করার কথা বললেও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ সময় সাকুরা রেস্টুরেন্টের উল্টো পাশে শতাধিক পুলিশকে রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
পরে সাকুরা রেস্টুরেন্টের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তাজউদ্দিন পুত্র। সেখানেই পরে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের প্রতিনিধি এসে দাবি সংবলিত স্মারকলিপি নিয়ে যান।
স্মারকলিপিতে যত দাবি
প্রধান উপদেষ্টার কাছে কী কী দাবি তুলে ধরেছেন, সেই বিষয়টি সাংবাদিকদেরকে জানান সোহেল তাজ।
দাবি গুলো হল:
# যেহেতু ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়, সেহেতু বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র (প্রজাতন্ত্র) হিসেবে জন্ম লাভ করে। তাই এ দিনটিকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা করতে হবে।
# ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে।
# জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সব বেসামরিক ও সামরিক সংগঠক, পরিচালক, অমর শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, অবদান ও জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তকে ও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যেভাবে পালিত হল ৩ নভেম্বর
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান ও অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাখা হয়।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্য রাতে একদল সেনা সদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার নেতাকে গুলি করে হত্যা করে।
আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এই দিনটিকে ‘জেলহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে। তবে গত ৫ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুতির পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। আর এবার এই দিনটিতে কোনো কর্মসূচিও রাখা হয়নি।
রোববার প্রথম প্রহরে জাতীয় চার নেতার স্মরণে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির কয়েকজন নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন মিলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের (পুরাতন) মূল ফটকের সামনে মোমবাতি প্রজ্বালন করেন। এরপর দিনের বেলায় নেতাদের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ার অভিযোগ করেছেন তারা।
মোমবাতি প্রজ্বালনে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "মধ্যরাতে মোমবাতি প্রজ্বালন শেষে ভোরে বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গেলে পুলিশ ও ‘লাঠিয়াল বাহিনী’র বাধায় কবর জিয়ারত ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনে ব্যর্থ হই।
“দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের কেউ জাতীয় নেতাদের কবরস্থানে প্রবেশ করতে পারেনি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়েও ফিরতে হয়েছে।"
‘১৯৭১ ও ২০২৪ একই সূত্রে গাঁথা’
সোহেল তাজ মনে করেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের সরকার পতন আন্দোলনকে একই সূত্রে গাঁথা।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত নতুন একটি বাংলাদেশ, সুন্দর আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০২৪ সালে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। যে আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলনটা হয়েছে আমি মনে করি এই আশা আকাঙ্ক্ষায় আমি যে তিন দাবি নিয়ে এসেছি এই তিন দাবি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাঁথা।
“আমরা জানি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ জেগে উঠেছিল, পাকিস্তানি পৈশাচিক শাসন, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষ পূর্ব বাংলার মানুষ জেগে উঠেছিল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছিলাম এবং সেই সময় আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা ছিল এমন একটি বাংলাদেশ পাব, যেখানে সকলের সমান অধিকার থাকবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান সকলের, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। যেখানে দুর্নীতি থাকবে না, বৈষম্য থাকবে না। এমন একটি সমাজ যেখানে মেধাই হবে সকলের মাপকাঠি।
আরও পড়ুন:
মোমবাতি প্রজ্বালনে জাতীয় চার নেতাকে স্মরণ
“এই জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের কিন্তু একই লক্ষ্য। ২৪ এর আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা। মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে, লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছেন তাদের যদি আমরা সম্মান না দিতে পারি… ২৪ এর আন্দোলনে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদেরকেও আমাদের স্মরণ করতে হবে।”
তাজউদ্দিন পুত্র বলেন, “একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার নিউক্লিয়াসের উপর। আমাদের প্রতিটা জাতিরই কিন্তু একটা কোর স্ট্যান্ড থাকতে হয়। আমাদের কোর স্ট্যান্ড হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধটাই আবার আমরা করেছি আধুনিক বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সালে।”
‘মুক্তিযুদ্ধ একজনের নেতৃত্বে নয়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রতীক’
বঙ্গবন্ধুকে ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক’ উল্লেখ করে সোহেল তাজ এও বলেন, “মনে রাখতে হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু একজনের নেতৃত্বে হয় নাই। আমাদের স্বাধীনতার আদর্শ চেতনা এটা কিন্তু এক ব্যক্তির না। এটা মনে রাখতে হবে।
“এটা ছিল বাংলাদেশের সকলের চাওয়া, এই আদর্শ বা চেতনা ছিল সাধারণ জনতার।”
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের ‘সঠিক ইতিহাস’ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করে তাজউদ্দিন পুত্র বলেন, “এটা চিন্তা করলে আমি বিস্মিত হই, অবাক হই, আমি আশ্চর্য হই।
“কেন এটা করা হল না, কেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা খোলাসাভাবে তুলে ধরতে পারলাম না? আমরা নতুন প্রজন্মকে সুযোগ দিলাম না কার কী অবদান ছিল। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এক ব্যক্তি দিয়ে হয় নাই, সকলকে নিয়েই হয়েছে। সকলের প্রাপ্য ক্রেডিট দিতে হবে।”