“সাংস্কৃতিক জোট যেটা আছে, সেটা শুধুমাত্র ‘বিনোদন’কে সামনে রেখে করা। আমাদেরটা শুধু বিনোদন না, জীবনের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবিটা বোঝাচ্ছি,” বলছেন দলটির প্রধান মুন্না।
Published : 08 Jan 2024, 10:39 PM
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট। তাদের কারও জয়ী হওয়া তো দূরের কথা, একজনও জামানত বাঁচাতে পারেননি। এরপরও দুটি আসনে ‘ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ করার কথা বলে একে সাফল্য হিসেবে দেখাতে চাইছে দলটি।
নিজেদের সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা স্বীকার করে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান আবু লায়েস মুন্না বলছেন, “রাঙামাটিতে অমল কুমার রায় (প্রকৃতপক্ষে অমর কুমার দে) দ্বিতীয় হয়েছেন। তিনি ৬ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন। ঝিনাইদহে হায়দার আকবর লিংকন লড়াই করে হেরেছেন।”
প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট না পেলে প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান যে দুই আসনের ফলকে সাফল্য হিসেবে দেখাতে চাইছেন, সেই ফল দুটির তথ্য বলছে তা আশাব্যঞ্জক নয়।
মুন্না রাঙামাটিতে তার প্রার্থীর ছয় হাজার ভোট পাওয়ার দাবি করলেও ইসির ঘোষিত ফলে দেখা যায়, সেখানে মুক্তিজোটের অমর পেয়েছেন চার হাজার ৯৬৫ ভোট; যেখানে বিজয়ী আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার পেয়েছেন দুই লাখ ৭১ হাজার ৩৭৩ ভোট।
আসনটিতে প্রদত্ত ভোট হলো দুই লাখ ৮২ হাজার ৭৭৭। জামানতের হিসাব অনুযায়ী, ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট পেতে হলে প্রয়োজন পড়ে ৩৫ হাজার ৩৪৭ ভোট।
সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান ঝিনাইদহে তাদের প্রার্থীর লড়াইকে ‘সাফল্য’ হিসেবে দেখাতে চাইছেন। তবে ইসি ঘোষিত ফলে দেখা যায়, ঝিনাইদহ-২ আসনে ছড়ি প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ১৭৬ ভোট। আর প্রার্থীর নামও ‘হায়দার আকবর লিংকন’ নয়, তার নাম ‘শরীফ মোহাম্মদ বদরুল হায়দার’।
রাজধানীর যেসব আসনে ছড়ির প্রার্থী ছিল, তার একটি ঢাকা-১০। ভোটের দিন এ আসনের অন্তত ১০টি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, সবখানেই কেবলই নৌকা সমর্থকদের ভিড়। দু-এক জায়গায় লাঙ্গল সমর্থক পাওয়া গেলেও তাদের উপস্থিতি খুবই কম ছিল।
বেশিরভাগ কেন্দ্রে নৌকা ও লাঙ্গল ছাড়া অন্য প্রার্থীর পোলিং এজেন্টও চোখে নেই। সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ছড়ি প্রতীকের পোস্টার জিগাতলাসহ কয়েকটি জায়গায় দেখা গেলেও, তাদের পোলিং এজেন্টের দেখা মেলেনি।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান আবু লায়েস মুন্না অবশ্য বলছেন, তারা পোলিং এজেন্ট দেওয়ার নিয়মেরই পক্ষে নন।
“নির্বাচনের আগেই আমরা নির্বাচন কমিশনে দুটি দাবি জানিয়েছিলাম। যার মধ্যে ছিল, নির্বাচনকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিতে হবে এবং নির্বাচনে পোলিং এজেন্ট রাখার দরকার নেই।”
এবারের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে আসেনি বলে মনে করেন আবু লায়েস মুন্না। তিনি বলেন, “মানুষ তো ভোট দিতেই আসেনি, সেদিক থেকে প্রাণবন্ত নির্বাচন হয়নি।”
তবে নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন বলেও জানালেন তিনি।
নিবন্ধন পেল কীভাবে, প্রশ্ন সংস্কৃতি কর্মীদের
এক দশক আগে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রতীক ‘ছড়ি’। নামে সাংস্কৃতিক শব্দটি থাকলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকের কাছেই দলটি অচেনা। তাদের কেউ কেউ দলটির নিবন্ধনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটকে আমি চিনি না। কারা এর সঙ্গে জড়িত তাও জানি না। সংস্কৃতি শব্দটার কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
“নির্বাচন কমিশন কেন এই নামে রাজনৈতিক একটি দলের নিবন্ধন দিয়েছে? সেটিও আমাদের বোধগম্য নয়।”
আশির দশকে সামরিক শাসনামলে রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিপূরক হিসেবে সংস্কৃতিকর্মীদের তৎপরতায় গড়ে উঠেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই ইসিতে নিবন্ধিত সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের।
নির্বাচনে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ভরাডুবি হওয়ার পর নামের কারণে সংস্কৃতি কর্মীদের বিব্রত হতে হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন গোলাম কুদ্দুছ।
তার ভাষ্য, “সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই নামের কাছাকাছি একটি নাম নিয়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়ার ব্যাপারে আরও যাচাই করা উচিত ছিল। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অগ্রজ ব্যক্তিদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া উচিত ছিল।”
রাজনৈতিক দলটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান আবু লায়েস মুন্না বলেন, “আমরা তো নির্বাচনে নতুন অংশ নিচ্ছি না, এর আগেও অংশ নিয়েছি। আমরা নির্বাচন কমিশনের ৪১ নম্বর নিবন্ধিত দল।”
মুন্না বলতে থাকেন, “২০১৩ সালে আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছিলাম। কিন্তু নানা কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমাদের দুজন প্রার্থী অংশগ্রহণ করে।
“আর এবারই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সারা দেশে আমাদের ৬৩ জন প্রার্থী ছিল, ঢাকার বিভিন্ন আসনে প্রার্থী ছিল ১৪ জন।”
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া আছে মিরপুরের বসুন্ধরা হাউজের। দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অন্তত ৮জনের কাছে জানতে চাইলে তারা এ রাজনৈতিক দলটিকে চেনেন না বলে জানান।
সাংস্কৃতিক সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে কেউ রাজনৈতিক দল করতেই পারেন, কিন্তু আমি মনে করি এই দলটিকে কোনো রকম যাচাই না করেই নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
“এই দলটির সঙ্গে সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত কোনো মুখ যুক্ত আছেন, বলে আমার জানা নেই। আমিও দলটিকে বা দলের সঙ্গে যুক্ত কাউকে চিনি না। এখন আমি চিনি না বলেই দল হতে পারবে না- তা নয়; নিশ্চয় হতে পারবে। কিন্তু রাজনৈতিক দল করার জন্য যে যে শর্ত বা নিয়ম আছে, তা ঠিকমতো যাচাই করা হয়েছে কি না, আমার সন্দেহ আছে।”
সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট নামকরণের বিষয়ে জানতে চাইলে আবু লায়েস মুন্না বলেন, “আমরা জানি, সংস্কৃতি মানে শুধু গান-বাজনা নয়। মানুষের সামগ্রিক জীবনাচারই সংস্কৃতি। রাজনীতি, নাটক, গান-বাজনা সবই কিন্তু সংস্কৃতির অংশ। সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করেছি মানুষের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন জরুরি। তাই সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট নামকরণ করেছি।”
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নামে যে সংগঠনটি রয়েছে, তার সঙ্গে এ রাজনৈতিক দলটির সম্পৃক্ততা নেই উল্লেখ করে মুন্না বলেন, “সাংস্কৃতিক জোট যেটা আছে, সেটা শুধুমাত্র ‘বিনোদন’কে সামনে রেখে করা। আমাদেরটা শুধু বিনোদন না, জীবনের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবিটা বোঝাচ্ছি।”