“শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে সরকার আদালতকে ব্যবহার করছে,” বলেন তিনি।
Published : 06 Jul 2024, 04:54 PM
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে নামা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন এবং শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী অবস্থান ‘যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেছেন, “একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থায় টিকে থাকতে হলে মেধাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তাই সাধারণ ছাত্র সমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবিসমূহের সাথে আমরা একমত। আমরা আশা করি, সময় থাকতে সরকার ছাত্র সমাজের ন্যায়সংগত যৌক্তিক দাবিসমূহ মেনে নেবে… আমরা এই সমস্যার সমাধানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
‘‘একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে তা অবশ্যই যৌক্তিক ও সমর্থন যোগ্য। আমরা তাদের এই যৌক্তিক আন্দোলন সমর্থন করছি এবং অবিলম্বে এই পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।”
শনিবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন।
সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামে একটি স্কিম চালু করেছে সরকার। কিন্তু তাতে যুক্ত হলে অবসরপরবর্তী আর্থিক সুবিধা কমে যাওয়ার শঙ্কায় আন্দোলন করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা।
অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা।
‘এটা (প্রত্যয় স্কিম) বাতিল করব’
শিক্ষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘সবচেয়ে শিক্ষকদের ব্যাপারটা সেনসেটিভ এই জন্য যে, তাদের তো অন্য কোনো সোর্স অব ইনকাম নেই। অন্যান্যদের চুরি-চামারি, দুর্নীতির অভিযোগ থাকতে পারে, শিক্ষকদের তো সেটা নেই।
“সেজন্য তাদেরকে শুধু বাধ্য হয়ে এই বেতনের উপরে নির্ভর করতে হয়। এজন্য তারা বেশি বিক্ষুব্ধ এবং তারা মনে করে যে এটা তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অবশ্যই এব্যাপারে পজিটিভ ব্যাপার থাকবে। অর্থাৎ আমরা যদি কখনো সরকারে যাই, এটা (প্রত্যয় স্কিম) যদি তখন পর্যন্ত টিকে থাকে- এটা আমরা বাতিল করব।”
‘কোটা থাকতে থাকতে পারে বড়জোর ১৫%’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছুটা থাকতে পারে, প্রতিবন্ধীর জন্য আর নৃজাতির জন্য, এরকম পিছিয়ে পড়ার যারা আছে.... নট ৫৬%। এটা আপনার বড়জোর ‘ফাইভ-ফিফটিন’ পারসেন্ট হতে পারে। এর বেশি হলে মেধার বিষয়টা থাকে না।
‘‘এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধারা নাই এখন। অনেকের বয়স হয়ে গেছে। আমাদের বয়সের জায়গায় চলে গেছেন। তাদের সন্তানেরা পাবেন…সেটায় আপত্তি নাই আমাদের। তবে সেটার নাম করে যে কাউকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে, হাজার হাজার সার্টিফিকেট দিয়ে তাদেরকে চাকরি ব্যবস্থা করে দিচ্ছে টাকার বিনিময়ে...সেটা তো আমরা কখনোই সমর্থন করতে পারি না।”
সংবাদ সম্মেলনে এই দুই আন্দোলনের বিষয়ে দলের অবস্থানও স্পষ্ট করেন বিএনপি মহাসচিব, যা সম্প্রতি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
কোটা নিয়ে বিএনপির অবস্থান
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘গত কয়েকদিন যাবৎ ছাত্ররা কোটা পদ্ধতি বাতিলের জন্য হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন করছে। এটা ছাত্রদের আন্দোলন আমাদের এখানে সম্পৃক্ততা হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
দেশের একটি ‘দায়িত্বশীল’ রাজনৈতিক দল হিসেবে কোটার বিষয়ে বিএনপির মতামত তুলে ধরে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবসসমূহ এমনকি তাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মানের সাথে দাফন করা হয়। এগুলো তাদের প্রাপ্য।
“এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ নানা সুবিধা আছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের অর্থ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান অঙ্গীকার ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণ করা।”
তিনি বলেন, “সাংবিধানিকভাবে ও আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান। কিন্তু সংবিধানের ২৮(৪) ও ২৯(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নারী ও নাগরিকদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অংশ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও শারীরিক প্রতিবন্ধীর বাইরে ব্যতিক্রম হিসেবে কিছু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।”
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হল। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে।
তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল থাকবে বলে ওই পরিপত্রে বলা হয়।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।
ওই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
‘আদালতকে সরকার ব্যবহার করছে’
ফখরুল বলেন, ‘‘বর্তমান অবৈধ, অনির্বাচিত, কর্তৃত্ববাদী সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে অর্থাৎ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে জনগণের ন্যায্য দাবিসমূহ দমিয়ে রাখার ঘৃণ্য পুরোনো কৌশলেই তারা ছাত্র সমাজের ন্যায্য আন্দোলনকে দমানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আইন ও বিচার বিভাগের দোহাই দিয়ে ছাত্র সমাজের যৌক্তিক দাবি সমূহকে দমানোর সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ বলে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, জনগণের ন্যায়সংগত আন্দোলন কখনো দমানো যায় না।”
শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান, পরীক্ষা গ্রহণসহ সকল প্রকার কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রকৃত পক্ষে এটি এই দেউলিয়া সরকারের দুর্নীতির আরেকটি পথ খুলে দেওয়া। যেহেতু দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা চরম সংকটাপন্ন, সেহেতু অন্যান্য খাতসহ শিক্ষকদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে এই পেনশনের টাকা তুলে নিতে চাচ্ছে।
‘‘আমরা মনে করি, সরকারের আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নামে নতুন স্কিম চালু করা সরকারের দুর্বল আর্থিক খাত মেরামত করার একটা কৌশল। এটি এই অবৈধ ও আর্থিক দেউলিয়া সরকারের আরেকটি নতুন লুটপাটের স্কিম- যার নাম পেনশন স্কিম, প্রত্যয় স্কিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের সাথে অর্থাৎ অংশীজনদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই স্বেচ্ছাচারী কায়দায় বাধ্যতামূলকভাবে এটা চালু করতে চাচ্ছে অবৈধ সরকার।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে শাসকগোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট এক শ্রেণির ব্যবসায়িক লুটেরা সিন্ডিকেট ও কিছু কিছু সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সীমাহীন লুটপাট করছে। ব্যাংক ও সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে তারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সেরকম পরিস্থিতিতে নাগরিকরা সারাজীবনের অর্জিত সম্পদ কোন ভরসায় এই নতুন লুটপাট স্কিমে বিনিয়োগ করবে?”