একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “বাঁচব না কি মরব এর কোনো গ্যারান্টি নাই, আপনি আছেন দল নিয়ে।”
Published : 19 Aug 2024, 01:47 AM
সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এক অর্থে উধাও হয়ে গেছেন। আত্মগোপনে থেকে সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আগে বাঁচা মরা, পরে রাজনীতি।”
এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন! অথচ দুই মাস আগেও রাজনীতিতে ছিল দলটির ছিল একচেটিয়া দাপট।
এখন রাজপথে পুলিশ নেই, তবু একদল কিশোর-তরুণ ও যুবকের বাধায় ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতে পারলেন না কেউ।
প্রবল গণ আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগ, সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেওয়া, আদালতে আইনজীবী পর্যন্ত নিয়োগ করতে না পারা, এমন সব ঘটনা এখন ঘটছে।
টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের এক আন্দোলনে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি।
প্রথমবারের মত আন্দোলন মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়া দলটির আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে কোনো দিক নির্দেশনাও পাঠাননি দুই সপ্তাহে।
বেপরোয়া হামলার মুখে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, নেতাকর্মীরা পলাতক, একসঙ্গে বসার মত কার্যালয়ও নেই বললেই চলে, প্রায় সবগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরেও গোপালগঞ্জ ছাড়া তারা রাজপথে সেভাবে সক্রিয় হতে পারছেন না কোথাও।
একজন পুরনো রাজনীতিবিদ বলেছেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরও বিরুদ্ধ পরিবেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম আর রাজপথের তৎপরতা এভাবে পুরোপুরি থমকে দাঁড়ায়নি।
অবশ্য দলের এক সাংগঠনিক সম্পাদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, তারা আশা ছাড়ছেন না। আর অতীতের অভিজ্ঞতাই তার এ আশার কারণ।
“১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেও দেশে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম বহু বছর কেউ মুখে আনতে পারত না। জাতীয় চার নেতাসহ বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে। কিন্তু পরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এবারও দাঁড়াবে।”
এই আওয়ামী লীগ নেতা দেশেই আছেন, কিন্তু নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
একের পর এক মামলা
গত ১৪ অগাস্ট আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাইয়ে সংঘাতে মৃত্যুর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার কথা বলেন।
সেদিনই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন জমা পড়ে এবং সেই আবেদন প্রসিকিউশন শাখা গ্রহণও করে।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের যে উদ্যোগ নেন, সে সময় এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর চূড়ান্ত বিচার শেষে একাত্তরের খুনি বাহিনী আলবদর ও পরে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে থাকা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
দল হিসেবেও জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আইনে সংগঠনের সাজা সুনির্দিষ্ট না থাকায় সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি, আওয়ামী লীগ সরকার আইন সংশোধনে আশ্বাস দিয়েও আর উদ্যোগ নেয়নি।
স্পষ্টত সরকার পতন আন্দোলনের সময় মৃত্যুকে অন্তর্বর্তী সরকার ‘গণহত্যা’ হিসেবে দেখাতে চাইছে।
ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করার আগেরদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মত হত্যা মামলা হয়। কোটা আন্দোলন চলার মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক দোকান মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় এই মামলা গ্রহণ করে তদন্তের আদেশও এসেছে।
এরপর ঢাকায় একাধিক, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, নাটোর, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় হত্যার মামলা হয়। ঢাকায় হয়েছে একটি অপহরণ মামলাও।
এসব মামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ থেকে কোনো বক্তব্য আসছে না, ১৪ অগাস্ট সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনা একটি বিবৃতি দিলেও এসব মামলা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার।
ক্ষমতাচ্যুত দলটির সেই সাংগঠনিক সম্পাদক অবশ্য এসব মামলাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, “নেত্রী এরশাদ আমলে জেল খেটেছেন, ১/১১ তেও জেল খেটেছেন। মামলা, হামলা করে আওয়ামী লীগকে দমিয়ে রাখা যাবে না। নেত্রী জামায়াতের বিচার করেছেন, এখন সুযোগ বুঝে তার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সময় মত নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়াবে, সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।”
কিন্তু এই মুহূর্তে দলের কোনো তৎপরতা নেই কেন- এই প্রশ্নে আত্মগোপনে থাকা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রী আমাদের কোনো দিক নির্দেশনা দিয়ে যাননি, করণীয় কিছু বলেননি।"
দলের দায়িত্ব কে পালন করবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "কোনো নির্দেশনা নেই।"
ছিন্নভিন্ন দল
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেওয়ার দ্বিতীয় দিনে গত ৫ অগাস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাকে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দেশ ত্যাগ করতে ৪৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। তিনি জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ পাননি।
সেদিন সরকার পতনের দাবিতে ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আগের রাতে কারফিউ জারি করা হয়।
পরদিন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হতে দেয়নি পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থেকে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে উত্তরায় মানুষের জমায়েত হয়। এর মধ্যে বার্তা আসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, তখনই ইঙ্গিত আসে, সরকারের পতন হয়ে গেছে।
সেনাপ্রধান বিকাল পৌনে ৪টায় এসে জানান, প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা, দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে।
এর মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলের নেতাকর্মী এমনকি সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নি সংযোগ শুরু হয়ে যায়।
একটি হোটেলে আগুনে নিহত হন ২৪ জন, কোনো বাড়িতে ৭ জন, কোথাও ৬ জন, কোথাও ৩ জন বা কোথাও ৪ জনের মৃত্যুর খবর আসে।
ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সারা দেশে তার যত ভাস্কর্য, ম্যুরাল আছে সেগুলোর সিংহভাগই ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
এই গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ আওয়ামী লীগকে ‘বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে’ বলেও মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
দলীয় সভাপতিতে ‘ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার প্রতিবাদে’ সোচ্চার কেবল গোপালগঞ্জ। সেখানে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত কিছু এলাকায় মিছিলের খবর এসেছে।
৩৬ দিনের এক আন্দোলনে সাড়ে ১৫ বছরের দাপুটে শাসনের অবসানের পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় টানা কয়েকদিন কথা বলেছেন। কিন্তু একেকদিন তার একেক ধরনের বক্তব্যে কর্মীদের বিভ্রান্তি আরো বেড়েছে।
শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর বিবিসিকে জয় বলেন, তার মা আর রাজনীতিতে আসছেন না।
সেদিন তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে তিনবার ক্যু হল, সব কিছু হারিয়ে বিদেশে থাকতে হল। আাদের মা বাদে আমরা সবাই তো অনেকদিন ধরে বিদেশে আছি। এখানে আমরা সেটেলড, অভ্যস্ত। আমাদের এখাকার জীবনে কোনো অসুবিধা নাই। আমরা এখানে থাকতে অভ্যস্ত।”
হামলার মুখে সারা দেশেই পালিয়ে বেড়ানো নেতাকর্মীরা জয়ের এই বক্তব্যে আরও হতাশ হয়ে পড়েন।
পরে অবশ্য জয় বলেছেন, তিনি রাজনীতিতে আসতে এবং দলের নেতৃত্ব নিতে প্রস্তুত, নির্বাচন দিলেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন, তিনি ভারত যাওয়ার আগে পদত্যাগ করেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “আগামী অন্তত ১০ বছরের জন্য আওয়ামী লীগকেই রাজনৈতিকভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”
ওবায়দুল কাদের কোথায়
শেখ হাসিনার অবস্থান তাও জানা গেছে, কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন, সেটি প্রকাশও পায়নি। নোয়াখালীতে তার গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তার ঢাকায় বাসায় থাকতেন, এমন একজন বলেছেন, গত ৪ অগাস্ট সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল কাদেরের।
হঠাৎ তিনি বললেন, “আমি বাইরে যাচ্ছি।”
সেদিন বিকালে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে সামস পরশের বাসায় বৈঠকে বসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনসহ শেখ পরিবারের নেতারা।
যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “রবিবার রাতেই তারা দেশ ছেড়েছেন।”
শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দেশ ছেড়েছেন আরও কিছু মন্ত্রী-সংসদ সদস্য। তবে কেউ কেউ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা আটকে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদকে।
গত মঙ্গলবার রাতে কাদেরকে যশোরে আটকের গুঞ্জন উঠে সামাজিক মাধ্যমে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
সেদিনই শেখ হাসিনা সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন তাদেরকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড আবেদনে তারা আইনজীবী নিয়োগের সুযোগও পাননি।
পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ভেঙে দেওয়া সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককেও।
দুশ্চিন্তা ‘বেঁচে থাকা নিয়ে’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রী এই দেশটাকে গড়েছেন, যাওয়ার আগে অবশ্যই জাতির উদ্দেশে এবং দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কিছু বলে যেতেন, হয়ত সময় পাননি।"
এখন দল কীভাবে চলবে এমন প্রশ্নে আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “বাঁচব না কি মরব এর কোনো গ্যারান্টি নাই, আপনি আছেন দল নিয়ে। দেখেন না যেখানে আওয়ামী লীগ পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই হত্যা করে যাচ্ছে। দোয়া করেন যেন বেঁচে থাকি, তাহলে বহু কিছু করা যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন দল নিয়ে নেই। আছে বাঁচা মরার লড়াই নিয়ে।”
আরেক নেতা বলেন, “সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত, কেউ রেহাই পাচ্ছে না, যেখানে যাকে পাচ্ছে পিটিয়ে, কুপিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বাঁচলে রাজনীতি, বাঁচার সুযোগ দেয় কিনা, সেটাই এখন বিষয়।“
বেপরোয়া হামলা-লুটপাট
সরকার পতনের বিকালেই ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি কুতুব জাহাঙ্গীরের বাড়িতে হামলা হয়। তাকে রাস্তায় নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জাহাঙ্গীরের প্রতিবেশী ফখরুল ইসলাম বলেন, "হঠাৎ করে কয়েকশ লোকজন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করেন তাকে। তখন বাড়ির অন্যলোকজন বাড়ি থেকে বের হতে হতেই কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। পরে ডুপ্লেক্স বাড়টিতে আগুন লাগিয়ে দেয়।"
৫ অগাস্ট দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি শারিফুল ইসলাম শারিফ নদী পার হয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। তাকে মারধর করে গলায় রশি বেঁধে পানিতে চুবিয়ে দেওয়া হয়।
কামরাঙ্গীর চর ঘাটের লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে তার খোঁজ পায়নি পরিবার। পরে অনেক দূরে তিনি ভেসে উঠেন। তিনদিন পর তার পরিবার এই কথা জানতে পারে।
একই অবস্থা সারা দেশের জেলা থানা পৌরসভা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগসহ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও।
৫ অগাস্ট লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানের বাসায় আগুন দেওয়া হয় মিছিল নিয়ে এসে। বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর সেখান থেকে ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেসে আগুন দেওয়ার পর সেই বাড়ি থেকে চার জনের মরদেহ উদ্ধার হয়।
সিলেটে সরকারি স্থাপনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, মৌলভীবাজার-২ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে গত নির্বাচনে নির্বাচিত রণজিত চন্দ্র সরকার, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন ও নগরভবনে হামলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের শ্বশুরবাড়িতেও আক্রমণ হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সহিংসতায় ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ায় ৩৩ জনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
আন্দোলনকারীরা সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। সরকারি ভবন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাসা-কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন হোটেল জাবীর ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এক বিদেশিসহ ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নাকনা এবং সদর উপজেলার বৈকারী গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের কারখানা ও গুদাম লুট হয়েছে। গ্রুপের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এই লুটপাটে তাদের কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবাদী গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করতে পেরেছেন কেবল গোপালগঞ্জে। দলীয় প্রধানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার শপথও নিয়েছেন তারা।
সরকার পতনের তৃতীয় দিনে বুধবার বেলা ১২ টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তারা এই শপথ পড়েন।
সমবেত কণ্ঠে সবাই বলেন, “আমি শপথ করছি যে, যতদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে না আনবো ততদিন পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।
“আমি আরো শপথ করছি যে, তার উপর ঘটে যাওয়া সকল প্রকার অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবে। আজ থেকে আমাদের আন্দোলন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা। আমি এই শপথ বাক্য বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ ছুঁয়ে করছি। আমাদের এই শপথ মহান রব্বুল আলামীন কবুল করুক। আমিন, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”
এরপর থেকে ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত টানা প্রতিবাদ হয়েছে সেখানে। মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, বরগুনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীসহ আরও কিছু জেলায় প্রতিবাদ হয়েছে, তবে সেই বিক্ষোভ গোপালগঞ্জের মত এত প্রবল ছিল না।
নতুন সরকার কী ভাবছে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ‘গণ্ডগোল’ না পাকিয়ে দল গোছানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন ১২ অগাস্ট। কিন্তু তার সেই বক্তব্যকে ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা’ হিসেবে দেখিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর চার দিনের মাথায় এম সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হয় অন দপ্তরে।
শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়ে সাখাওয়াত বলেছিলেন, “আপনি ভালো থাকেন, আবার আসেন। আমরা সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু গণ্ডগোল পাকানোর মানে হয় না, গণ্ডগোল পাকিয়ে তো লাভ হবে না। এতে লোকজন আরো ক্ষেপে উঠবে।”
আর আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। সে দলে প্রচুর ভালো ভালো নেতা আছে, আমি এখনই নাম বলতে পারি। এ দলটা একসময় বাঙালিদের সেক্যুলারপন্থি দল ছিল। বাঙালি আপার ক্লাস মুসলিম লীগে ছিল, আর মিডল ক্লাসের দল ছিল আওয়ামী লীগ।
“এতবড় মানুষের দল, যিনি এদেশ স্বাধীন করেছিলেন, এতে তো কোনো সন্দেহ নাই। কারো সন্দেহ থাকার কথা না। উনি (বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান) স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন, উনার নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, স্বাধীনতা হয়েছে। সে দল এরকমভাবে ভেঙে পড়ে যাবে! যে দলের লোক এখন লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি উনাদেরকেও কথা দিচ্ছি। আপনারাও দল গুছিয়ে নেন। আপনাদের দলকে কেউ তো নিষিদ্ধ করেনি।”
ওইদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমাবেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে।
ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আজকে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ‘খুনিদেরকে’ পুনর্বাসন করার বক্তব্য দিচ্ছেন। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনি উপদেষ্টা হয়েছেন। সুতরাং যখন কোনো বক্তব্য দেবেন, আপনার সামনে যেন ৫ অগাস্টের গণভবনের চিত্রটা যেন মাথায় থাকে।
“যারা স্বৈরাচারকে পুনর্বাসন করতে চায়, ‘খুনি’ হাসিনাকে পুনর্বাসনের মত বক্তব্য দিতে চায়, আমরা ছাত্র-জনতা যেভাবে তাদেরকে উপদেষ্টা বানিয়েছি, ঠিক একইভাবে গদি থেকে ছুড়ে নামাতে দ্বিধা করব না।”
এরপর গত শুক্রবার উপদেষ্টা পরিষদের নতুন চার সদস্যের দায়িত্ব বণ্টনে সাখাওয়াতকে স্বরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এর মধ্যে ১৪ অগাস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ‘জুলাই গণহত্যার’ বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, “সাবেক সরকারের সরকারপ্রধানসহ অন্য যারা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যাদের আদেশ নির্দেশ থাকার অভিযোগ রয়েছে, আমরা পত্রপত্রিকায় কিছু মন্ত্রীর নাম দেখেছি। আমরা এখানে কোনো ছাড় দেব না। আমরা বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটা পর্যন্ত খতিয়ে দেখব।”