‘দুষ্টচক্র ভেঙে’ ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে চান সিপিবির প্রার্থী রুবেল

কেবল গুলশান-বারিধারাবাসীর কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন স্বপ্ন না সাজিয়ে ঢাকাকে মেহনতী ও শ্রমজীবী মানুষের জন্যও একটি বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চান উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রার্থী আহাম্মদ সাজেদুল হক রুবেল।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2020, 08:03 AM
Updated : 12 Jan 2020, 01:44 PM

তিনি বলছেন, নির্বাচিত হলে তার কাছে গুরুত্ব পাবে মানুষকে নিয়ে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যার লক্ষ্য হবে ঢাকাকে বাসযোগ্য করা।

কীভাবে ঢাকাকে বাসযোগ্য করা সম্ভব? সাজেদুল হক রুবেল বলছেন, সেজন্য আন্দোলন করে হলেও নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তার আগ পর্যন্ত ঢাকায় নাগরিক সেবাদানকারী ৫৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজে সমন্বয় আনতে বাধ্য করতে হবে।    

পেশায় চিকিৎসক রুবেল রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা। আগামী ৩০ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রুবেল লড়বেন সিপিবির দলীয় প্রতীক কাস্তে নিয়ে। আর এবারের নির্বাচনে পুরো ঢাকার ভোট হবে ইভিএমে। 

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরুর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাজেদুল হক রুবেল বলেছেন, ইভিএম নিয়ে তার দল সিপিবির আস্থা নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না- তা নিয়েও তিনি সন্দিহান। তারপরও ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ।

‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত’ মেয়র

রুবেলের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া-রাজনীতি সবই ঢাকায়। তার দেখায়, স্বাধীনতার পর অর্ধশত বছরে ঢাকা দিন দিন দূষিত, বসবাসের অযোগ্য হয়েছে।

“এখানে মশায় মানুষ মরছে, বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর শতাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। ঢাকাকে আমরা বাসযোগ্য করতে চাই। বদলে দিতে চাই। কিন্তু পারছি না কেন? মেয়ররা পারছেন না কেন? আমরা এই না পারার কারণটাতে জোর দিতে চাই।”

ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা রুবেলের মতে, ‘দুর্বৃত্তায়িত’ রাজনীতি এবং ‘দুষ্টচক্রের’ মধ্যে আটকে যাওয়াই মেয়রদের সফল হতে না পারার মূল কারণ।

“একটা দ্বিদলীয় রাজনীতি আমাদের মধ্যে কাজ করছে। আওয়ামী লীগের নৌকা আছে, বিএনপি-জামায়াতের ধানের শীষ আছে। নৌকা এবং ধানের শীষ আমাদের দেখানো হয়। এর মধ্যে থেকেই মন্ত্রী হবে, মেয়র হবে, সবকিছু…। এই চক্রের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলো সব লুটপাট হয়ে যাচ্ছে।

“ফলে এদের প্রতিনিধিরা যখন নেতৃত্বে আসছেন তখন সিটি করপোরেশন টেন্ডারবাজিতে ডুবে যাবেই, আমাদের অভাব-অভিযোগও পূরণ হবে না, দলীয়করণ-স্বজনপ্রীতি চলবে।… এর থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই। বেরিয়ে এসে প্রথম যে জিনিসটা চাই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেয়র।

“দ্বিতীয়ত, মেয়র এবং সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা খুবই সীমিত। ঢাকায় যে প্রকাণ্ড সমস্যা, এর সমাধানে কতটুকু সাংবিধানিক এখতিয়ার আছে সিটি করপোরেশনের- সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”

সবার জন্য ঢাকা

নির্বাচিত হলে রাজধানীকে কীভাবে বদলে দিতে চান সিপিবি প্রার্থী রুবেল? উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বললেন, উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিই তারা বদলে দিতে চান।

“মেয়ররা একটা শোপিস হিসেবে ঢাকা শহরের স্বপ্ন দেখে। আমরা সেই স্বপ্ন দেখতে চাই না। কারণ সেই স্বপ্নের ঢাকার মধ্যে মেহনতি, শ্রমজীবী মানুষের কোন স্থান নেই।

“ঢাকা কী একদিনও চলবে গৃহশ্রমিক ছাড়া? গার্মেন্টস শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক- এদের ছাড়া? চলবে না। ঢাকার অর্থনীতি চলবে না। কিন্তু কোথায় তাদের আবাস? কোথায় থাকবেন? তারা কী মানবেতর জীবন যাপেই করবেন, যেভাবে এখন করছেন?”

রুবেল বলছেন, তিনি এবং তার দল নির্বাচিত হলে পুনর্বাসন ছাড়া কোনো বস্তি বা কোনো ঘর উচ্ছেদ করা হবে না। নির্বাচিত হলে তিনি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।

“ঢাকা মানে সবার ঢাকা। ঢাকা মানে শুধু গুলশান নয়, বারিধারা নয়, ডিওএইচএস নয়, ঢাকা মানে পুরো ঢাকা। সব মানুষের জন্য ঢাকা করতে চাই।”

লক্ষ্য নগর সরকার ও সমন্বয়

ঢাকার উন্নয়নকাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের স্বার্থে ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠা সিপিবির পুরনো দাবি। নির্বাচিত হলে নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন বলে জানালেন সিপিবির প্রার্থী রুবেল।

“নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়রের চেয়ারে বসার চেয়ে দরকার হচ্ছে, এই ঢাকার মানুষকে নিয়ে একটি আন্দোলনে নামা। ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য, বাসযোগ্য করার জন্য। সে আন্দোলনের একটি লক্ষ্য হচ্ছে নগর সরকার করা। এটা ছাড়া ঢাকাকে বদলানো সম্ভব না। ৫৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকার দেখভাল করে। কোনো সমন্বয় নেই।”

তবে আইন করে নগর সরকার প্রতিষ্ঠা যেহেতু সময়সাপেক্ষ বিষয়, সেহেতু নির্বাচিত হলে ওই সমন্বয়ের চেষ্টাও করতেন চান সিপিবির প্রার্থী।

মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে শুক্রবার নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন ঢাকা উত্তরে বাংলাদেশের কমিউনিস্টি পার্টির মেয়র প্রার্থী আহাম্মদ সাজেদুল হক।

“শুধু মেয়রের গদি থেকে নয়। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সমন্বয়ে বাধ্য করব। আমাদের লড়াইটা মেয়র হওয়ার পর শেষ নয়, আরেকটা মাত্রায় যাবে।”

রুবেল বলছেন, মেয়র হতে পারলে মানুষের প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনুযায়ী কর্মসূচি নিতে চান তিনি। সেজন্য প্রতিমাসে ওয়ার্ড ভিত্তিক গণশুনানি করতে চান।

“এই যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বয় করা, এটা যদি করতে পারি, তবে কোনো চমক তৈরি হবে না ঠিকই, ঢাকা ধীরে ধীরে বিকশিত হবে, বাসযোগ্য হবে।”

সংশয় নিয়েই নির্বাচনে

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর সিপিবির আস্থা নেই। এমনকি সিটি নির্বাচনের চলমান প্রচারে বিধিমালার প্রয়োগ নিয়েও ইসির প্রতি সিপিবির অভিযোগ আছে। তারপরও সিপিবি কেন এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর রুবেল দিলেন দলের ভাষাতেই।

“এটা আমাদের ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ। তবে এটা দুটি আন্দোলন এক জায়গায় মিলে যাওয়া। এক বছর আগে, যে ভোট ডাকাতির নির্বাচন হলো, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮; ওই নির্বাচনে যেভাবে আমাদের ভোটের অধিকার নষ্ট হয়েছে, যেভাবে ডাকাতি হয়ে গেছে, তার প্রতিবাদ চলছে।

 

“আদতে এই নির্বাচন কমিশন, এই সরকারের অধীনে আমরা কমিউনিস্ট পার্টি মনে করি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, জনগণের এই নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো আস্থা নেই। আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব জনগণের বা দলগুলোর নয়। আস্থা ফিরিয়ে আনার দায় নির্বাচন কমিশনের।”

কিন্তু কমিশন এখন পর্যন্ত সেই দায়িত্ব ‘পালন করছে না’ মন্তব্য করে কাস্তের প্রার্থী বলেন, অনেক জায়গায় ‘তথাকথিত বড় প্রার্থীরা’ নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করছেন, কিন্তু ইসি তা দেখছে না। 

“এখন যেটা চলছে, মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীদের জন্য একধরনের ইনডেমনিটি রয়েছে। তারা বিধিামালা ভাঙতে পারে, তাদের বিচার হবে না।”

তারপরও নির্বাচনে থাকার ব্যাখ্যায় রুবেল বলেন, সিপিবিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে কার্যত একটি ‘ব্ল্যাংক চেক’ তুলে দিয়েছিল। সেই সুযোগ তারা আর সরকার বা নির্বাচন কমিশনকে দিতে চান না।

“খোলা মাঠ ছেড়ে দিতে চাই না। আরেকটা জিনিস গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য। নৌকা ও ধানের শীষ- দ্বিদলীয় রাজনীতি শেষ কথা নয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বামপন্থিরা আছে। গরিবের মার্কা কাস্তে আছে। এই বিকল্পের যে ঝাণ্ডা, সেটাকে আমরা ফেলে দিতে চাই না।”

নির্বাচন কমিশন কী করে সেটা শেষ পর্যন্ত দেখবেন জানিয়ে সিপিবি প্রার্থী বলেন, “প্রত্যেকটি অপরাধের বিচার জনগণ এক সময় করবে। তাদেরকে আমরা পর্যবেক্ষণ করব। প্রয়োজনে প্রতিহত করার চেষ্টা করব। জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করব নির্বাচনোত্তর কালে।”

আর এক যুগ ধরে চালিয়ে আসা  ‘সবার জন্য বাসযোগ্য ঢাকা আন্দোলন’ এর কথা মনে করিয়ে দিয়ে রুবেল বলেন, “আমাদের এই আন্দোলন চলছে দীর্ঘসময় ধরে, আমি সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এই সামাজিক আন্দোলন আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। সেটার অংশ হিসেবেও আমরা নির্বাচন করছি।”

ইভিএম ‘রহস্যময়’

নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসা সিপিবির প্রার্থী রুবেল সিটি নির্বাচনেও যন্ত্রে ভোটগ্রহণ নিয়ে আস্থার সংকটের কথা বললেন।    

“যখন ব্যালেট বাক্স স্বচ্ছ ছিল, কয়টা ভোট পড়েছে দেখা যেত, যেটা সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারত, সেই প্রক্রিয়াতেও দেখেছি ভোট ডাকাতি হয়েছে। আগের রাতে ভোট হয়েছে। এখন এই ইভিএম মেশিনে… এখানে যদি আগে থেকে ২০-৩০ শতাংশ কোনো একটি প্রক্রিয়ায় সফটওয়্যারে প্রোগ্রামিং করা থাকে, কে এর স্বচ্ছতা বিচার করবে?”

রুবেল বলেন, “একেক নির্বাচনে কারচুপির প্রক্রিয়া বা স্টাইলে নতুন নতুন ভার্সন আসে। এবার হয়ত দেখা যাবে আগের রাতে ভোট পড়েনি, ভোট কেন্দ্রে কোনো রিগিং হয়নি, সবাই ভোট দিতে পারছে। কিন্তু দেখা যাবে ভোটের ফলাফলটা ভৌতিকভাবে হয়ত বদলে যেতে পারে। নতুন ষড়যন্ত্র চলছে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে।”

সারা পৃথিবীতেই ইভিএম ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ইভিএমের মাধ্যম সুষ্ঠু নির্বাচন হবে সে ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির আস্থা নেই এবং এটি একটি রহস্যজনক প্রক্রিয়া।”

দক্ষিণে সিপিবির প্রার্থী নেই কেন?

ঢাকা সিটি নির্বাচনে সিপিবি উত্তরে প্রার্থী দিলেও দক্ষিণে কেন দেয়নি তা জানতে চেয়েছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। রুবেল বললেন, দক্ষিণে তার দলের প্রার্থী না থাকার কারণ ‘আর্থিক সীমাবদ্ধতা’।

“আমাদের অনেক কমরেড পাড়ায় পাড়ায় বছরের পর বছর কাজ করছে। সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত কেউ, কেউ শ্রমিক, কেউ যুবক, কেউ বেকার। আর্থিক সীমাবদ্ধতা আমাদের রয়েছে।”

ইসির নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থী হতে হলে জামানতের টাকা জমা দেওয়ার পাশাপাশি ভোটার তালিকার সিডি কিনতে হয়। উত্তরে সিডির দাম ২৭ হাজার টাকা, দক্ষিণে প্রায় ৩৭ হাজার টাকা।

“আমাদের মত যারা বাম রাজনীতি করছে তাদের জন্য এটা কঠিন চ্যালেঞ্জ।… তার মানে হচ্ছে রাজনীতি করবে শুধু কোটিপতিরা, সাধারণ মানুষ রাজনীতি করবে না, ভোটে দাঁড়াবে না…। নির্বাচন কমিশন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।”

পরিচ্ছন্ন ঢাকার জন্য পরিচ্ছন্ন রাজনীতি

সিপিবির প্রার্থী সাজেদুল হক রুবেল বলেন, ভোটারদের এটা ভাবতে হবে যে তাদের এবং তাদের সন্তানদের এই শহরেই থাকতে হবে।  

“আমরা পরিচ্ছন্ন শহর চাই, পরিচ্ছন্ন ঢাকা চাই। মনে রাখবেন সবাই, পরিচ্ছন্ন ঢাকা কখনও পরিচ্ছন্ন রাজনীতি ছাড়া সম্ভব নয়।”

তার ভাষায়, ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে প্রয়োজন বিকল্প নেতৃত্ব।

“তাই আমরা বামপন্থি প্রার্থী, কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী কাস্তে মার্কায় লড়ছি, আমরা এই আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে বিকল্প নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে চাই। বাংলাদেশকে বদল করার আগে চলুন আমরা প্রিয় শহর ঢাকাকে বদলে দিই।”