দুর্নীতির বিস্তার এমন ঘটেছে যে ‘এটা ছাড়া মৃতের দাফনের জায়গাও মিলছে না’ মন্তব্য করে মেয়র নির্বাচিত হলে সবার আগে সিটি করপোরেশনে দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল।
Published : 11 Jan 2020, 10:07 AM
এটা ছাড়াও আধুনিক ও টেকসই নগরী গড়তে আরও ১২টি নাগরিক সমস্যা চিহ্নিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লেখাপড়া করে আসা এই ব্যবসায়ীপুত্র।
তার দৃষ্টিতে ডেঙ্গু, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও যানজটের মতো বাসা ভাড়াও ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য একটি বড় সমস্যা।
সিটি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাঁচ বছর আগের নির্বাচনী অভিজ্ঞতার পাশাপাশি মেয়র নির্বাচিত হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকা ঘিরে তার পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তাবিথ আউয়াল।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ ২০১৫ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আলোচনায় আসেন রাজনীতির অঙ্গনে। ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে সেবার ভোটের মাঝপথে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও এবার তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কায় থাকা তাবিথ এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দেখছেন বাংলাদেশকে ‘গণতন্ত্রের কক্ষপথে’ ফেরানোর লড়াই হিসেবে। সেই লড়াইয়ে জয়ী হতে পারলে ঢাকার নাগরিক সমস্যার সমাধানে কাজ করা সহজ হবে বলেই মনে করছেন তিনি।
ঢাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকেই তাদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে জেনেছে তরুণদের প্ল্যাটফর্ম ‘অদম্য ঢাকা’। মেয়র নির্বাচিত হলেও রাজধানীর উন্নয়নে এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে এগোনোর পরিকল্পনা রয়েছে তার।
তাবিথ আউয়াল বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে নাগরিক সমস্যার ১২টা জায়গা চিহ্নিত করে ফেলেছি। এই ১২টা জায়গায় আমরা সমন্বয় ও গুরুত্বের ভিত্তিতে একযোগে কাজ শুরু করে দেব।
“বর্জ্য, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, বাসা ভাড়া, ট্রাফিক, ফুটপাত, মশা, মশা থেকে ডেঙ্গু, নানা রোগ এমন ১২টি সমস্যাকে আমরা চিহ্নিত করেছি। এগুলো সব পরস্পর সম্পর্কিত। প্রতিটি ইস্যু ধরে একযোগে কাজ শুরু করতে হবে।”
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে রেকর্ড মৃত্যু ও আক্রান্তের বছর পেরিয়ে আসা ঢাকা শহরকে ‘গাফিলতিজনিত এই অভিশাপ’ থেকে মুক্তি দিতে চান তাবিথ আউয়াল।
তিনি বলেন, “মেয়র নির্বাচিত হলে ডেঙ্গু মোকাবেলায় বড় ভূমিকা থাকবে আমার। এমন তো না যে আমরা আগে থেকে জানতাম না। উনারা (ঢাকার সাবেক দুই মেয়র) অবহেলা করে, দুর্নীতিকে প্রায়োরিটি দিয়ে কিন্তু উনারা সঠিক মশার ওষুধ কেনেন নাই।
“মশার লার্ভা, লার্ভি সাইট, মশা-এগুলো দমনে কাজ করতে হবে। যথাযথ ইনসেকটিসাইড ব্যবহারের পাশাপাশি তৈরি করতে হবে সচেতনতা। আইন করে ফাইন করে, প্রাইভেট লোকদের হয়রানি করে কিন্তু কোনো কাজ হবে না। আমরা সচেতনতামূলক কিছু আন্দোলন গড়ে তুলব। আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব। সচেতনতার জায়গা থেকে পুরো বছর ধরে আমাদের ভালো একটি ক্যাম্পেইন করতে হবে।”
ঢাকায় নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাবিথ আউয়ালের।
নগরে সুপেয় পানির সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ নেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্যবহৃত পানি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আবার আমাদের ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে আমাদের ওয়াটার টেস্টিং ফ্যাসিলিটি করতে হবে। ওয়াসার উপরে ডিপেন্ড করলাম, তারা কি বলল না বলল, পানি পাঠায় দিলাম দুই জায়গার ল্যাবে, তারপর দুই রকম তথ্য আসল। সেদিন আমাদের ভুলে যেতে হবে। পানির মান যদি গ্রহণযোগ্য মাত্রার নিচে নেমে আসে তাৎক্ষণিকভাবে ওয়াসাকে চাপ দিতে হবে। সেখানে যা যা করা দরকার তা করবে। রিয়েল টাইম কাজ হবে এখানে। ওয়েট অ্যান্ড সি পলিসিতে আমরা যেতে পারব না।”
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তাবিথ বলেন, “প্রয়োজনে প্রাইভেট আউট সোর্সের মাধ্যমে হলেও আমাদের আরও অনেক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করতে হবে। জনসংখ্যা অনুযায়ী মানসমম্মত টয়লেটের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বস্তিবাসীদের জন্যও বাথরুম ফ্যাসিলিটি দিতে হবে।”
তাবিথ আওয়াল বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ১১ নম্বর ধারায় যে সাসটেইনেবল সিটির কথা বলা হয়েছে, তেমন এক শহর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবেন তিনি।
দুর্নীতি দমন
তাবিথ আউয়াল মনে করেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি স্তর ‘দুর্নীতিতে ভরে গেছে’। মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি সবার আগে এই দুর্নীতি দমনে কাজ করতে চান।
“সিটি করপোরেশনের প্রত্যেকটা স্তরে দুর্নীতি। দুর্নীতি আমি দুই ভাগে বলতে চাই। একটা হল করাপশন-এটা সমস্ত প্রকিউরমেন্টে। যেখানে হাত দেবেন, প্রকিউরমেন্টে দুর্নীতির ছোয়া দেখছি। দ্বিতীয়ত আমরা দুর্নীতি দেখছি নাগরিকদের সেবার ক্ষেত্রে। কোনো সেবা চাইতে হলে যে ধরনের সময় অপচয় হয়, ঘুষ না দিলে বা এক্সটোরশন না হলে বেসিক সুযোগ-সুবিধা তারা পান না। ইভেন কবরস্থানে পর্যন্ত দুর্নীতি ছাড়া বরাদ্দ পাচ্ছেন না ।
“একজন সুইপার থেকে মেয়রের অধিদপ্তর পর্যন্ত দুর্নীতি কিন্তু ছড়িয়ে যাচ্ছে।”
এই দুর্নীতি বন্ধে যা যা প্রয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, “দুর্নীতির এগেইনস্টে যদি আমরা অভিযান না করি তাহলে কোনো কাজই আগাবে না। দুর্নীতির সাথে কন্ট্রাক্টর জড়িত, কাজ জড়িত, নাগরিক সেবা জড়িত। তাই সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি দুর্নীতি মোকাবেলাও প্রধান প্রায়োরিটি হবে আমার।”
অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়
স্থানীয় সরকার বিভাগের নানা অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করার কথা থাকলেও সিটি করপোরেশনের মেয়ররা বলছেন, নানা ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। ওয়াসা, তিতাসসহ নানা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সিটি করপোরেশনের দ্বন্দ্ব দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে।
তাবিথ বলছেন, ‘বিতর্কিতভাবে’ মেয়র নির্বাচিত হওয়াতেই সরকারি সংস্থাগুলো তাদের সহযোগিতা করে না।
“সুষ্ঠ নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করবেন, জনমত নিয়ে আসবেন, এই জনমতটাই হল আসল ক্ষমতা। জনরায় যখন জনপ্রতিনিধির হাতে চলে যাবে, ওই জনপ্রতিনিধি যখন ৫৪টি সংস্থার সঙ্গে বসবেন, তখন তার সামাজিক ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ হবে না। অপরদিকে সংস্থাগুলো যখন দেখবে, মেয়র পদে বিতর্কিতভাবে এসেছেন তখনই তো মেয়রের ক্ষমতা কমে যায়।”
জনগণের রায় নিয়ে আসতে পারলে এই ৫৪ সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশাবাদী তাবিথ আউয়াল।
কাউন্সিলরদের ক্ষমতা বৃদ্ধি
তাবিথ আউয়াল মনে করেন, কাউন্সিলরদের ক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিৎ, এতে তারা স্বেচ্ছায় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে উৎসাহী হবেন।
তিনি বলেন, “কাউন্সিলরদের আরও একটু বেশি ক্ষমতা দিতে হবে। তাদের সম্মান করতে হবে। কাউন্সিলরদের আমরা ভোটের মাধ্যমে আনছি কিন্তু কাজ করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আমরা দিচ্ছি না।
“কাউন্সিলরদের আমরা যদি আরও একটু উজ্জীবিত করি, তাদের যদি দায়িত্ব আরও বেশি করে দেই তাহলে তারা খুশি মনে আরও সফলতার সাথে নাগরিকদের সুযোগ সুবিধা দিতে পারবেন।”
মেয়র নির্বাচিত হলে কাউন্সিলরদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাবিথ বলেন, “আমরা ক্ষমতা শেয়ার করব, কম্প্রোমাইজের জায়গায় যেতে হবে। কারণ দুই পক্ষই এখন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে এসেছে, কেউ কারও চেয়ে কম না সামাজিকভাবে বা ভোটের ক্ষমতার মাধ্যমে।”
ইভিএমে শঙ্কা, জটিলতাও দেখছেন
আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন থেকে ‘সরিয়ে দিতেই’ নির্বাচন কমিশন ইভিএমে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছে বলে অভিযোগ করেন তাবিথ।
তিনি বলেন, “উনারা চেষ্টা করবেন আমরা যেন নির্বাচন থেকে সরে যাই। বর্তমান নির্বাচন কমিশন খুবই সফল হয়েছে জনগণকে নির্বাচন থেকে বিমুখ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে। ম্যান্ডেন্ট হল, কোনো জনগণের প্রতিনিধি যেন ভোটের মাধ্যমে আর রাজনীতি করতে না চান। আমাদের নিরাশ করতেই এ ইভিএম ব্যবহার করা।”
ইভিএমে কারচুপির শঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপির মেয়র প্রার্থী বলেন, “কে বলবে, এমন কোনো সফটওয়্যার কোডিং করা হয় নাই যা বিকাল ৫টায় ভোটের তালিকা বদলে দিবে? আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, উত্তর পাইনি। তার মানে তো কিছু না কিছু লুকানো আছে।”
ইভিএমের বিষয়ে সাধারণ ভোটাররা একদম ‘অপ্রস্তুত’ দাবি করে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনারদেরও প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নাই। তারা জটিলতার জায়গা বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
পানামা পেপারসে নাম
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিদেশে অর্থপাচারের তথ্য ফাঁস করে সাড়া ফেলে দেওয়া পানামা পেপারসে তাবিথ আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম আসা নিয়ে সরব আওয়ামী লীগ নেতারা।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তাবিথ বলেন, ‘নির্বাচনী নীতিমালার কারণে’ তিনি এ বিষয়ে কিছু বলবেন না।
এবার নির্বাচন বর্জন নয়
ঢাকা দুই ভাগ হওয়ার পর ২০১৫ সালে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ ও দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাস দুজনই মাঝপথে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
তবে এবার আর সেই পথে না যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করে তাবিথ বলেন, “পুলিশের মামলা হবে, হামলা হবে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের পক্ষ থেকে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ না। আমরা জেনেশুনে নির্বাচনে যাচ্ছি। জেনেশুনে যখন যাই, তখন তো বর্জন করার এক্সিকিউজ আমাদের থাকে না।
“আমরা বিশ্বাস করি, আমরা যদি ইলেকশনে শেষ পর্যন্ত থাকি, কোনোভাবে যদি একটু সুস্থতার জায়গাতে ফেরত আনতে পারি প্রক্রিয়াটিকে তাহলে বিজয় আমাদের নিশ্চিৎ। যেখানে নিশ্চিৎ আমাদের বিজয়, আমি কেন নির্বাচন বর্জন করব?”
তাবিথকে কেন ভোট?
নিজেকে সব প্রজন্মের প্রতিনিধি মনে করেন তাবিথ আউয়াল। ব্যক্তিগত জীবনের ‘সাফল্যকে’ মেয়র পদেও প্রমাণের সুযোগ চান তিনি।
“ব্যক্তিগত জীবনে অল্প বয়সেই সফলতা পেয়েছি, মেয়র পদে সুযোগ পেলে সফলতা অর্জন করতে চাই। সকল ভোটারদের কাছে আমার একটা বিনীত আহ্বান- আপনারা অবশ্যই নিজের ভোট নিজেরাই দেবেন। ভোটের অধিকার আপনারাই রক্ষা করবেন।”
শুনতে চান ভোটারদের কথা
নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার, ব্যানারের পুরনো ধারার সঙ্গে অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও কর্মকাণ্ড পরিচালনাকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন বয়সে তরুণ তাবিথ আউয়াল।
ফেইসবুক-টুইটারের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার পরিকল্পনা জানিয়ে তিনি বলেন, “অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আমরা সরাসরি ভোটারদের কাছে পৌঁছে যেতে পারি। ডিজিটাল মিডিয়াকে অন্যভাবে ব্যবহার করব।
“আগে প্রার্থীরা বলতেন, ভোটাররা শুনতেন। এবার আমরা ভোটারদের অভিযোগ শুনব, পরামর্শ শুনব, যেন ক্যাম্পেইনের শেষে জনগণের ইশতেহার তৈরি করতে পারি।”