শুরু করা কাজ ‘এগিয়ে নিতে’ আবার মেয়র হতে চান আতিক

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে যে কাজগুলো শুরু করেছিলেন, সেই কাজগুলো এগিয়ে নিতে পুনরায় নগরবাসীর রায় চান আতিকুল ইসলাম।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Jan 2020, 04:27 PM
Updated : 10 Jan 2020, 05:16 PM

আনিসুল হকের মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে মেয়র হওয়ায় নয় মাসের মধ্যেই আবার ভোটের লড়াইয়ে নামতে হয়েছে আতিককে। তবে তিনি মনে করেন, ওই নয় মাসের অভিজ্ঞতা আরও ভালোভাবে কাজটি করার জন্য তাকে তৈরি করে দিয়েছে।

আনিসুল হকের মতোই ব্যবসায়ী থেকে আচমকা রাজনীতির মাঠে পা রেখেই মেয়র হয়ে যান আতিক। তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী হিসেবে ছিলেন বিজিএমইএর সভাপতি।

সেখান থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়ার পর সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্যে এবারও দল তার উপরই ভরসা রেখেছেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরুর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আতিক বলেছেন তার অভিজ্ঞতার কথা, জানিয়েছেন ঢাকা নিয়ে তার পরিকল্পনা; আশা রেখেছেন এবারও জয়ী হওয়ার।

বিজিএমইএর সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কাজের যে অনেক ফারাক, সেটাও আতিক বুঝেছেন নয় মাস মেয়রের দায়িত্ব পালনেই।

বলেছেন,“যখন বিজিএমইএতে ছিলাম তখন আমি যখন যেটা অর্ডার করেছি, সঙ্গে সঙ্গে সেটাই হয়েছে। কিন্তু আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখানে কাজ করতে সময় লাগে।”

আমলাতন্ত্রের জাল ছিঁড়ে সিটি করপোরেশনকে আরও বেগবান করতে হবে বলে মনে করেন আতিক; অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে একটা ‘কঠিন সমন্বয়’ করার প্রয়োজনও ‍বুঝেছেন তিনি।

আতিক আশা করছেন, তার নয় মাসের কাজ দেখে নগরবাসী আবার তাকে সমর্থন দেবে, জয়ী করবে নৌকাকে।

 

গতিশীল ‘করতে হবে’ নগর কর্তৃপক্ষকে

নয় মাসের কাজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে আতিক বলেন, কাজ করতে গিয়ে আমলতান্ত্রিক জটিলতাকে বাধা হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়া লোকবল সঙ্কট, সনাতন কর্মপদ্ধতি, দুর্নীতি কাজের ক্ষেত্রে বাধা ছিল।

“একুশ শতকে অষ্টাদশ শতকের পদ্ধতিতে কাজ করলে হবে না। ডিএনসিসিকে চলতে হবে ‘সেভেনথ গিয়ারে’। আমি দেখেছি কিছু জিনিস মিসিং। এখনও সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। হোল্ডিং ট্যাক্স খাতায় লিখে লিখে দেওয়া হচ্ছে।”

সিটি করপোরেশনে কিছু জায়গায় ‘একটা বলয়’ও দেখতে পেয়েছেন তিনি।

“আমি বলয় ভাঙার চেষ্টা করেছি, মশার কীটনাশক আমদানিতে ব্ল্যাক লিস্ট করেছি। কিছু কাজ আমি শুরু করেছি। বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প নিরপেক্ষ তদন্ত করতে আমরা তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ করেছি।”

আতিকের মতে, জনগণের প্রত্যাশা অনেক কিন্তু সেই প্রত্যাশার চাপ নিতে সিটি করপোরেশন প্রস্তুত না। এজন্য পুরো কাঠামো ঠিক করতে হবে।

“কেন আমরা শুধু ২ লাখ ৪০ হাজার লোকের কাছ থেকে ট্যাক্স নিচ্ছি। এটার পরিধি কেন আমরা এখনও বাড়াতে পারিনি? সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত, কেউ চিন্তা করে নাই এটাকে আধুনিকায়ন করে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।”

নগরবাসীর সব প্রত্যাশার কেন্দ্রে মেয়ররা থাকেন বলে ৩৩ লাখ ভোটারের ভোটে নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিকে আরও ক্ষমতা দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের এই প্রার্থী।

“এতগুলো লোক যখন কাউকে নির্বাচিত করবে, তখন তাকে কিন্তু সেভাবেই কাজ করতে হবে। বর্তমান ক্ষমতার পরিধি পরিবর্তন করতে হবে প্রয়োজন পড়লে।”

সেটা কীভাবে সম্ভব- জানতে চাইলে আতিক বলেন, “সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। যদি দরকার পড়ে টার্মোলজি চেঞ্জ করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও চাচ্ছেন একটা সুন্দর নগর গড়ে তুলতে। এ কারণে যারা নগরে বিভিন্ন কাজ করবে তাদের কিন্তু মেয়রের কথা শুনতে হবে। তাহলেই একটি সুন্দর নগর গড়ে তোলা সম্ভব হবে।”

প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ‘শুরু হয়েছে’

ডিএনসিসির উপনির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে- জানতে চাইলে আতিক বলেন, ‘যুদ্ধ’ করতে গেলে আগে ক্ষেত্র তৈরি করতেই তার নয় মাস চলে গেছে। তারপরও অনেক কাজ বাস্তবের মুখ দেখেছে।

“আগারগাঁওয়ে সাইকেল লেইন করেছি। আলোকিত ঢাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সে ফাইলটা একনেক থেকে পাস করিয়ে এনেছি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেটা বাস্তবায়ন হবে। জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য কিছু কাজ করেছি, কালসি এলাকায় এখন আর পানি জমে না।”

আতিক স্বীকার করেন, মেয়র হিসেবে তাকে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে ডেঙ্গু।

গত বছরের মতো ব্যর্থতা এড়াতে পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারা বছর মশা নিধনে কাজ করতে ডিএনসিসিতে কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ করা হয়েছে। কীটতত্ত্ববিদরা মশার উৎস, পরিমাণ নির্ণয় করবে। কোথায় কোন ওষুধ কতটা প্রয়োগ করতে হবে, এসব বিষয় নিয়ে সারাবছর কাজ করবে।

এছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে গতি আনতে আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে বলে জানান আতিক।

আবার নির্বাচিত হলে ডেঙ্গু মোকাবেলায় ব্যাপক কর্মসূচি নিতে চান তিনি।

“একটা সমন্বিত মশক নিধন কর্মসূচি চালু করতে চাই। যেখান সংশ্লিষ্ট সবগুলো পক্ষের অংশগ্রহণে মশক নিধন কার্যক্রম চালানো হবে। আমরা ইতোমধ্যেই একটা প্ল্যান করেছি। মেয়র নির্বাচিত হলে অবশ্যই চেষ্টা করব এ ধরনের পরিস্থিতি যেন আর না হয়।”

স্বপ্ন ‘গ্রিন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা’

২০১৯ এর নির্বাচনে প্রয়াত আনিসুল হকের অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার ছিল আতিকের। আনিসুল হকের ছায়া থেকে বের হয়ে নতুন উদ্যোগের বিষয় জানতে চাইলে আতিক বলেন, নির্বাচিত হলে একটি ‘স্মার্ট সিটি’ করার উদ্যোগ নেবেন তিনি। যেখানে মানুষ ঘরে বসে সেবা পাবেন।

“অ্যাপসের মাধ্যমে কোন বাজারে কী দ্রব্যমূল্য তা জানা যাবে। আমাদের সিটি করপোরেশনের বাজারগুলো আমরা এভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা আছে।”

যানজট নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ দূষণ রোধে রাজধানীতে ইলেকট্রিক বাস নামানোর কথাও বলেন আতিক।

“এটা হলে নগরের দূষণ অনেকটাই কমে আসবে বলে আমি আশা করি। আমাদের বাস-বে করতে হবে। এটা আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। বায়ু দূষণ নিয়ে কোনো কাজ করা হয়নি। আমরা বিভিন্ন এলাকায় নয়টি সেন্সর লাগাব। সেখান থেকে কোন কোন জায়গা থেকে দূষণ হচ্ছে, সেটার মাত্রা কি হচ্ছে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক খেলার মাঠ দিয়ে যেতে চান বলে জানান আতিক।

“ক্লিন ঢাকা-গ্রিন ঢাকা করা হবে। ইয়াং জেনারেশনকে ঘর থেকে বের আনতে হবে। এখানেও কাজ করার আছে। পার্কগুলোকে আধুনিকায়ন করব।”

নতুন ওয়ার্ডগুলো নিয়ে ভাবনা

ডিএনসিসির সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে নাগরিক সুবিধা নেই বললেও চলে। এসব ওয়ার্ডের আধুনিকায়নে ‘ব্যাপক পরিকল্পনা’ রয়েছে আতিকের।

তিনি জানান, মেয়র থাকাকালে নগরবিদদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা সাতটি ওয়ার্ডে ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছেন

“সেখানে আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করছি। তারা কি চায় সেটা দেখছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে। একেকটি ওয়ার্ডে আমাদের খেলার মাঠ, ওয়ার্ড কমপ্লেক্স, বাজার থাকবে। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডকে আমরা একটি মডেল ওয়ার্ডে পরিণত করতে চাই। বিশেষ করে রাস্তা, ফুটপাত, নিষ্কাশন নালা এবং সড়ক বাতি প্রথম পর্যায়ে তারা পাবে।”

মেয়র থাকাকালে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল প্রায় চূড়ান্ত করে এসেছেন জানিয়ে আতিক বলেন, “এখন শুধু এটা একনেকে যাবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এটাতে অনুমোদন দেন তাহলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এর কাজ শুরু হয়ে যাবে।”

ইভিএমে আপত্তি নেই

সিটি নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ইভিএম নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেও এতে খারাপ কিছু দেখেন না নৌকার প্রার্থী আতিক।

তিনি বলেন, “পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে , সব কিছু আধুনিকায়ন হচ্ছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট তো পৃথিবীর অনেক দেশেই হচ্ছে। আমরাও ভোট দিই না, দিয়ে দেখি। তারপরও এটা যেহেতু নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার তারা যেটা ভালো করবে সেটাই করবে। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।”

পোশাক রপ্তানিকারক থেকে মেয়র

পুলিশ কর্মকর্তা বাবার ১১ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট আতিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৬১ সালের ১ জুলাই নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে। তার পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায়। আতিকের বাবার নাম মমতাজউদ্দিন আহমেদ ও মায়ের নাম মাজেদা খাতুন।

আতিক বিএএফ শাহীন স্কুল ও কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৮৫ সালে গড়ে তোলেন তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ইসলাম গ্রুপ।

আতিকের বড় ভাই প্রকৌশলী। মেজ ভাই তাফাজ্জল ইসলাম সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় দিয়েছিলেন। ভাইদের তৃতীয়জন সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাঈনুল ইসলাম বিডিআর পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ছিলেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রধান। চতুর্থ ভাই পেশায় প্রকৌশলী ছিলেন, মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়।

আতিকের স্ত্রী শায়লা সাগুফতা ইসলাম পেশায় দন্ত চিকিৎসক। এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে থাকেন উত্তরার নিজের বাড়িতে।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিক থেকে ঢাকার মেয়র হলেন কীভাবে- প্রশ্নে আতিক বলেন, “সময় নষ্ট না করে সততার সঙ্গে কাজ করা এবং এফিসিয়েন্সি দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনীত করেছেন বলে ধারণা করি।”

আবারও মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, “আমি কথায় না, কাজে বিশ্বাস করি। গত নয় মাস সিটি করপোরেশনে ছিলাম, আপনারা সবাই দেখেছেন আমি একটি দিনও সময় নষ্ট করি নাই। তিনি (শেখ হাসিনা) হয়ত এটাই হয়ত বিবেচনায় নিয়েছেন।”