বিদিশার এরশাদ কথন

চল্লিশ বছরের বড় একটা মানুষের সঙ্গে প্রেম, বছর পাঁচেকের দাম্পত্য, তারপর বিচ্ছেদ। সেই বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতাও বড় তিক্ত; তবু বিদিশা সিদ্দিকের চোখে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদই ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক’।

রিয়াসাদ সানভীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2019, 04:27 PM
Updated : 18 July 2019, 04:56 PM

সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের প্রেম নিয়ে গল্পের শেষ নেই। তার সঙ্গে কয়েক বছরের সংসারে কেমন কেটেছে বিদিশার? পরের বছরগুলোই বা কেমন গেছে?

এরশাদের মৃত্যুর পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিদিশা বলেছেন মিষ্টি প্রেম আর বিচ্ছেদের কষ্টের কথা।

এরশাদের ‘প্রবল পুত্র স্নেহের’ কাছে হার মেনে ছেলে শাহতা জারাব এরিককে কাছে রাখার অধিকার ছেড়ে দিতে হয়েছিল বিদিশাকে। এখন এরশাদের অবর্তমানে ছেলেকে নিজের কাছে ফিরে পেতে প্রয়োজনে আইনে লড়াইয়ে যাবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। 

এক সময়ের এই ফ্যাশন ডিজাইনার বলেছেন, “আমি ভাত মাছ রান্না করা মেয়ে মানুষ না। লড়াই করেই এ পর্যন্ত এসেছি। আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করব।”

প্রেম বিয়ে বিচ্ছেদ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক কবি আবু বকর সিদ্দিকের মেয়ে বিদিশার বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর, ব্রিটিশ নাগরিক পিটার উইসনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি লেখাপড়া করেছেন ইংল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর ডিগ্রি নিয়ে ঢাকায় ব্যবসাও করেছেন।

১৯৯৮ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় এক ডিনারে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বিদিশার প্রথম দেখা। পরেরবার দেখা হয় ঢাকার ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে; প্রেমের শুরুটা তখনই। 

সেই প্রেমের জেরেই পিটার উইসনের সঙ্গে বিদিশার বিচ্ছেদ। লন্ডনে এরশাদের সঙ্গে এনগেইজমেন্ট হয় ১৯৯৯ সালে। পরের বছর ঢাকায় হয় বিয়ে।

কিন্তু সেই সংসার টুটে যায় ২০০৫ সালেই। এরশাদের দেওয়া চুরির মামলায় জেলে যেতে হয় বিদিশাকে।

অবশ্য বিদিশার বিশ্বাস, এরশাদের ওই মামলা আর হেনস্তা ছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের ‘ষড়যন্ত্র’।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিএনপি আমলে উনি আমার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটানোর পর রিমান্ডে নেওয়ালেন, জেল খাটালেন। তারপর সন্তান নিয়ে অনেক যুদ্ধ করলাম। পরে আবার সমঝোতাও হলো। 

“কিন্তু পরে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আর আলাপ করিনি। যেহেতু তিনি বিষয়গুলো নিয়ে আমার কাছে মাফ চেয়েছেন।  আমার কাছে তার লিখিতও আছে। সেখানে বলেছেন যা হয়েছে তা ভুলে যাওয়ার জন্য।”

তবু ‘চমৎকার’

বিদিশা বলেন, এরশাদ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা হত। 

“দুজনে দুই বাড়িতে থাকতাম।  এরিক আমার কাছে আসলে ফিরতে দেরি হলে তিনি এসে নিয়ে যেতেন।  আমার আগের সন্তানরা লন্ডন থেকে আসলে বলতেন ওদের প্রেসিডেন্ট পার্কে পাঠিয়ে দাও।  আমার সাথে দেখা করে যাক। চমৎকার একটা সম্পর্ক ছিলো আমাদের। ”

জাতীয় পার্টির একটি সুবিধাভোগী অংশই তাদের একসাথে থাকতে দেয়নি বলে অনুযোগ বিদিশার।

“তারা সব সময় এরশাদের কানে কথা লাগাতো এবং উত্তেজিত করতো।... পরিবেশ আমাদের একসঙ্গে থাকতে দেয়নি, সংসার করতে পারিনি। 

“একটা গ্রুপ, সব সময় তারা চেষ্টা করেছে শেষ দিন পর্যন্ত যাতে আমি তার কাছে না আসতে পারি, তার সেবা না করতে পারি।  শেষ সময় পর্যন্ত আমি অনুরোধ করেছি যাতে আমি তার সেবা করতে পারি।”

১৪ জুলাই এরশাদ মারা যাওয়ার পর কাকরাইলে পার্টি অফিসে যখন শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছিল, পাশেই এক জায়গায় গাড়িতে বসে থাকতে হয়েছে বলে জানালেন বিদিশা।

বললেন, “কাছে যেতে পারিনি; পরিস্থিতি আমার পক্ষে ছিল না।”

 

‘প্রেম যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখে’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এরশাদের অন্য প্রেম আর তার সাবেক প্রেমিকাদের নিয়েও কথা বলেন বিদিশা।

“যখন সংসার করেছি, এগুলো ছিলো ডিস্টার্বিং এলিমেন্টস। যখন সংসার করেছি, তখন বন্ধ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি পারিনি।”

সংসার ভেঙে যাওয়ার পর এরশাদের প্রেম নিয়ে কথা বলার আর কিছু ছিল না বিদিশার। তখন ভাবতে শুরু করেন, প্রেম যদি এরশাদকে ভালো রাখে, সেটাই হবে সান্ত্বনা।

“উনার প্রেম যদি উনাকে বাঁচিয়ে রাখে, উৎসাহ উদ্দীপনা দেয়- সেটা আমার কি, আমার তো কিছু যায় আসে না আসলে।”      

ট্রাস্ট

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ কত টাকার সম্পত্তি রেখে গেছেন, কাকে কতটা দান করে গেছেন, তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।

দলের আরেকজন নেতার ভাষ্য অনুযায়ী, শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত জানুয়ারি মাসে এরশাদ তার সম্পত্তির একটি অংশ সন্তান আর ভাই-ভাতিজাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেন। এরপর এপ্রিলে একটি ট্রাস্ট গঠন করে বাকি সম্পত্তি সেখানে দান করে দেন।

ট্রাস্টে দান করা সম্পত্তির কোনো বর্ণনা জাতীয় পার্টির নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। স্ত্রী রওশন এরশাদ আর ভাই জিএম কাদেরকেও ট্রাস্টি বোর্ডে রাখা হয়নি।

বিদিশার দাবি, তাদের অটিস্টিক ছেলে এরিকের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এরশাদ ওই ট্রাস্ট করে গেছেন। এরশাদ নিজেও ওই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এছাড়া একান্ত সচিব অবসরপ্রাপ্ত মেজর খালেদ আক্তার, চাচাতো ভাই মুকুল এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে তিনি ট্রাস্টি করে গেছেন।

“তিনি যে সব ব্যক্তিকে ট্রাস্টে রেখেছেন, তারা বিশ্বাসযোগ্য বলেই তাদের রাখা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এই ট্রাস্টের অর্থ এরিকের ভরনপোষণে খরচ হবার পর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।”

 

সন্তানের অধিকার

এরশাদের মৃত্যুর পর এখন এরিকের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন বিদিশা। 

তিনি বলেন, এরশাদ বেঁচে থাকতে নিজেই এরিকের দেখাশোনা করতেন। তার পুত্র স্নেহ ছিল প্রবল। এরিককে এক মুহূর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করতে চাইতেন না।

“ছেলে নিয়ে তার সাথে আমার এক সময় লড়াই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেখানে এরশাদের ভালোবাসার জয় হয়েছিল। এখন তার অনুপস্থিতিতে এরিক আমার কাছে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।  অথচ ছেলের সাথে আমি কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।”

এরিকের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়ার পেছনে ‘অপরাজনীতি’ কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন তার মা।

“দল এবং পরিবারের একটা অংশ চায় না আমি এরিক এরশাদের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাদের নাম বলতে চাই না। তবে তাদের এই উদ্দেশ্য সফল হবে না।”

এরিককে পেতে প্রয়োজনে আবার আইনি লড়াইয়ে নামবেন জানিয়ে বিদিশা বলেন, “ওর নিউরোলজিক্যাল সমস্যা আছে, পায়েও সমস্যা আছে। ঠিকভাবে হাটতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা- সে একজন অটিস্টিক শিশু।

“এরশাদ সাহেব এরিককে একদম কাছ ছাড়া করতেন না। এখন তার অনুপস্থিতিতে এরিক তার মায়ের কাছে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”