“সরকার ক্ষমতাচ্যুত হল, কিন্তু পদ্ধতির পরিবর্তন জনগণ দেখে নাই। আকাঙ্ক্ষা পূরণের পদক্ষেপও জনগণ তিন মাসে খুব বেশি লক্ষ্য করে নাই।”
Published : 08 Nov 2024, 09:02 AM
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ যেভাবে চলছে, তাতে ‘নাখোশ’ বামপন্থি দলগুলো। ‘মানুষ আশাহত হচ্ছে’ বলেও সতর্ক করেছেন একাধিক নেতা।
ছোট ছোট জমায়েতে এসব বক্তব্য তুলে ধরা হলেও সংবাদ মাধ্যম সেগুলো তুলে ধরছে না- এমন অভিযোগও এনেছেন একজন।
তাদের বক্তব্যের সারবত্তা হল, সরকারের ‘সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই’, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধেও তারা ‘ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে’। এ কারণে মানুষের আস্থায় চিড় ধরছে, ফলে সাবেক সরকারের কথা তাদের মনে পড়ছে।
রাজনৈতিক সংস্কার নির্বাচিত সংসদ করবে- বিএনপির পক্ষ থেকে আসা এমন বক্তব্যেও একমত বামপন্থি বেশ কয়েকটি দল। তারাও মনে করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত। অন্তত নির্বাচন কবে হবে, সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে চায়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য তারা চান।
পোশাক শ্রমিকদের জন্য আন্দোলনে করে আলোচিত হওয়া বামপন্থি নেত্রী মোশরেফা মিশু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার বলুক যে, ‘আমি এই এই কাজ করতে চাই, এজন্য আমার এতদিন দরকার, এত দিন পরে নির্বাচন দেব, নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাব।’ কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার এই বিষয়ে কোনো অবস্থান দেশবাসীর কাছে তারা তুলে ধরলেন না।
“সরকারকে অবিলম্বে বলতে হবে, কতদিন থাকবে এবং এই সময়ে কী করবে। কিন্তু উপদেষ্টা হাসান আরিফ সাহেব বলেছেন চার বছর ক্ষমতায় থাকা দরকার। আর সেনাবাহিনীর প্রধান বলেছেন দেড় বছর। মানুষ তো চায় স্পষ্ট করে বলুন।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকে বামপন্থি দলগুলো রাজনীতিতে গুরুত্ব বহন করলেও গত পাঁচ দশকে তাদের গুরুত্ব কমেছে। ভোটের রাজনীতিতে অবস্থান হারানোয় বড় দলগুলোও তাদের বক্তব্য ও অবস্থানকে সেভাবে পাত্তা দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানেও পাল্টায়নি এই চিত্র।
একটি প্রবল গণ আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। সরকার পতনের আন্দোলনে বাম-ডান বিভিন্ন পক্ষই এক বৃন্তে এসেছিল। নিজেদের মধ্যে ঐক্য না হলেও সবার দাবি ছিল একই।
গত ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর পর তিন মাসে সরকারপ্রধান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একাধিকবার যে সংলাপ করেছেন, তাতে বাম নেতারাও অংশ নিয়েছেন। কিন্তু সংলাপে তারা যেসব কথা বলে এসেছেন, তার খুব একটা প্রতিফলন দেখেছেন এমন না।
মানুষের জীবনে ‘শান্তি ফিরে আসেনি’
বামপন্থি দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে, তাদের জীবনে শান্তি ফিরে আসেনি, এর জন্য আমরা রাজপথে আছি। সরকার যদি জনগণের আশা পূরণ না করে, আমরা অন্যান্য শক্তিকে নিয়েই আরও সংগ্রাম করব।”
তাহলে কথাগুলো সেভাবে কেন সামনে আসছে না, এই প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমকে দায়ী করেন সিপিবি নেতা।
তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিন যে আন্দোলন করি এটা আপনারা (গণমাধ্যম) প্রচার করেন না বলে মানুষ জানে না।
“সেদিনও দ্রব্যমূল্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছি, সারা দেশেই বিক্ষোভ করলাম। আমরা এই সরকারকে বলেছি, ‘আপনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন, কিন্তু সেটা করেন নাই’।”
‘ব্যবস্থা বদল’ ছাড়া মানুষের মুক্তি হবে না মন্তব্য করে প্রিন্স বলেন, “সেটি আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে আশাও করি না। আগামীতে যদি একটি ভালো ভোট হয় আমরা অংশ নেব, যদি জনগণ বাম পন্থা এবং প্রগতিশীল নীতির শক্তিকে নির্বাচিত করে, কেবল তারাই বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবে। সেটা যদি না হয় এরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাংলাদেশ অনেক দিন চলবে বলে আমার ধারণা।”
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও একইভাবে কথা বলে গেছেন বলে প্রিন্সের ভাষ্য।
তিনি বলেন, “আমরা ২০১২ সালের পর থেকে লড়াই করেছি। ২০১৪ ও ২০১৮ নির্বাচনের পরে আমরাই প্রথম বিক্ষোভ করি, কালো পতাকা মিছিল করি। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে আমরা আন্দোলন করছি।”
‘পরিবর্তন দেখেন না’ রাজেকুজ্জামান রতন
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসের মূল্যায়ন করে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতনও কিছুটা হতাশ।
তিনি বলেন, “সরকার ক্ষমতাচ্যুত হল, কিন্তু পদ্ধতির পরিবর্তন জনগণ দেখে নাই। আকাঙ্ক্ষা পূরণের পদক্ষেপও জনগণ তিন মাসে খুব বেশি লক্ষ্য করে নাই।”
নতুন সরকারের ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ পদক্ষেপ না দেখে জনগণের মধ্যে ‘নানা সন্দেহ’ ঘনীভূত হচ্ছে মন্তব্য করে রতন বলেন, “আবার যে ইস্যুগুলো সামনে আসা দরকার ছিল, সেগুলো সামনে না এসে এমন কিছু ইস্যু সামনে আসছে। এ কারণে জনগণের কাছে মনে হচ্ছে, ‘আমরা যে উদ্দেশ্যে জীবন দিলাম, যে উদ্দেশ্যে সংগ্রাম কলাম, বা ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারকে সরালাম কিন্তু ‘ফ্যাসিবাদী’ ব্যবস্থাগুলো পরিবর্তনের কিছু হয়নি।
“আকাঙ্ক্ষা ছিল অনেক। কিন্তু আমরা নানা ধরনের ইস্যুর জালে আটকা পড়ে যাচ্ছি। মূল কাজ ব্যাহত হচ্ছে, বিলম্বিত হচ্ছে, এটা নিয়েও একটা সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।”
রতন বলেন, “আমরা বাম জোটের পক্ষ থেকে কয়েকটা সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করেছি। এই মুহূর্তে প্রধান বিষয় হচ্ছে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আর অন্তর্বর্তী সরকারের একটা নির্বাচনি রোডম্যাপ। এই রোডম্যাপ থাকলে আমরা বুঝতে পারব তারা কী করতে চায় এবং কত দিনে করতে চায়। একটা নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে দায়িত্বটা দেওয়া হোক।”
সরকার যেন ‘পথ না হারায়’
অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়নে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও কয়েকটি ছোট দল নিয়ে গঠন করা ‘গণতন্ত্র মঞ্চের’ নেতা সাইফুল হকের বক্তব্য সোজাসাপ্টা নয়।
তিনি বলেন, “সরকার চেষ্টা করছে, কিছু ভালো কাজ সরকারে আছে, তবে সাফল্যের সাথে এগোতে পারছে, এ রকমও না। তবে আমরা চাইব সরকার যেন সফল হয়; ব্যর্থ হবে এটা আমরা নিশ্চয় চাইব না।
“সরকার যেন পথ না হারায়, বিভ্রান্ত না হয়, যেন কোনো ধরনের বিতর্কের মধ্যে না পড়ে, সেই সতর্কতা আমরা দিচ্ছি।”
অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিপূর্ণভাবে সমর্থন দেওয়ার কথা তুলে ধরে সাইফুল হক বলেন, “এটা তো আমাদেরই সরকার। আমাদের আন্দোলনের কারণেই অভ্যুত্থানের পর এই সরকার এসেছে। একই সাথে আমরা সরকারকে বলছি তারা যেন পথ না হারায়।”
সরকারের পথ হারানোর প্রসঙ্গ কেন এল সে বিষয়ে সাইফুল হকের মন্তব্য এমন: “দ্রব্যমূল্যটা সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করা লাগবে। জনজীবনে শান্তির স্থিতি এবং নির্বাচনটা এই সরকারের বড় অ্যাসিড টেস্ট। এই জায়গাটায় তারা কীভাবে করবে এটা গুরুত্বপূর্ণ।”
‘মানুষ তো অনির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করবে না’
গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিও সরকারের প্রতি সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন এই বলে যে, “মানুষ তো অনির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করবে না।”
সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে কি না, সেই আলোচনা যখন একটু একটু করে উঠতে শুরু করেছে, তখন সাকি এর দায় দেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারকে। একই সঙ্গে নতুন সরকারকেও যে ‘করে দেখাতে হবে’, সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে গণসংহতি আন্দোলনের নেতা বলেন, “বিগত সরকারের ফল হিসেবে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে কিছু কিছু সাফল্য আছে, তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও জোরদার ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
“প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। এখন তাকে পুনর্গঠনের কাজ আছে। এটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের দৈনন্দিন রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের ‘গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ ঘটিয়ে নতুন নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে দায়িত্ব তারা পালন করছে সেখানে আমরা তাদের সমর্থন করি, সহযোগিতা করি। আবার যেসব জায়গায় ব্যর্থতা চোখে পড়ছে, সেগুলোর সমালোচনা করছি, দেখিয়ে দিচ্ছি।
“দুটো কাজই করব। সমর্থন করছি মানে এই না যে আমরা সরকারের প্রতি ‘অন্ধ’ থাকব। আবার সমালোচনা করছি, তার মানে এই না যে আমরা সরকারের প্রতিপক্ষ।”
‘এভাবে চললে হতাশা থেকে অস্থির হবে মানুষ’
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু বলেন, “নতুন সরকারের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি থাকে। সে জন্যই মানুষ সংগঠিত হয়ে সরকারের কাছে দাবিনামা পেশ করছে।”
যে প্রত্যাশা ছিল, তিন মাস ছুঁই ছুঁই সময়ে তা পূরণ হয়েছে কি না, এই প্রশ্ন নিজেই করে শ্রমিক নেত্রী বলেন, “নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ‘সিন্ডিকেট’ কি আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন? তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন কি?
“ঢাকা শহরের মত জায়গায় ডাকাতি হচ্ছে, চুরি হচ্ছে, দিনে দুপুরে ছিনতাই হচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলেন না, আমি মনে করি জনগণের প্রত্যাশা বড় আঘাত পেয়েছে। এ রকম চলতে থাকলে আর কয়েক মাস পর মানুষ বিক্ষুব্ধ হবে, হতাশ হবে। মানুষ তো অস্থির হয়ে যাবে।”
পোশাক শ্রমিকদের ওপর গুলির ঘটনাতেও ক্ষুব্ধ মিশু। তিনি বলেন, “আমরা বারবার বলছি এমন কোনো আচরণ করবেন না যেটা আগের সরকারে কথা মনে করিয়ে দেবে। আগের সরকারের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছি, এমন কোনো কাজ করবেন না।”
বাংলাদেশের মানুষ ‘জেগে উঠতে শিখেছে’ বলেও সতর্ক করেন মিশু। তিনি বলেন, “এই তরুণরাই বারবার বলছে ‘আমরা রাস্তাতেই আছি’। যদি তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হয়, শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে যদি তাদের উপর গুলি চালানো অব্যাহত থাকে, তাহলে তো অবশ্যই তারা হতাশ হবে, আমরা আশাহত হব, দেশবাসীর আশা ভঙ্গ হবে।”