Published : 06 May 2025, 08:27 PM
নানা বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যে রাষ্ট্র সংস্কারকে ‘অনিশ্চয়তায় ফেলা হচ্ছে’ বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি– এনসিপি।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের সামনে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের বিষয়ে কতটুকু সংস্কার… এ সময়টুকুর মধ্যে করতে হবে, সেই বিষয়ে নানা ধরনের মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে এবং সংস্কারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হচ্ছে।
“সেই জায়গায় জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা আমরা ঐকমত্য কমিশনে জমা দিয়েছি। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে সামনের যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন যোগ্য এবং বাস্তবায়নের যে পন্থাগুলো আছে, সে ব্যাপারে একমত হওয়ার কথা আমরা তুলে ধরেছি।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি আমাদের বক্তব্য হলো, সংস্কারকে কোনো বায়বীয় তত্ত্বের মধ্যে অপ্রয়োগযোগ্য অবস্থায় ফেলে রাখার পক্ষে আমরা নই। বরং বাংলাদেশের ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে মাথায় রেখে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে ঢেলে সাঁজাতে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, যেগুলো আমরা আমাদের এনসিপির রূপরেখার মধ্যে হাজির করেছি।
“সে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা হতে পারে, সেগুলো অবশ্যই বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সামনের নির্বাচনের দিকে আমরা অগ্রসর হতে পারি।”
ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক বলেন, “আগে বলেছিলেন সংবিধান পুনর্লিখন, এখন বলছেন সংবিধান সংস্কারের কথা, আর সেটা কবে চান? নির্বাচনের আগে, নাকি পরে?”
জবাবে এনসিপির সদস্য সচিব বলেন, “দেশের বর্তমান সংবিধান স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোতে ভরপুর। এর বাইরে এসে নতুন সংবিধানের কথা বলে এসেছি। সেই সংবিধানকে বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, একটি গণপরিষদ গঠন করে তাদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব যা থাকবে, তার মধ্য দিয়ে নতুন করে সংবিধান লেখা প্রয়োজন। সে জন্য অবশ্যই রাজনৈতিক ঐকমত্যের দরকার রয়েছে, সেসব বিষয় আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করব।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ এনসিপি নেতা বলেন, “এনসিপি মনে করে, বিচার এবং সংস্কার কাজের দৃশ্যমানতায় সরকারের আন্তরিকতা থাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা থাকে, তাহলে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের যে কথা বলেছেন, তার মধ্যেই সেটাকে সামনে আনা এবং নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
“নির্বাচনের ব্যাপারে এনসিপি মনে করেন, নির্বাচন যেকোনো সময় হতে পারে, তবে আগে মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা, সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন এবং গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচারকে দৃশ্যমান পর্যায়ে নিয়ে আসার দিন থেকে অল্প দিনের মধ্যেই এনসিপি নির্বাচনের আয়োজনের জোর আরোপ করেছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে পেশিশক্তিনির্ভর রাজনীতি চলছে, সেই পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতি থেকে বের হয়ে পলিসিনির্ভর রাজনীতি যেন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেজন্য আমরা ছায়া মন্ত্রিসভার কথা বলেছি। সংসদীয় যে যে স্থায়ী কমিটিগুলো আছে, সেগুলোয় সুনির্দিষ্ট ছায়া মন্ত্রিসভার কার্যক্রম কী হতে পারে, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
“সংসদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটি, যেমন পাবলিক অ্যাকাউন্স কমিটি, পরিকল্পনা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির প্রধান বিরোধী দল থেকে হতে হবে। অন্যান্য জায়গায়ও যেন এই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ক্ষমতার এ ভারসাম্য আমাদের দেশ সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য খুব প্রয়োজন।”
তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের আগে ‘নির্বাচনকালীন’ যোগ করার প্রস্তাব দেওয়ার কথা তুলে ধরে আখতার বলেন, “বর্তমানে আমরা যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে নামই দেওয়া হোক, তার আগে যেন নির্বাচনকালীন শব্দ যোগ করা হয়, যেন সেই সরকারের দীর্ঘ সময় থাকার যে মানসিকতা, সেটা কমে আসে এবং তাদের যেন শুধু নির্বাচনের ব্যাপারেই ফোকাসটা থাকে।”
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা তুলে ধরে দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, “আমরা বিগত সময়ে দেখে এসেছি, রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এবং অন্যান্য বিভাগে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করত। সেই জায়গায় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহিতায় রাখার কাজ করবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার কাজ করবে।”
নিজেদের দেওয়া প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সংসদ সদস্যরা সংসদে তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারবে, সরকারের স্থিতিশীলতা যেন রক্ষা হয়, সেখানে সাংবিধানিক একটা ব্যবস্থা থাকবে। ভোটারদের বয়স যেন ১৬ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রার্থীর বয়স যেন ২৩ হয়। তথ্য প্রাপ্তির যে অধিকার এটাকে যেন মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রধান করা হয়। ক্ষমতায়ন এবং প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে আমরা সরাসরি ১০০ আসনে নারী সংসদ সদস্যের কথা বলেছি।
“মৌলিক অধিকারবিরোধী দমনমূলক আইন ও সংবিধানের ৩৩(৩) অনুচ্ছেদ সংস্কার ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের কথা আমরা বলেছি।”
সারজিস বলেন, “নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়ে আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে থাকতে পারবেন, দলনেতা প্রধনমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে, এটাও আমরা তুলে ধরেছি। বিভাগীয় শহরগুলোতে হাই কোর্টের স্থায়ী আসন স্থাপন করার বিষয় তুলে ধরেছি।
“দুদককে রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার বানিয়েছে, দুদককে যেন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সরকারি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যারা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা দায়েরের স্বাধীনতা দুদকের ছিল না। তাই আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে ৩২(ক) ধারাটি বাতিল করার কথা বলা হয়েছে।“
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া বাতিল করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সারজিস বলেন, “এ প্রক্রিয়ার কারণে ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ দলীয় ট্যাগ লাগাতে হবে বলে রাজনীতি থেকে সরে গেছেন।
“জনপ্রশাসনের ক্ষেত্রে আমরা আলাদা সংস্কারের প্রস্তাব করেছি। নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণ আইন প্রণয়নের কথা বলেছি।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির এই সংলাপ শুরু হয় ১৯ এপ্রিল। সেদিনের আলোচনার পর সংলাপ মুলতবি হয়।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার, জাভেদ রাসিন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম এ সংলাপে অংশ নেন।
মঙ্গলবারের সংলাপে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে অন্যদের মধ্যে কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান এবং মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন
ইসিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দায়বদ্ধ করার প্রস্তাব
এনসিপির রূপরেখা গণতান্ত্রিক পথরেখায় 'সহায়তা করবে': আলী রীয়াজ