“গত ২২ জুন ভারতের সঙ্গে সমঝোতার আড়ালে যে সকল চুক্তি করা হল, তা বাংলাদেশকে আজীবনের জন্য ভারতের গোলামে পরিণত করবে”, বলেন তিনি।
Published : 30 Jun 2024, 09:34 PM
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে একে ‘গোলামির নবতর সংস্করণ’ অভিহিত করেছে বিএনপি। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে বলেও মনে করে তারা।
রোববার বিকালে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই সমঝোতার বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরে এই মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতার সব কিছু জনসম্মুখে প্রকাশের দাবিও জানান বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, “কানেকটিভিটি নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশ পর্যন্ত রেল যোগাযোগের নামে করিডোর প্রদানের মাধ্যমে যা করা হয়েছে তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
“গত ২২ জুন ভারতের সঙ্গে সমঝোতার আড়ালে যে সকল চুক্তি করা হল, তা বাংলাদেশকে আজীবনের জন্য ভারতের গোলামে পরিণত করবে।”
স্বাক্ষরিত সমঝোতা বা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যূনতম স্বার্থ ‘সুনিশ্চিত করে না’ মত দিয়ে তিনি বলেন, “সামরিক সহযোগিতার নামে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির অন্যান্য চুক্তি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মত অধিকতর কৌশলগত পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা করে তোলার চলমান উদ্যোগ দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে।”
এসবে চুক্তি জনগণ কখনও ‘মেনে নেবে না’ মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “বিএনপি এই সকল দেশবিরোধী চুক্তি-সমঝোতা প্রত্যাখান করছে।”
গত ২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে, সমুদ্র সহযোগিতা, মহাকাশ সহযোগিতা, রেলওয়ে সংযোগ, মিলিটারি শিক্ষা সহযোগিতা।
স্বাস্থ্য ও ওষুধ সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মৎস্য খাতে সহযোগিতা নবায়ন করা হচ্ছে।
দেশের জন্য বিপজ্জনক
ফখরুল বলেন, “বস্তুত এই সকল সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নিরাপত্তার কৌশলগত ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ দিতে চায়। এর ফলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে।”
যে ৭টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবগুলোই দেশের উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রয়োজনের সময়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’কে বাইপাস করে ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা থেকেই এসব চুক্তি করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
“দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের ‘গোলামি চুক্তির’ গভীর ফাঁদে ফেলার সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের লিপ্ত হয়েছে।”
‘দেশের প্রাপ্তি শূন্য’
ভারতের সঙ্গে এসব সমঝোতায় বাংলাদেশের ‘প্রাপ্তি শূন্য’ দাবি করে ফখরুল বলেন, “দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের চাইতে ‘ভারতের কাছে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকে’ এসব স্মারক সই হয়েছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট। এগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা নেই।”
ভারত ঘোষিত সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের লাইন অব ক্রেডিট বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়নি দাবি করে বিএনপি নেতা বলেন, “ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে উঠে এসেছে আলোচনায়, অথচ বাংলাদেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের অন্যতম প্রধান মুদ্রাই হচ্ছে মার্কিন ডলার।
“এভাবে একতরফা আগ্রাসী বাণিজ্যে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করা হয়েছে। ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার পরিহার করে বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি কাটিয়ে উঠার কিছুই এসব সমঝোতায় স্থান পায়নি।”
‘তিস্তা চুক্তি হল না’
তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়টি সরকার প্রধানের সফরে আলোচ্য বিষয়েই ছিল না দাবি করে ফখরুল বলেন, “অথচ এটাই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
“২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর গত ১৪ বছরে তিস্তা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হলেও এই সংকটের সমাধান হয়নি। এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে তিস্তা পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণ করা হল। প্রশ্ন হল, যাদের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে তিস্তার ন্যায্য পানি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে, সেই তাদেরকেই তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত করলে তা যে স্বার্থ সাংঘর্ষিক ও আত্মঘাতী, সেটা দেশের মানুষ বোঝে।”
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ‘স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার’ সরকার প্রকারান্তরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উপর ‘অর্পণ করেছে’ বলেও মন্তব্য করেন ফখরুল। বলেন, “যা বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির বহিঃপ্রকাশ।”
‘ভারত যদি তিস্তা প্রজেক্টটা করে দেয়, তাহলে আমাদের সব সমস্যাই তো সমাধান হয়ে গেল’ বলে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের জবাবে বিএনপি নেতা বলেন, “তিস্তার পানি অভাবে পর্যদুস্ত অসহায় মানুষের আর্তনাদকে প্রধানমন্ত্রী ‘প্যাঁ প্যাঁ’ বলে আখ্যায়িত করে ‘উনি সমগ্র জাতির সঙ্গে তামাশা ও হাস্যরস করেছেন’।”
সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গ
ফখরুল বলেন, “বিএসএফের গুলিতে প্রতিবছর রেকর্ড পরিমাণ সীমান্ত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরেও প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্তভাবে নির্লিপ্ত থেকেছে।
“ভারত-নেপাল, ভারত-চীন ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও এই পরিমাণ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে অহরহ সীমান্তে হত্যা হচ্ছে।”
‘চুক্তি-সমঝোতা জনসমক্ষে প্রকাশ করুন’
‘ঢাকা ও দিল্লি নতুন যাত্রা শুরু করেছে, উভয় দেশ দেশ রূপকল্প ২০৪১ ও ভারত ২০৪৭ অনুসরণ করে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য নিয়েও প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, “এই বক্তব্যের মাধ্যমেই তার (প্রধানমন্ত্রী) ভারত সফরের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে যা দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে।
“আমরা এই সফরসহ ভারতের সঙ্গে ইতিপূর্বে স্বাক্ষরিত সকল চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।”
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ ও জহির উদ্দিন স্বপন উপস্থিত ছিলেন।