“রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যদি এই মুহূর্তে একটি উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে এই অল্প সময়ে এখনও সম্ভব,” বলছিলেন এক বিশ্লেষক।
Published : 13 Nov 2023, 12:26 AM
নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিরোধের মীমাংসা বা সমঝোতার চেষ্টায় এর আগে নানা সময় দেশি-বিদেশি উদ্যোগ থাকলেও এবার সেই উদ্যোগ নিচ্ছে না কোনো পক্ষ।
তফসিল ঘোষণার আগে আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ, তাতে দুই পক্ষের অবস্থান পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে। তাদের মধ্যে সমঝোতার দৃশ্যমান কোনো চেষ্টা নেই।
তবে মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সবাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের স্বার্থে ‘ছাড় দিয়ে’ সমঝোতার তাগিদ দিয়েছেন।
একজন নির্বাচন বিশ্লেষক বলছেন, কোনো দেশে রাজনৈতিক সংকট থাকলে সরকারি দলের পক্ষ থেকেই সমঝোতার উদ্যোগ আসা উচিত।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে বিরোধী দলকে ‘গণভবনে চায়ের আমন্ত্রণ’ জানালে বিরোধীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর তিনি কোনো রকম সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারের আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের তত্ত্বাবধায়কের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা এলেই কেবল সংলাপ হতে পারে, নইলে নয়। এরপর সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো শর্ত না থাকলে তারা বসতে রাজি।
তবে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি-পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ এবং এরপর প্রথমে হরতাল ও পরে টানা অবরোধের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আগে এখন সেই সংলাপ প্রসঙ্গ বলতে গেলে হারিয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিলুপ্ত ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক ড. আব্দুল আলীম যদিও রাজনৈতিক সমঝোতা নিয়ে খুব আশাবাদী নন। তবে তিনি এও মনে করেন, ‘রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যদি কোনো শুভবুদ্ধির উদয় হয়, কোনো অলৌকিক কিছু হয়…।”
১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগের পরিবেশ তুলে ধরে এই বিশ্লেষক বলেন, “তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিন্তু সংবিধানের অংশ ছিল না। দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ওই সরকার গঠন করা হয়েছিল। এখন এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসতে হবে।
“এই সদিচ্ছাটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সবার মধ্যে এই ধারণা নিতে হবে যে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন তারা চায়। অর্থাৎ, একটা দলকে দাওয়াত দিতে হবে যে, আসুন আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিই, দেশটা তো আমাদের। অন্যদেরও সাড়া দিতে হবে যে, তারাও বসতে চায়।”
কিন্তু বিরোধ এখন যে পর্যায়ে, তাতে এ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যদি এই মুহূর্তে একটি উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে এই অল্প সময়ে এখনও সম্ভব।
“এক্ষেত্রে উদ্যোগটা সামনাসামনি, খোলামেলা অথবা দরজার পেছন দিয়েও হতে পারে। কিন্তু সমঝোতাটা জরুরি প্রয়োজন।”
মানবাধিকার কর্মী ও নারী নেত্রী খুশী কবির বলেন, “জনগণ এখন জিম্মি হয়ে আছে। তাদের কিছু করার নাই। …বিরোধী দল তাদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য হরতাল-অবরোধ দিচ্ছে, কিন্তু সাধারণ জনগণকে তো তাদের কাজ করতে হবে। তো ক্ষতি তাদেরই হবে।”
অতীতের সব চেষ্টাই ব্যর্থ
১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ, ২০০৬ সালের বাতিল হওয়া নবম এবং ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোষ্ঠী দূত পাঠিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। তবে কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি।
এবার যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলাদা ভিসা নীতি ঘোষণা করে বলেছে, যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে, তাদের ও স্বজনদের ভিসা দেওয়া হবে না। বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ‘যা যা করার দরকার, তাই করার’ কথাও বলা হচ্ছে।
ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনার সারাহ কুক আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাদা কথা বলেছেন। গত ৩ নভেম্বর তিনি বসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের সঙ্গে। কিন্তু হাই কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি।
১৯৯৪ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও সংসদে থাকা অন্যান্য বিরোধী দলগুলো আন্দোলনে নামে, তখন সমঝোতার চেষ্টায় বাংলাদেশে আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান।
তিনি দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। সে সময় সরকারে থাকা বিএনপি নির্বাচনে অনড় ছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদের বর্জনের মধ্যেই নির্বাচন হয়।
ভোট হয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের মুখে একটি অধিবেশনই বসে। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজনের পর পদত্যাগ করে বিএনপি সরকার। ওই বছরের ১২ জুন আবার নির্বাচন হয়। ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
২০০৬ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের আগে আগে বিরোধ তৈরি হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, সে প্রশ্নে। বিএনপি সরকার সে সময় বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়ার পর সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের ওই দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা তৈরি হয়। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতির ওই দায়িত্ব পাওয়ার কথা।
কিন্তু এক সময় তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পদক ছিলেন- এই যুক্তি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ তাকে না মেনে আন্দোলনে যায়। সঙ্গে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি এবং বামপন্থি দলগুলো।
ওই সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগে কে এম হাসান জানান, তিনি ওই পদ নিতে আগ্রহী নন। তখন জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব নেন।
রাজনৈতিক বিরোধের সেই সময়ও ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনরারা দুই পক্ষের সঙ্গে বার বার বৈঠক করেন।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি আরও একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, সে সময় ১১ জানুয়ারি হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়েন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ফখরুদ্দীন আহমেদ।
প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয় পায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট।
বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট আবেদনের নিষ্পত্তি হয় মহাজোট সরকারের আমলে। ২০১১ সালে উচ্চ আদালত জানায়, এই ব্যবস্থা অসাংবিধানিক।
এরপর নির্বাচিত সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা ফিরিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় সংসদে।
ওই সংশোধনী না মেনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে আন্দোলনে যায় বিএনপি-জামায়াত জোট।
সে সময় সমঝোতার চেষ্টায় বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ- তারানকো। তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পক্ষ ছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত এবং ভারাত ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তার উদ্যোগ সফল হয়নি। শেষমেশ বর্জন, সংঘাত, সহিংসতার মধ্য দিয়ে ভোট হয়। আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে।
‘দায়িত্ব বেশি সরকারের’
নির্বাচনী বিশ্লেষক আব্দুল আলীম চাইছেন, সমঝোতার উদ্যোগটা সরকারই নিক।
তিনি বলেন, “যখন এমন জটিলতা সৃষ্টি হয়, তখন সরকারি দলকে উদ্যোগ নিতে হয়। আমরা সারা পৃথিবীতেই এটা দেখেছি।
“এক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। আরেক দলকে সাড়া দিতে হবে। যার যার অবস্থানে অনড় থাকলে হবে না। সেটা গণতন্ত্র না। রাজনীতি ও নির্বাচন তো গণতন্ত্রর জন্য। এটা রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।”
‘গোঁ ধরে থাকলে হবে না’
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, “আমার প্রত্যাশা, নির্বাচনের বিষয়ে সুষ্ঠুভাবে সবাই একমত হোক। সেখানে যদি সবাই গোঁ ধরে বসে থাকে যে, ‘আমরা কেউ নড়ব-চড়ব না’, তাহলে তো হবে না।
“সবার অংশগ্রহণে সমাধান হতে হবে। কিন্তু কেউ যদি নিজের দাবিটাই ধরে রাখে, কারও কথা কেউ শুনবে না, সমাধান চাইবে না– তাহলে তো এখানে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটার কোনো সমাধান হবে না।”
রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “সরকার হোক বা বিরোধী দল হোক– আসলে তারা কতটুকু ভালোভাবে আলোচনা করতে চাচ্ছে, সেটা দেখার বিষয়। মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। কিন্তু সেখানে আমি যদি নিজের দাবি ছাড়া অন্য কিছু আলোচনা না করি, সেটা তো হয় না।”
ফের একতরফা নির্বাচন?
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না। তার মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিভক্তি সেখানে সমঝোতার কোনো ‘আশাই নেই’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটজমকে তিনি বলেন, “সে রকম পরিবেশ– যে সংকেতগুলো আমরা দেখতে পাই, তাতে ওই আশার আলো এখনও জ্বলেনি।
“আমাদের দলগুলো সমঝোতায় আসতে পারে না। অতীতের ইতিহাস থেকে বলা যায়, আগামী দিনেও আসতে অনেক সময় লাগবে। নির্বাচনের আগে এখন যে সময় বাকি আছে, সেই সময়ে এটি সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।”
তিনি বলেন, “একপক্ষের সুবিধা পাওয়ার জন্য অপরপক্ষকে তা মানতে হবে। অপরপক্ষের শক্তি থাকলে সে মানবে কেন? আমরা সেই অবস্থাটাই দেখছি।”
আব্দুল আলীমের আশঙ্কা, নির্বাচনমুখী ও নির্বাচনবিমুখ দুটি রাজনৈতিক বলয়ের বিরোধিতা আরও তীব্র হবে তফসিল ঘোষণার পর।
তিনি বলেন, “যদি তফসিল ঘোষণা হয় এবং তারা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে, তাহলে যে সহিংসতা এখন সারা দেশে আছে, বাস পোড়ানোসহ যে ঘটনাগুলো ঘটছে– সেগুলো আরও বেড়ে যাবে।
“এই অবস্থা যদি হয়, তাহলে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, নির্বাচন পর্যন্ত এই সহিংসতা গড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। সরকারি দল হয়ত চেষ্টা করবে এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করার। কিন্তু আমার মনে হয়, এই আন্দোলনে যারা আছে, তারা চেষ্টা করবে এটাকে ধরে রাখতে।”
`শক্তির লড়াইয়ে’ দুই দল
রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যেও দুই প্রধান দলের নেতাদের মধ্যে সমঝোতায় আসার কোনো আগ্রহ নেই।
বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা বা সংলাপের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কীসের সমঝোতা, কীসের সংলাপ, কার সঙ্গে সংলাপ? বিএনপি তো ‘সন্ত্রাসী দল’। যারা আন্দোলনের নামে সহিংসতা করে, গাড়ি পোড়ায়, ভাঙচুর করে, মানুষ হত্যা করে তাদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা নয়।"
একই প্রশ্নে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, রাজপথই সমাধানের একমাত্র পথ। যত ‘দমনপীড়ন’ করুক না কেনো আমাদের
কর্মসূচি চলবে। যতক্ষণ আমাদের দাবি পূরণ না হবে ততদিন পর্যন্ত আমরা আন্দোলনে রাজপথেই থাকব।”