“পূর্ব পাকিস্তন খাবার-দাবার খাওয়ায় আর ওরা (পশ্চিম পাকিস্তান) শুধু দুধ দোয়ায়। এ রকম নানা ধরনের পোস্টার-লিফলেট ছয় দফার ব্যাখ্যা দিয়ে করা হয়েছিল।”
Published : 07 Jun 2024, 09:19 PM
পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-লুণ্ঠন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ছয় দফার মূল কথা ছড়িয়ে দিতে ‘গরুর পোস্টারে’ যেভাবে বৈষম্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা স্মরণ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার বিকালে তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ছয় দফা দিবসের আলোচনা সভায় বিষয়টি তুলে ধরে পাকিস্তান আমলে শোষণের কথা বর্ণনা করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ আয়োজিত এ সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ছয় দফার যে পোস্টার, একটা পোস্টারের কথা বলি। যেমন- একটা গরু, তার বুকটা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে আর পেছনটা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তন খাবার-দাবার খাওয়ায় আর ওরা (পশ্চিম পাকিস্তান) শুধু দুধ দোয়ায়। এরকম নানা ধরনের পোস্টার-লিফলেট ছয় দফার ব্যাখ্যা দিয়ে করা হয়েছিল।”
শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম ত্বরাণ্বিত করার ভিত্তি হিসেবে ছয় দফাকে ‘ম্যাগনা কার্টা’র সঙ্গে তুলনা করে সরকারপ্রধান বলেন, “আপনারা জানেন, এই ছয় দফাই ছিল বাঙালি জাতির জন্য ম্যাগনা কার্টা, এই ছয় দফার মধ্য দিয়েই আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা।
১২১৫ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জুলুম-বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে ইংল্যান্ডের রাজা জন স্বাক্ষরিত একটি দলিল ‘ম্যাগনা কার্টা’ সনদ নামে পরিচিত, যাকে সাধারণ মানুষের অধিকার সমুন্নত করার সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিও বলা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ম্যাগনা কার্টার মতই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসে।
“বাঙালি জাতি প্রতিটি অর্জন বুকের তাজা রক্তে দিয়ে আদায় করেছে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আদায় করেছে। বাঙালিদের যে অবস্থাটা ছিল, সম্পূর্ণ অরক্ষিত, এর পরেই কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপন করলেন। কিন্তু ছয় দফা দাবি যখন পেশ করতে গেলেন তখন বাধা দেওয়া হল, পেশ করতে দেওয়া হল না।
“তখন তিনি ওখানে বসেই প্রেস কনফারেন্সে বললেন, প্রচার করে দিলেন, তখনই তাকে হত্যা করারও চেষ্টা করা হল। এরপর ঢাকায় এসে এয়ারপোর্টে প্রচার করে দিলেন, পরবর্তীতে ছয় দফা ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু হল।”
শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শুরুটা হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ৭ জুন। সে কারণে প্রতি বছর ৭ জুন ‘ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ডাকা এক জাতীয় সম্মেলনে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
সেই ইতিহাস তুলে ধরে তার মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বৈষম্যটাকে দূর করার জন্য যা যা আছে সব কিছুই তিনি এই ছয় দফায় তুলে ধরে ছিলেন। ছয় দফা দিলেন ফেব্রুয়ারি মাসে, হাতে সময় খুব কম ছিল, মার্চ-এপ্রিল দুটো মাস। এই সময়ের মধ্যে এই ছয় দফা বাংলাদেশের মানুষ লুফে নিল। এই যে বৈষম্যের চিত্র দেখানো হল, মানুষের মধ্যে সেই চেতনাটা এল।
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এটা সারা বাংলাদেশে প্রচার করলেন, নিজে মিটিং করলেন, ৫২ দিনের মধ্যে ৩৫টি মিটিং করেছিলেন। সেই সাথে সাথে আওয়ামী লীগের যেখানে সম্মেলন হয় নাই, সেখানে সম্মেলনটাও করতেন। এই ছয় দফা মানুষ এভাবে লুফে নিয়েছিল।”
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবৃদ্ধি অর্জন ৯ পার্সেন্ট একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত দিয়েই হয়েছিল; আমরা কেউ আজ পর্যন্ত করতে পারিনি। এর পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের তো আর ওই দিকে নজর ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের মাথায় তো ছিল শুধু ক্ষমতা দখল।
“তাদের মধ্যে ওই পাকিস্তানি মনোভাব, পেয়ারে পাকিস্তানটাই বেশি ছিল; এটা তো আমরা নিজেরা জানি। কীভাবে দেশটাকে একেবারে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা যদি অর্থনৈতিক অবস্থাটা বিবেচনা করি, সেই ৭২ সাল, স্বাধীনতার পর থেকে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যেটা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন; দেশটাকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।”
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আওয়ামী লীগের এগিয়ে চলার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গবন্ধু প্রত্যেকটা বক্তব্যে বলতেন, গ্রামের মানুষের স্বচ্ছলতার কথা, গ্রামের মানুষের উন্নতির কথা। আজকের বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে কাজ করতে পেরেছি বলেই, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
“গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা দেখা দিয়েছে। আমরাও কিন্তু প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ ভাগের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলাম, মাথাপিছু আয় বাড়িয়েছি, আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে।”
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা দখল করা শাসকদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেই পঁচাত্তরের পর যারা ক্ষমতায় এসেছে অবৈধভাবে, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া; এরপর আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত খালেদা জিয়া ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার- এই ২৯ বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে পরিবর্তন, বাংলাদেশের মানুষের অর্থসামাজিক যে উন্নয়ন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন, বাংলাদেশটার অবকাঠামোর উন্নয়ন কোনোটাই কিন্তু কেউ করতে পারে নাই।
“এটা হয়েছে কেবল যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। পরিকল্পিতভাবে যখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি।”